এবার আসি তর্পণ নিয়ে। ধর্ম উৎপত্তির ইতিহাসে বলা হয় পূর্বপুরুষকে পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়েই সমাজে ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। সেই প্রাচীনকালের পূর্বপুরুষ অর্চনা স্মৃতি আজও আমরা বহন করে চলেছি এই বিশেষ তিথি কে কেন্দ্র করে।
বৃহৎ ধর্ম পুরাণে বলা হয়েছে যে একদা দেবী পার্বতী ও জয়া ও বিজয়ার কাছে পিতৃ পুরুষ পূজার প্রসঙ্গে বলেছিলেন দেখো সখি, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের তিথিগুলি পিতৃ পুরুষের কাছে পরম প্রীতি বলে জানবে এই সময় তারা জল কামনা করে থাকেন তাই এই বিশেষ পক্ষে পার্বতীকে মেনে শ্রাদ্ধ কার্য সম্পন্ন করলে শুভ ফল লাভ হয়।
শ্রাদ্ধ শুধুমাত্র পিতৃ-পুরুষের অর্চনা নয় এই কার্য আমায় পরম প্রীতি দান করে। বায়ুপুরাণ ,স্কন্দপুরাণ, গয়া মাহাত্ম্য তে পিতৃ মাতৃতর্পণের কথা উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে মানুষের কাছে শ্রাদ্ধ ও তর্পণ এইসব ধারণা অমূলক।
ইতিহাস কেবল মৃত্ কাহিনী মাত্র নয়।আমাদের অতীতকে আমরা অস্বীকার করতে পারিনা বহুকাল ধরে চলে আসছে ভারতীয় ভাবনায়
পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমং তপ পিতোরি
প্রিতিমা পন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতাঃ।
শ্রদ্ধা থেকে এসেছে এই শ্রাদ্ধ কথাটি। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করা হয় মৃত আত্মাদের। অতীতের ভিত্তিতে বর্তমান এবং বর্তমানের ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে ভবিষ্যৎ পারলৌকিক ক্রিয়া দ্বারা কেবল মৃতদের প্রতি নয় গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা ও যত্নের ভাব আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়।
কেনো তিল ও জল দ্বারা তর্পণ করতে হবে??
তিল ও জল দিয়ে সাধারণত তর্পণ করতে হয়। তিল এ থাকে স্নেহপদার্থ ।তিল মাতৃস্নেহের প্রতীক আর জল হল প্রাণের মূল উপাদান সে দিক থেকে দেখলে তর্পণ হল সর্বব্যাপী প্রাণশক্তির সঙ্গে মাতৃস্নেহের মহামিলনের শুভ মুহূর্ত।
পিতৃপক্ষ দেবীপক্ষের মাঝখানে রয়েছে মহালায়া এ যেন আমাদের জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বর্তমান জীবন দুটি অব্যক্ত ও ও প্রকাশের মাঝখানে একমাত্র প্রকাশ ভালোভাবে বাস্তে জানা আর ভালো ভাবে মরতে জানা এটা দুটি একই কথা।
এবার আসি যে তর্পণ কথার অর্থ কি ?
১। তর্পণ শব্দের ব্যুৎপত্তি হল তৃপ + অনট। তৃপ ধাতুর অর্থ তৃপ্তি সাধন করা। এখানে তৃপ্তি সাধন বলতে দেব-ঋষি- পিতৃ-মনুষ্যগণের তৃপ্তিসাধনকে বোঝানো হয়েছে। সাধারণভাবে মৃত পূর্বপুরুষগণকে জলদান করাকেই তর্পণ বলা হয়।
মৃত পূর্বপুরুষ শব্দে যাদের সপিণ্ডীকরণ (বাৎসরিক শ্রাদ্ধ) করা হয়েছে তাদের বোঝাবে। কিন্তু কোনও জীবৎপিতৃক (যার পিতা জীবিত আছে) ব্যক্তি তর্পণ করতে পারবে না। আমাদের পূর্বপুরুষগণ তাদের বংশধরগণের কাছে পিণ্ড ছাড়াও জল আকাঙ্খা করেন।
