বছরে বারোটি মাসের আধিপত্য দেখে, অধিকমাস বৈকুণ্ঠাধিপতি শ্রীনারায়ণকে নিজ দুঃখ জ্ঞাপন করেছিলেন। তিনি কৃপাপূর্বক অধিমাসকে সঙ্গে নিয়ে গোলোকে শ্রীকৃষ্ণের কাছে উপনীত হলেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন বললেন
অহমেতৈযর্থালোকে প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ।
তথায়মপি লোকেষু প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ ॥
অস্মৈ সমর্পিতাঃ সর্বে যে গুণাময়ি সংস্থিতাঃ ।
মৎসাদৃশ্যমুপাগম্য মাসানামধিপো ভবেৎ ॥
জগৎপূজ্য জগদ্বন্দ্যো মাসোহয়ং তু ভবিষ্যতি ।
সর্বে মাসাঃ সকামশ্চ নিষ্কামোহয়ং ময়া কৃতঃ ॥
অকামঃ সর্বকামো বা যোহধিমাসং প্রপূজয়েৎ।
কর্মাণি ভষ্মসাৎ কৃত্বা মামেবৈষ্যত্যসংশয়ম্ ॥
কদাচিন্মম্ ভক্তানামপরাধোহতিগণ্যতে।
পুরুষোত্তম ভক্তানাং নাপরাধঃ কদাচন ॥
য এতস্মিন্মহামূঢ়া জপ দানাদি বর্জিতাঃ ।
সৎকর্ম স্নানরহিতা দেব-তীর্থ-দ্বিজ-দ্বিষঃ ॥
জায়ন্তে দুর্ভাগা দুষ্টাঃ পর ভাগ্যেপজীবিনঃ।
ন কদাচিৎ সুখং তেষাং স্বপ্নেহপি শশশৃঙ্গবৎ ॥
যেনাহমর্চ্চিতো ভক্ত্যা মাসেহস্মিন্ পুরুষোত্তমে।
ধন পুত্র সুখং ভুংক্ত্বা পশ্চাদ্গোলোকবাসভাক ॥
“হে রমাপতি! আমি যেরূপ এই জগতে পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত এই অধিমাসও তদ্রপ ত্রিলোকে পুরুষোত্তম বলে বিখ্যাত হবে। আমাতে যে সমস্ত গুণ আছে, সে সব আমি এই মাসে অর্পণ করলাম। আমার সদৃশ হয়ে এই অধিমাস অন্য সকল মাসের অধিপতি হবে। এই মাস জগৎপূজ্য ও জগত্বন্দ্য। অন্য সকল মাস সকাম, এই মাসটি নিষ্কাম।
যিনি সকল প্রকার কামনা শূন্য বা সকল কামনা যুক্ত হয়েও এই মাসের পূজা করেন, তিনি সকল কর্ম ভস্মসাৎ করে আমাকে প্রাপ্ত হন। যদিও আমার ভক্তদের কদাচিৎ অপরাধ হয়, কিন্তু এই পুরুষোত্তম মাসে ভক্তদের কখনই অপরাধ হবে না।
যে সকল মহামূঢ় এই অধিমাসে জপ-দানাদি বর্জিত ও সকর্ম-স্নানাদি রহিত থাকে এবং দেব, তীর্থ ও দ্বিজগণের প্রতি বিদ্বেষ করে, সেই সকল দুষ্ট দুর্ভাগা পরভাগ্যোপজীবী হয়ে স্বপ্নেও কোনো সুখ পায় না।
এই পুরুষোত্তম মাসে যিনি। আমাকে ভক্তিপূর্বক অর্চন করেন, তিনি ধন-পুত্রাদি-লাভে সুখ ভোগ করে অবশেষে গোলোকবাসী হন।” একবার নৈমিষারণ্যে হাজার হাজার ঋষি সমবেত হয়ে তপস্যা করছিলেন।
সৌভাগ্যবশত শ্রীসুত গোস্বামী তাঁর শিষ্যগণের সাথে সেখানে উপস্থিত হলেন। মুনিগণ তাকে দর্শন করে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন এবং একটি উত্তম ব্যাসাসন। প্রদান করলেন।
মুনিগণ করজোড়ে বলতে লাগলেন, “হে সুত গোস্বামী! আমরা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চমৎকার এবং আশ্চর্য লীলাকথা শ্রবণ করলাম। বৈদিক জ্ঞান অত্যন্ত জটিল ও রহস্যময়। তাই প্রশ্ন, কীভাবে এই ভবসমুদ্র থেকে উদ্ধার পেয়ে ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে পারব?”
