অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া; জীবনের শেষ যজ্ঞ ।

‘অন্ত্য এবং ইষ্টি’ এই দুইটি শব্দ মিলে হয়েছে অন্ত্যেষ্টি শব্দটি গঠিত হয়েছে।’অন্ত্য’ শব্দের অর্থ শেষ এবং ইষ্টি’ শব্দের অর্থ যজ্ঞ।সুতরাং অন্ত্যেষ্টি শব্দের অর্থ হচ্ছে শেষযজ্ঞ।অর্থাৎ মৃতদেহকে অগ্নিতে দান করা।

মৃত মানে দেহ থেকে আত্মার চিরমুক্তি। দেহ থেকে আত্মার মুক্তি হলে দেহটি প্রানহীন অচল জড় বস্তুতে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে দেহটি পচতে শুরু করে।তাই শাস্ত্রে মৃতদেহ সৎকারের বিধান দেওয়া হয়েছে।এই মৃতদেহের  সৎকারকেই অন্তেষ্টিক্রিয়া বলে।

মৃত্যুর পর দেহটিকে বস্ত্রাবৃত করে,মালা,চন্দনাদি দিয়ে সাজিয়ে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মৃত ব্যক্তির দেহ দক্ষিণ দিকে মাথা দিয়ে কুশের উপর শোয়ানো হয়।মৃতের দাহধিকারী স্নান করে এসে মৃতদেহকে কাচা হলুদ ও তেল মেখে স্নান করান।

স্নানের পর মৃতদেহকে নতুন কাপড়, মালা এবং কপালে চন্দন পরাতে  হয়।এরপর দুই চোখ,দুই নাকের ও কানের ছিদ্র স্বর্ণ বা কাসা দ্বারা আচ্ছাদন করতে হয়।তারপর পিন্ডদান করা হয়।

আম্রকাষ্ঠ বা চন্দনকাষ্ঠ দ্বারা চিতা সাজানো হয়।এরপর শবদেহকে চিতার উপর শোয়ানো হয়।চন্দন বা আম্রকাষ্ঠ না পাওয়া গেলেও সমস্যা নে।শাস্ত্রে বিধান আছে যেখানে যেমন কাঠ প্রাপ্য তাই দিয়েই শবদেহ দাহ করা যাবে।বর্তমানে ইলেকট্রিক শক দিয়েও শবদাহ করা হয়ে থাকে।

অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার মন্ত্র

নিয়মানুযায়ী মৃতের জেষ্ঠ্য পুত্রের প্রথমে শব্দেহের শির বা মস্তকে অগ্নিদান করতে হয়।একে প্রচলিত নিয়মে মুখাগ্নি বলা হয়ে থাকে।কারো পুত্র সন্তান না থাকলে রক্তের সম্পর্ক আছে এমন যে কেউই মুখাগ্নি করতে পারেন।এই বিষয়ে স্মৃতি শাস্ত্রে বর্নিত আছে।

অগ্নি দান করার পূর্বে শবদেহকে সাতবার বা তিনবার প্রদক্ষিণ করতে হয়।এবং প্রদক্ষিন করতে করতে নিম্নোক্ত মন্ত্র পাঠ করতে হয়।

 

“ওঁ কৃত্বা দুস্কৃত কর্ম জানতা বাপ্যজানতা।

মৃত্যুকালবশং প্রাপ্য নরং পঞ্চত্বমাগতম্।।

 ধর্মাধর্মসমাযুক্তং লোভমোহসমাবৃম্।

দহেং সর্বগাত্রাণি দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু।।’

 

অর্থাৎ, যেনে বা না যেনে তিনি হয়তো কোনো দুস্কর্ম করেছেন।এখন মৃত্যুকালবশত তিনি পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন।ধর্ম,অধর্ম,লোভ ও মোহাচ্ছন্ন তাঁর শরীর দগ্ধ করুন।তিনি দিব্যলোকে গমন করুন।

দাহকার্য সম্পন্ন হলে চিতায় জল ঢেলে চিতা শীতল করতে হয়।এরপর চিতা পরিস্কার করতে হয় এবং সেই ভষ্ম জলে দান করতে হয়।এরপর শ্মশানবন্ধুগন এবং  শবদাহ কাজে যারা  নিয়োজিত ছিল তারা সকলে স্নান করে আসবেন।

 

 

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার গুরুত্বঃ

মানব দেহ থেকে যখন আত্মা নির্গত হয় তখন স্বাভাবিক ভাবেই দেহটি একটি জড়বস্তু তে পরিনত হয় এবং প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী এটি আস্তে আস্তে পচতে শুরু করে। আর এই মৃতদেহ  যদি ভূপৃষ্ঠে পড়ে থাকে তাহলে প্রথমত জনমানুষের মনে একটা ভীতির সঞ্চার হয়। জনমানুষের মাঝে আতংক বা ভীতি ছাড়ানোর পাশাপাশি এই মৃতদেহের মূল প্রভাব টা পড়ে পরিবেশের উপর। মৃতদেহ সৎকার সংক্রান্ত বিধান শাস্ত্রেই পাওয়া যায় তাই বলায় যায় যে মৃতদেহের সৎকার একটি শাস্ত্রীয় বিধান।

তবে অন্তেষ্টিক্রিয়ার যে শুধুই ধর্মীয় দিক থেকে এর গুরুত্ব রয়েছে এমনটা নয়।সামাজিক দিক থেকেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।কেউ মারা গেলে আত্মীয় -স্বজন, পাড়া -প্রতিবেশী সকলেই দেখতে আসেন।মৃতব্যক্তির পরিবার জ্ঞ্যাতিবর্গ অশৌচ পালন করে তার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে থাকেন।এতে সামাজিক অনুশাসনের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।তাছাড়া অন্তেষ্টিক্রিয়ার মন্ত্রটি উচ্চারণের ফলে আত্মা পবিত্র হয়।এতে সকলের সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব তৈরি হয়।মানুষের মাঝে সামাজিক মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়।

 

সোর্সঃউইকিপিডিয়া;হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা;রচনায়—–ড.পরেশ চন্দ্র মন্ডল,ড দুলাল কান্তি ভৌমিক,বিষ্ণু দাস

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.