এই তর্পণ শুরু হয় পিতৃপক্ষে । আর মহালয়ার পরেই দেবীপক্ষের শুরুর আগে এই তর্পণ শেষ । এই কর্মের উদ্দেশ্য পরলোকগত পূর্বপুরুষ দের জীবাত্মার পরিতৃপ্তির জন্য। হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে- “পিতৃদেবো ভব, মাতৃদেবো ভব, অতিথিদেবো ভব”।
পিতা, মাতা, অতিথি এনারা আমাদের কাছে দেবতা। পুত্র রূপে এনাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব থাকেই। তাই এনাদের পরকালে জন্য কর্তব্য করাই শাস্ত্রবিধান। তাই এই নিয়ম।
২। অন্যদিকে “তর্পণ” হল – যেসব বস্তু তনু- মন দিয়ে শ্রদ্ধাভরে প্রদান করা যায় , সেটাই “তর্পণ” । সঠিক ভাবে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রদ্ধা পূর্বক সামান্য তিল জল দিলেই পূর্বপুরুষেরা প্রসন্ন হন । এখানে সূর্যদেব হলেন পিতৃপুরুষের প্রতীক স্বরূপ। তাই দেখা যায় সূর্যের দিকে তাকিয়ে তর্পণ করা হয়।
মহালয়ার প্রাক্কাল্লে ঘণ অন্ধকার অমাবস্যা নিবারণ হয়ে শুক্লপক্ষের প্রতিপদ দিন সূচীত হয়। এই সময় আকাশ , বাতাসে স্নিগ্ধতা থাকে। এটাই পূজার প্রশস্ত সময় মনে করা হয়। “তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে” বলা আছে শরৎ কাল দেবতাদের ঋতু। মহালয়াতে ত্রিনয়নী দেবীর নয়নত্রয় শিল্পী তুলির টানে ফুঁটিয়ে তোলেন।
হিন্দু শাস্ত্রানুসারে দেহের বিনাশ হলেও আত্মার বিনাশ হয় না। তাই আমাদের পিতৃগণের দেহে যে আত্মা ছিলেন তিনি এখন যে শরীরেই অবস্থান করুন সেই শরীরেই জলক্রিয়া ও শ্রাদ্ধের দ্বারা তিনি তৃপ্তি লাভ করে থাকেন। শাস্ত্রমতে তর্পণ জলের ও শাস্ত্রীয় দ্রব্যের পরমাণু অর্থাৎ সূক্ষ্মতম কণা মন্ত্রবলে তাঁর বর্তমান দেহের ভক্ষ্য বস্তুর পর মাণুর সঙ্গে মিলিত হয়ে থাকে।
তাই দেব-ঋষি-পিতৃ-মনুষ্যগণের তর্পণ করলে তাঁরা খুশি হন ও বিনিময়ে তাঁরা আমাদের সুখ,সমৃদ্ধি, সাফল্য,পরিপাকশক্তির বৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু দান করেন। তর্পণ প্রতিদিনই করা উচিত। কিন্তু নানা কাজে মানুষ ব্যস্ত থাকায় পিতৃপক্ষের (কোজাগরী পূর্ণিমার আগের পূর্ণিমার পর প্রতিপদ থেকে মহালয়া পর্যন্ত) পনেরো দিন তর্পণ করে থাকে। যারা তাতেও অক্ষম তারা মহালয়ার দিন তর্পণ করে। স্নানাঙ্গ-তর্পণ স্নানান্তেই করিতে হয়।
তর্পণ এর ইতিহাস :-
মহাভারতে বলা হয়েছে যে, মহাবীর কর্ণের আত্মা স্বর্গে গেলে সেখানে তাঁকে খেতে দেওয়া হল শুধুই সোনা আর ধনরত্ন। ‘ব্যাপার কী?’ কর্ণ জিজ্ঞাসা করলেন ইন্দ্রকে । ইন্দ্র বললেন, ‘তুমি সারাজীবন সোনাদানাই দান করেছো, পিতৃপুরুষকে জল দাও নি। তাই তোমার জন্যে এই ব্যবস্থা।’
