অক্ষয় তৃতীয়া হল চান্দ্র বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি। অক্ষয় তৃতীয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ তিথি। অক্ষয় শব্দের অর্থ হল যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। বৈদিক বিশ্বাসানুসারে এই পবিত্র তিথিতে কোন শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। যদি ভালো কাজ করা হয় তার জন্যে আমাদের লাভ হয় অক্ষয় পূণ্য আর যদি খারাপ কাজ করা হয় তবে লাভ হয় অক্ষয় পাপ। তাই এদিন খুব সাবধানে প্রতিটি কাজ করা উচিত। খেয়াল রাখতে হয় ভুলেও যেন কোনো খারাপ কাজ না হয়ে যায়। কখনো যেন কটু কথা না বেরোয় মুখ থেকে। কোনো কারণে যেন কারো ক্ষতি না করে ফেলি বা কারো মনে আঘাত দিয়ে না ফেলি। তাই এদিন যথাসম্ভব মৌন থাকা জরুরী। আর এদিন পূজা,জপ,ধ্যান,দান,অপরের মনে আনন্দ দেয়ার মত কাজ করা উচিত। যেহেতু এই তৃতীয়ার সব কাজ অক্ষয় থাকে তাই প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হয় সতর্কভাবে। এদিনটা ভালোভাবে কাটানোর অর্থ সাধনজগতের অনেকটা পথ একদিনে চলে ফেলা।
অক্ষয় তৃতীয়ার ফর্দঃ এদিন অনেক বাড়িতেই পুজো করা হয়। অনেকেই জানেন না যে এই পুজোতে কী কী লাগবে। তাই এই পুজোর জন্য যা যা উপকরণ দরকার, তার একটি ফর্দ দেওয়া হল। যেমন- সিদুঁর, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগর্ব্য, তিল, হরিতকী, ফুল, দুর্ব্বা, তুলসি, বিল্বপত্র, ধূপ, প্রদীপ, ধূনা, মধুপর্ক বাটি ২, আসনাঙ্গুরীয় ২, দই, মধু, চিনি, ঘি, পুজোর জন্য কাপড় ১, শাটী ১, নৈবেদ্য ২,কুচো নৈবেদ্য ১, সভোজ্য জলপূর্ণ ঘট ১, বস্ত্র ১, পাখা ১, দক্ষিণা।
অক্ষয় তৃতীয়ায় রোহিনী নক্ষত্র ও শোভন যোগ সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়।
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, অক্ষয় তৃতীয়ায় বিষ্ণুর পুজো করলে সম্পদ বৃদ্ধি হয়। একইসঙ্গে বিষ্ণু ও শিবের পুজো করলেও ফল পাওয়া যায়। গঙ্গায় স্নান করতে যাওয়া সম্ভব না হলে বাড়িতেই গঙ্গাজলে স্নান করার পর বিষ্ণুমূর্তিতে চন্দন মাখাতে হবে। এর সঙ্গে দিতে হবে তুলসিপাতা। সম্ভব হলে বেলফুলও দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া দুধ, দই, ঘি, মধু ও চিনি দিয়ে পঞ্চমৃত তৈরি করা যেতে পারে।
পুরাণ অনুযায়ী, মহাভারতে পাণ্ডবরা যখন নির্বাসনে ১৩ বছর কাটিয়ে ফেলেন, তারপর একদিন ঋষি দুর্বাসা তাঁদের আস্তানায় প্রবেশ করেন। দ্রৌপদী তাঁকে অক্ষয় পাত্রে খেতে দেন। এই আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে দুর্বাসা বলেন, ‘আজ অক্ষয় তৃতীয়া। আজ যে ছোলার ছাতু, গুড়, ফল, বস্ত্র, জল ও দক্ষিণা দিয়ে বিষ্ণুর পুজো করবে, সে সম্পদশালী হয়ে উঠবে।’