শৌনকাদি ঋষিগণের অনুরোধে সুত গোস্বামী বলতে লাগলেন, “হে মুনিবৃন্দ! শ্রবণ করুন। আমি সর্বপ্রথম পুষ্কর তীর্থে গিয়েছিলাম।
এরপর হাজার হাজার তীর্থ ভ্রমণ করে হস্তিনাপুরে পৌঁছাই। সেখানে গঙ্গার তীরে পরীক্ষিত মহারাজ অসংখ্য ঋষিগণের সঙ্গে প্রায়োপবেশনে ছিলেন। তখন শুকদেব ।
গোস্বামী সেখানে আগমন করলেন। তখন সকলেই তাকে শ্রদ্ধার সাথে সম্ভাষণ জ্ঞাপন করলেন। তারা শুকদেব গোস্বামীকে উচ্চ আসন প্রদান করলেন। তিনি পরীক্ষিত মহারাজকে ভাগবত কথা শ্রবণ করালেন।
এখন আমি আপনাদেরকে ভগবানের সর্বাকর্ষক লীলাকথা বলব। একবার শ্রীনারদ মুনি বদরিকাশ্রমে শ্রীনারায়ণ ঋষির কাছে গিয়েছিলেন। তাঁর পাদপদ্ম থেকে অলকানন্দা প্রবাহিত হচ্ছিল।
নারদ মুনি নারায়ণ ঋষিকে দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদনপূর্বক প্রার্থনা করলেন, “হে দেবেশ্বর! হে দয়ানিধে! হে লোকস্রষ্টা! আপনি পরমসত্য। আপনাকে আমার প্রণতি নিবেদন করছি। হে প্রভু!
এই জড়জগতে সবাই ইন্দ্রিয় তর্পণে কতই না ব্যস্ত। তারা জীবনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছে। তাই এ সমস্ত গৃহস্থ। এবং আমার ন্যায় পরিব্রাজক সন্ন্যাসীগণের আচরণীয় এমন। কোনো একটি পন্থা বলুন, যাতে আত্মোপলব্ধি লাভ করে।
ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়া যায়।” নারদের মধুর বচন শ্রবণ করে শ্রীনারায়ণ ঈষৎ হাস্য করে বললেন, “হে নারদ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলা শ্রবণ কর।
এতে তোমার পাপরাশি ধ্বংস হবে। আমি জানি তুমি তা পূর্ণরূপে অবগত আছো। কিন্তু জনকল্যাণার্থে আবারও জিজ্ঞাসা করছ। তাই আমি তোমাকে পুরুষোত্তম ব্রতের মহিমা বলছি।
এটি শুধু জাগতিক সুখই প্রদান করে না, ভগবদ্ধামে ফিরে যাবার যোগ্যতাও প্রদান করবে।” নারদ বললেন, “হে ভগবান! আমি কার্তিক, চৈত্র প্রভৃতি সকল মাসেরই মহিমা শুনেছি।
কিন্তু পুরুষোত্তম মাসটি কীরূপ? হে দয়ানিধি, আমাকে এই পবিত্র মাস সম্পর্কে বলুন। কীভাবে এ মাসকে মহিমান্বিত করা উচিত? আমি কি মন্ত্রই বা জপ করব? আমাকে বিস্তারিতভাবে বলুন।”
শ্রীনারায়ণ বললেন, “হে নারদ! পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-যুধিষ্ঠির সংবাদে এবিষয় আলোচিত হয়েছিল। একবার ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁর সাম্রাজ্য, রাজপ্রাসাদ এমনকি দ্রৌপদীকেও পাশাখেলায় পণ রেখেছিলেন।
সেই খেলায় দুর্যোধনের নিকটে তিনি হেরে যান। তখন রাজসভায় দুঃশাসন কর্তৃক দ্রৌপদী অপমানিত হয়েছিলেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন বস্ত্রহরণজনিত লজ্জা থেকে দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন।
যুধিষ্ঠির মহারাজ তখন স্ত্রী ও ভ্রাতাগণসহ কাম্যবনে বাস করতে শুরু করেন। একবার দেবকীনন্দন শ্রীকৃষ্ণ, সেই বনে পাণ্ডবদের দেখতে যান। পাণ্ডবেরা ভগবানকে প্রণতি নিবেদন করলেন।
তাদের দুঃখ দেখে শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত বিমর্ষ হলেন। তিনি দুর্যোধনের প্রতি সক্রোধ বচন বলতে লাগলেন। তখন মনে হলো ভগবান যেন সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস করে দেবেন। তাই পাণ্ডবগণ ভগবানের নিকটে বিনম্র চিত্তে প্রার্থনা নিবেদন করলেন।
অর্জুনের বিনম্র প্রার্থনা শ্রবণ করে ভগবান শান্ত হলেন এবং বলতে লাগলেন, “হে অর্জুন! তোমাদের সবাইকে দর্শন করে এবং তোমাদের ভক্তিতে, ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে আমি এখন তোমাদের পুরুষোত্তম মাসের অত্যাশ্চর্য মহিমা বর্ণনা করব।”
প্রকাশকঃ শ্রী চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী
হরেকৃষ্ণ পাবলিকেশন্স (ইসকন)