কর্ণ বললেন, ‘আমার কী দোষ? আমার পিতৃপুরুষের কথা তো আমি জানতে পারলাম যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে। মা কুন্তী আমাকে এসে বললেন, আমি নাকি তাঁর ছেলে। তারপর যুদ্ধে ভাইয়ের হাতেই মৃত্যু হলো। পিতৃতর্পণের সময়ই তো পেলাম না। ‘ ইন্দ্র বুঝলেন, কর্ণের দোষ নেই। তাই তিনি কর্ণকে পনেরো দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিতে অনুমতি দিলেন।
ইন্দ্রের কথা মতো এক পক্ষকাল ধরে কর্ণ মর্ত্যে অবস্থান করে পিতৃপুরুষকে অন্নজল দিলেন। তাঁর পাপ স্খলন হলো এবং যে পক্ষকাল কর্ণ মর্ত্যে এসে পিতৃপুরুষকে জল দিলেন সেই পক্ষটি পরিচিত হল পিতৃপক্ষ নামে।
হিন্দুধর্ম মতে, পিতৃপক্ষ পূর্বপূরুষের তর্পণাদির জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ। এই পক্ষ পিতৃপক্ষ, ষোলা শ্রাদ্ধ, কানাগাত, জিতিয়া, মহালয়া পক্ষ ও অপরপক্ষ নামেও পরিচিত।
মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন, তাঁকে তাঁর পিতার মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়।
জীবিত ব্যক্তির পিতা বা পিতামহ যে তিথিতে মারা যান, পিতৃপক্ষের সেই তিথিতে তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তবে এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। পূর্ববর্তী বছরে মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ হয় চতুর্থী (চৌথা ভরণী) বা পঞ্চমী (ভরণী পঞ্চমী) তিথিতে। সধবা নারীর মৃত্যু হলে, তাঁর শ্রাদ্ধ হয় নবমী (অবিধবা নবমী) তিথিতে। বিপত্নীক ব্যক্তি ব্রাহ্মণী নারীদের শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ করেন।
শিশু বা সন্ন্যাসীর শ্রাদ্ধ হয় চতুর্দশী (ঘট চতুর্দশী) তিথিতে। অস্ত্রাঘাতে বা অপঘাতে মৃত ব্যক্তিদেরও শ্রাদ্ধ হয় এই তিথিতেই (ঘায়েল চতুর্দশী)। সর্বপিতৃ অমাবস্যা দিবসে তিথির নিয়মের বাইরে সকল পূর্বপুরুষেরই শ্রাদ্ধ করা হয়।
৪। যাঁরা নির্দিষ্ট দিনে শ্রাদ্ধ করতে ভুলে যান, তাঁরা এই দিন শ্রাদ্ধ করতে পারেন। এই দিন গয়ায় শ্রাদ্ধ করলে তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়। মৃত ব্যক্তির পুত্র (বহুপুত্রক হলে জ্যেষ্ঠ পুত্র) বা পিতৃকুলের কোনো পুরুষ আত্মীয়ই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অধিকারী এবং শ্রাদ্ধ কেবলমাত্র পূর্ববর্তী তিন পুরুষেরই হয়ে থাকে। মাতার কুলে পুরুষ সদস্য না থাকলে সর্বপিতৃ অমাবস্যায় দৌহিত্র মাতামহের শ্রাদ্ধ করতে পারেন। কোনো কোনো বর্ণে কেবলমাত্র পূর্ববর্তী এক পুরুষেরই শ্রাদ্ধ করা হয়।
তর্পণের কিছু নিয়ম
তর্পণের জন্য প্রয়োজন ,কুশ,কালো তিল। ছয়টি কূশ প্রথমে জলে ভিজিয়ে রেখে সেটা নরম হলে একত্রে তিনটি কূশ নিয়ে অনামিকা আঙুলে আংটির মতো ধারণ করে তর্পণ করবেন। বাঁ আঙুলেও একই ভাবে কূশাঙ্গরীয় ধারণ করবেন। কূশ ও তিল যদি না পাওয়া যায় তবে শুধু জলেই তর্পণ করতে পারেন।( নারীদের কুশ ধারণ নিষিদ্ধ , দুর্বার আংটি পরতে হবে )
মূলত তর্পণের ক’টি ধরণ?
শাস্ত্র মতে তর্পণ বহু ধরণের হয়। যেমন মনুষ্য তর্পণ, ঋষি তর্পণ, দিব্যপিতৃ তর্পণ, যম তর্পণ, , পিতৃ তর্পণ। শাস্ত্র মতে বিভিন্ন মন্ত্র পাঠ করে এই তর্পণ প্রব সম্পন্ন করতে হয়।
হিন্দু পুরাণে তর্পণ
হিন্দু পুরাণে থেকে আমরা জানতে পারি যে জীবিত ব্যক্তির তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই পিতৃলোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি স্থান যার অধিষ্ঠাতা দেবতা হলেন স্বয়ং যম। এই মৃত্যুর দেবতা যমই কার্যত মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য বা পৃথিবী থেকে তাঁর মৃত্যুর পর পিতৃলোকে নিয়ে যান।
আর তারপর বংশের পরবর্তী প্রজন্মের কারুর যখন মৃত্যু হয়, তখন সেই ব্যক্তি পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গিয়ে ঈশ্বর বা পরমাত্মায় মিশে যান। অন্যান্য নানা হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থ অনুযায়ী পিতৃপক্ষের সূচনা তখনই হয় যখন সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করে।
হিন্দুরা বিশ্বাস করে থাকেন, পিতৃপক্ষের এই সূচনায় তাঁদের পূর্বপুরুষরা পিতৃলোক ত্যাগ করে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের গৃহে গিয়ে সেখানে অবস্থান করেন। পরে যখন সূর্য আবার যথাসময়ে বৃশ্চিকরাশিতে প্রবেশ করে তখন তাঁরা আবার পিতৃলোকে পুনর্গমন করেন। আর পূর্বপুরুষরা যেহেতু তাঁদের গৃহে অবস্থান করেন তাই তর্পণের উদ্দেশ্যে এইসময় তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন হিন্দুরা।
বিভিন্ন পুরান, ধর্ম গ্রন্থে তর্পণ এর ইতিহাস
১।রামায়ণে তর্পণ শ্রী রাম চন্দ্র
হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী কোনো শুভ কাজ করতে গেলেই প্রয়াত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয়, তাঁদের প্রণাম জানিয়ে কাজটি শুরু করতে হয়। রামচন্দ্র যখন লঙ্কা বিজয়ের আগে দেবীকে অকালবোধনে মর্ত্যে আনেন, তখনও তিনি পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেন। এই দিনে প্রয়াত আত্মারা মর্ত্যে আসেন। প্রয়াত আত্মাদের এই মর্ত্যে আগমনকে বলা হয় মহালয়, সেই থেকেই কিন্তু এসেছে মহালয়া কথাটি। মহালয়া আবার পিতৃপক্ষের শেষ দিনও বটে!
২।মহাভারতে তর্পণ
তর্পণ সম্পর্কে মহাভারতে আমরা একটি কাহিনী পাই। দাতা কর্ণের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা স্বর্গে গেলে তাঁকে সোনা ও মূল্যবান ধনরত্ন খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। যথারীতি কর্ণ অবাক হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেন। তখন দেবরাজ জানান যে কর্ণ তাঁর সারাজীবনে অনেক দানকর্ম করলেও প্রার্থিত ব্যক্তিকে শুধুমাত্র মূল্যবান ধনরত্নই দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে কখনও খাবার দেননি।
৩। কর্ণ এবং ইন্দ্র
জীবদ্দশায় পিতৃপুরুষের প্রতি অবহেলা দেখানোর জন্য তাঁকে সোনা ও ধনরত্ন খাদ্য হসেবে দেওয়া হয়েছে। কর্ণ তখন তাঁর অনিচ্ছাকৃত ভুল স্বীকার করে নিলে তাঁকে ষোলো দিনের জন্য আবার পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে খাদ্য ও জল দান করার অনুমতি দেন ইন্দ্র। আর সেই থেকে এই ষোল দিনের পর্ব নাকি পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়। কোনো কোনো জায়গায় এখানে দেবরাজ ইন্দ্রের স্থানে মৃত্যু দেবতা যমকেও আমরা দেখি।
৪। আর গরুড় পুরাণে আছে ‘পুত্র ছাড়া মুক্তি নেই’। তাই তর্পণের মাধ্যমে পুত্রের পিতা ও পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা অন্ন ও জলই কার্যত পূর্বপুরুষের মুক্তির উপায় বা মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। তাই হিন্দুধর্মে মহালয়ার দিনে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে যে তর্পণ করা হয়, তা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
মহিলারা কি মহালয়ায় তর্পণ করতে পারেন? শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা কি?
মহালয়ার ভোরে পুরুষদের ভিড়ের মাঝ থেকে ভিজে কাপড়ে কোনও মাঝবয়সী মহিলার একা উঠে আসার দৃশ্য অকল্পনীয় না হলেও বহুল প্রচলিত নয়। কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে তর্পণের সম্পর্ক প্রচলিত নয় কেন? যে দেশে বহু মেয়ের জন্মানোর অধিকারই জোটে না, সেখানে আবার তর্পণ!
মহালয়ার সকালে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে পরিবারের ছেলেরা জল দান করেন। সামাজিক নিয়মে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও লিঙ্গের ভেদাভেদ থাকে! পিতৃপক্ষের অবসানের সময়ে পার্বণী শ্রাদ্ধ বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শাস্ত্রমতেই সম্পন্ন করতে হয় সেই আচার। এতে মা, মেয়ে, বাড়ির বৌয়ের বিশেষ স্থান নেই। তবে তাঁদের জায়গা দেওয়া বা না দেওয়া নিতান্তই রাজনৈতিক।
তবে সমাজ চাইলে মানতে এবং আনতে পারে সব পরিবর্তন? এমনকি বদলাতে পারে শাস্ত্রও? কারণ, শাস্ত্রে কোথাও মেয়েদের একা তর্পণ করার অধিকারই দেওয়া নেই বলে জানিয়েছেন প্রবীণ পণ্ডিত শম্ভুনাথ স্মৃতি ও বেদতীর্থ।
তিনি বলছেন, ‘‘কোনও বিবাহিতা মহিলা স্বামীর তর্পণের সঙ্গী হতে পারেন মাত্র। এর বাইরে মেয়েদের তর্পণের কথা কোথাও উল্লেখ নেই। যাঁরা করেন, তাঁরা নিয়ম না মেনে করেন।’’ তবে ধর্মশাস্ত্র সংখ্যায় অনেক। সব শাস্ত্রেই কি একই নিয়ম? প্রবীণ পণ্ডিত মনে করান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনুস্মৃতিতে বলা নিয়মানুসারেই চলা হয়।
তবে কি শাস্ত্রের বিধি ভেঙেই মেয়েরা তর্পণে যোগ দেন আজকাল? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক দেবার্চনা সরকার বলেন , ‘‘শাস্ত্র তৈরি হয়েছে কাল ও স্থানের প্রয়োজনের নিরিখে।’’ প্রয়োজন যেমন অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক হয়, তেমনই রাজনৈতিকও হয়। সে কথা মনে করান শ্রী চৈতন্য কলেজের সংস্কৃত বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক সোমা গুহরায়ও।
তিনি বলেন, ‘‘বৈদিক যুগে মেয়েদের উপরে এত কড়াকড়ি ছিল না। তা ছাড়া, মহাভারতেও মেয়েদের তর্পণের নিদর্শন আছে। স্মৃতি যুগ থেকেই ধীরে ধীরে বদলেছে মেয়েদের প্রতি সামাজিক আচরণ।’’ মহাভারতে স্ত্রী পর্বে কৌরব রমণীদের তর্পণ করার বিশেষ উল্লেখ আছে। পরে শাস্ত্র যত কড়া হয়েছে, সে সঙ্গেই মেয়েরা একে একে সামাজিক অধিকার হারিয়েছে। প্রিয়জনেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ইচ্ছেটুকুও হয়ে দাঁড়িয়েছে বিতর্কের বিষয়।
পুরাণ-গবেষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি অবশ্য এই বিতর্ক মানেন না। তিনি বলেন, ‘‘কোথাও লেখা নেই যে মেয়েরা তর্পণ করতে পারবে না। শ্রাদ্ধে যেমন শ্রদ্ধা জানানো হয়, তর্পণও তা-ই। মেয়েরা শ্রাদ্ধ করতে পারলে তর্পণ করবে না কেন?’’
তাঁর বক্তব্য, শাস্ত্রের নামে যখন-তখন নিয়ম ভাঙা আর গড়া হচ্ছে। সেই ভাঙা গড়ার মাঝে এখনও প্রাসঙ্গিক থেকে যায় মেয়েদের এই সামান্য অধিকারের কথাও। এখনও কন্যাভ্রূণ হত্যা রোখার নামে চলে রাজনীতি। এখনও মেয়েরা আত্মীয়দের স্মরণ করতে গেলে পড়েন সামাজিক রোষের মুখে।
তবু সেই তর্পণের মহালয়া পেরিয়ে দেবীপক্ষ আসে। স্ত্রী শক্তির আরাধনা ঘিরে চলে বাণিজ্য, রাজনীতি, সমাজনীতির নানা গিমিক। তবু অশুভকে ভুলে উৎসবে মাতি মেয়েরাও!।
তথ্যসূত্র:- সাপ্তাহিক বর্তমান , লেখক শুভ্র ভট্টাচার্য এর কিছু লেখা, বর্গভীমা,ভক্তি আরাধনা , রামকৃষ্ণ পেজ, শান্তি স্বস্ত্যোন কৌমূদি, তর্পণ এর কিছু বই , ক্রিয়া কাণ্ড বারিধি বই। ইত্যাদি ।
সোর্সঃ শাস্ত্রপৃষ্ঠা – ফেসবুক গ্রুপ। লেখকঃ Bibek Bhattacharya
বি. দ্রঃ এখানে লেখকের হুবহু পোষ্ট তুলে ধরা হলো। কোনরূপ ব্যতিক্রম বা পরিমার্জন ব্যতিত।