অক্ষয় তৃতীয়া লোকবিশ্বাসের সর্বভারতীয় চরিত্রের একটি চমৎকার নিদর্শন
ভারত জুড়ে বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয় দিনে অক্ষয় তৃতীয়া পালন করা হয়। ভারত জুড়ে বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয় দিনে অক্ষয় তৃতীয়া পালন করা হয়। মানুষের বিশ্বাস, এই দিন স্নান করে ব্রাহ্মণকে পাখা, ছাতা এবং অর্থ দান করলে অক্ষয় পুণ্য অর্জিত হয়। ফলে এই তিথি উদযাপন অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভারতের বহু প্রদেশে পালিত এই উত্সব হিন্দি বলয়ে আখা তীজ নামে অভিহিত। জৈনরাও এই তিথি পালন করেন। অক্ষয় তৃতীয়া লোকবিশ্বাসের সর্বভারতীয় চরিত্রের একটি চমত্কার নিদর্শন। এবং এই তিথি হল হিন্দুদের সাড়ে তিনটি সর্বাধিক শুভমুহূর্তের অন্যতম। অন্য দুটি হল পয়লা চৈত্র এবং বিজয়া দশমী, আর কার্তিকের শুক্লপক্ষের প্রথম দিনটি হচ্ছে আধখানা তিথি। কথিত আছে, এই তিথিতেই ব্যাসমুনি গণেশকে মহাভারত বলতে শুরু করেছিলেন; এই দিনেই কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বস্ত্রহরণের অমর্যাদা থেকে রক্ষা করেছিলেন; এই দিনেই সূর্যদেব পাণ্ডবদের ‘অক্ষয়পাত্র’ দান করেছিলেন, যে পাত্রের খাবার কখনও ফুরোবে না। আরও নানা উপকথা এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। অনেকের মতে এই দিন ত্রেতাযুগ শুরু হয়েছিল, আবার অনেকে বলেন সত্যযুগ। মুশকিল হল, এগুলো একটু পুরনো দিনের ব্যাপার, তর্কের মীমাংসা করতে পারেন এমন কেউ বেঁচে নেই। আবার, এই তিথিতেই নাকি গঙ্গার মর্তে অবতরণ ঘটেছিল। অন্য দিকে, কৃষ্ণ এই দিনেই পরশুরাম রূপে জন্ম নিয়েছিলেন এবং সমুদ্রের বুক থেকে জমি উদ্ধার করেছিলেন, কয়েক শতাব্দী পরে ওলন্দাজারা যেমনটা করবেন। কোঙ্কণ ও মালাবার উপকূলে অক্ষয় তৃতীয়ায় পরশুরাম এখনও পূজিত হন। বাংলায় পরশুরামের কোনও ভক্ত নেই, বোধহয় এই কারণে যে, এখানে সমস্যাটা উল্টো, নদীতে পলি এবং মাটি জমে চর জেগে উঠছে, এখানে বরং পরশুরাম তাঁর কুঠার চালিয়ে পবিত্র ভাগীরথীর বুকে জমা পলি নিকেশ করতে পারতেন।
কৃষিতে হোক অথবা বাণিজ্যে, অক্ষয় তৃতীয়ায় সমৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয় এবং তা থেকেই বোঝা যায়, হিন্দু জীবনাদর্শে জাগতিক বিষয়কে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই দিন দেবী অন্নপূর্ণার জন্মদিন, ধনসম্পদের দেবতা কুবেরের আরাধনাও এ তিথির সঙ্গে জড়িত। কুবের এক আশ্চর্য দেবতা। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত বিবিধ উপকথায় সমাজ-ইতিহাসের মূল্যবান রসদ আছে। ব্রাহ্মণ্য কাহিনিগুলি পশ্চিমী উপাখ্যানের মতো সরল নয়, বহুমাত্রিক, সেখানে সমাজের বিবর্তন সম্পর্কে নানা ধারণা খুঁজে নেওয়া যায়। কুবেরকে বর্ণনা করা হয় এক কুদর্শন, খর্বকায় এবং স্ফীতোদর যক্ষ রূপে। প্রথম যুগে ভারতে নবাগত আর্যদের জীবিকা ছিল পশুচারণ, সুতরাং তাঁরা ভ্রাম্যমাণ জীবন যাপন করতেন। অন্য দিকে, পুরনো অধিবাসীদের স্থায়ী বসতি ছিল, তাঁদের আর্থিক অবস্থাও ছিল আর্যদের তুলনায় সমৃদ্ধ। কিন্তু তাঁদের গায়ের রং আর্যদের মতো ফরসা নয়, এবং আর্যরা তাঁদের তুলনায় দীর্ঘাঙ্গী। দেখতে খারাপ বলে আর্যরা তাঁদের নিচু চোখে দেখতেন। বৈদিক, বেদ-উত্তর এবং পৌরাণিক কাহিনিতে অনার্য জনগোষ্ঠীর বিপুল ঐশ্বর্যের বিস্তর উল্লেখ আছে। এই সম্পদের একটা কারণ হল, তাঁরা পশুপালন এবং কৃষি থেকে অর্জিত সম্পদের একটা অংশ স্বর্ণ ও মণিরত্নের আকারে সঞ্চিত রাখতেন। অক্ষয় তৃতীয়ায় সঞ্চয় করা ও সঞ্চিত অর্থ দিয়ে সোনারূপো কেনার ঐতিহ্য এই সূত্রেই এসেছে। এর ছ’মাস পরে ধনতেরাসেও একই রীতি অনুসৃত হয়। অর্থনীতিবিদ ও লগ্নি-বাজারের উপদেষ্টারাও এই উপদেশই দেন।
কুবেরকে বৈদিক সাহিত্যে প্রথমে দেখা যায় ‘ভূতেশ্বর’ রূপে। দেবতা হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি মেলে পুরাণের যুগে, হাজার বছর পরে। তত দিনে মনু-কথিত ‘মিশ্র জনগোষ্ঠী’ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসবাস করছেন। ক্রমশ কুবেরকে বৌদ্ধরা বৈশ্রবন্ত নামে এবং জৈনরা সর্বন-ভূতি নামে স্বীকৃতি দেন। লক্ষ্মী ঐশ্বর্যের দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া অবধি কুবের হিন্দুদের কাছে সম্পদের দেবতা হিসেবে পূজিত হয়ে চলেন। দেবতাদের সম্পদরক্ষী হিসেবে তাঁর গায়ের রংও ক্রমশ পরিষ্কার হতে থাকে, যদিও তিনি গণ, যক্ষ, কিন্নর, গন্ধর্ব গুহ্যক প্রমুখ ‘পশ্চাত্পদ গোষ্ঠী’র প্রতিনিধিই থেকে যান। লোকদেবতা থেকে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের উচ্চতর কোটিতে ওঠার স্পর্ধা দেখিয়েছেন তিনি, তার মূল্য দিতে হয়েছে কুবেরকে, তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়েছে, একেবারে মনসার মতোই। লড়াই না করে কিছু পাওয়া যায় না। অক্ষয় তৃতীয়া এবং ধনতেরাসে অনেক হিন্দু তাঁর আরাধনা করে। হিন্দুধর্ম কোনও দেবতাকেই একেবারে ছেঁটে ফেলে না, দরকার মতো একটা সাম্মানিক আসন দিয়ে এক পাশে সরিয়ে দেয়। প্রসঙ্গত, বৌদ্ধধর্মের আধারে কুবের দিব্যি অন্য একাধিক দেশে পৌঁছে গেছেন। জাপানে তিনি বিশামন নামে পূজিত।
কোন কাহিনি যুধিষ্ঠিরকে শুনিয়েছিলেন শতানিক?
তখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু সিংহাসনে বসেও মনে শান্তি নেই মহারাজ যুধিষ্ঠিরের। যুদ্ধে এত প্রাণ গিয়েছে, বিপুল অপচয় হয়েছে সহায় সম্পদের। স্বামী, পুত্র, স্বজনহারা মানুষের কান্নায় ধর্মরাজ কাতর হয়ে পড়েছেন। এই পাপের বোঝা কে বহন করবে? মহারাজ যুধিষ্ঠিরের মনের অস্থিরতা বুঝতে পেরে মহামুনি শতানিক তাঁকে শুনিয়েছিলেন সে কাহিনি।
অনেক কাল আগে রাগী ও নিষ্ঠুর এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ব্রাহ্মণ হলে কি হবে? ধর্ম বিষয়ে তাঁর কোনও আগ্রহ ছিল না। এক বার এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ক্ষুধার জ্বালায় তাঁর কাছে কিছু খেতে চাইলেন। কিছু দেওয়া দূরে থাক, সেই নাস্তিক ব্রাহ্মণ ভিখারি বলে গালমন্দ করে গরিব ব্রাহ্মণকে দরজা থেকেই তাড়িয়ে দিলেন। খিদে-তেষ্টায় কাতর সেই ব্রাহ্মণ অপমানিত হয়ে চলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সে সময় তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়ালেন ব্রাহ্মণী সুশীলা। অতিথির কাছে ক্ষমা চেয়ে তিনি বললেন, ‘ভরদুপুরে অতিথি রুষ্ট ও অপমানিত হয়ে ফিরে গেলে সংসারের অমঙ্গল হবে। গৃহের শান্তি-সমৃদ্ধি আর থাকবে না।’ দরিদ্র ব্রাহ্মণকে তিনি বললেন, ‘আপনি এখানেই অন্ন জল গ্রহণ করবেন। আপনার কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’ ব্রাহ্মণপত্নী অতিথি ভিক্ষুকের সামনে ঠাণ্ডা জল এবং অন্নব্যঞ্জন পরিবেশন করলেন। মধ্যাহ্ন ভোজন শেষে যাওয়ার আগে সন্তুষ্ট ব্রাহ্মণ সুশীলাকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘তোমার এই অন্নজল দান হোক অক্ষয় দান।”
বহু বছর কেটেছে। সেই ক্রোধী ব্রাহ্মণ বৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর মৃত্যু আসন্ন। তাঁকে নিয়ে যেতে হাজির একই সঙ্গে যমদূত ও বিষ্ণুদূতের দল। মৃত্যুর পর তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে এই নিয়ে বিবাদ শুরু হল দুই দল দূতের মধ্যে। এক দল তাঁকে বিষ্ণুলোকে নিয়ে যেতে চায়। অন্য দলের দাবি, ওই পাপী ব্রাহ্মণের একমাত্র স্থান নরক। এরই মাঝে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর ব্রাহ্মণ একটু জল খেতে চাইলেন। যমদূতেরা তখন ব্রাহ্মণকে অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে বললেন, ‘একদা তুমি তোমার গৃহ থেকে অতিথি ভিখারিকে জল না দিয়ে বিতাড়িত করেছিলে। সুতরাং তুমি জল পাবে না।’ তাঁরা ব্রাহ্মণকে নিয়ে যমরাজের কাছে নিয়ে গেলেন।
কিন্তু যম তাঁর দূতদের বললেন, ‘ওঁর মতো পুণ্যবান ব্রাহ্মণকে আমার কাছে আনলে কেন? বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে এই ব্রাহ্মণপত্নী তৃষ্ণার্ত অতিথিকে অন্নজল দান করেছেন। এ দান অক্ষয়। স্ত্রীর পুণ্যে ইনিও পুণ্যাত্মা। সেই পুণ্যফলে ব্রাহ্মণের স্থান হবে স্বর্গে।’ কাহিনি শেষে শতানিক মুনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘মহারাজ, বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে ব্রাহ্মণকে অন্ন বস্ত্র জল দান করলে যাবতীয় পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। এবং সেই দানের পুন্য অক্ষয় হয়ে থাকে।’ সোজা কথায় অক্ষয় তৃতীয়া হল চান্দ্র বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি তিথি হল অক্ষয় তৃতীয়া। অক্ষয় শব্দের অর্থ হল, যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। বৈদিক বিশ্বাসানুসারে এই পবিত্র তিথিতে কোনও শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। যদি ভাল কাজ করা হয় তার জন্য লাভ হয় অক্ষয় পূণ্য। যদি খারাপ কাজ করা হয় তবে অক্ষয় পাপের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়। তাই শাস্ত্রের নির্দেশ, এ দিনের প্রতিটি কাজ খুব সাবধানে করা উচিত। কোনও খারাপ কাজ, কোনও কটু কথা যেন মুখ থেকে না বের হয়। কোনও কারণে যেন কারও ক্ষতি না হয়। তাই এ দিন যথাসম্ভব মৌন থাকা জরুরি। পূজা, ধ্যান, দান বা অন্যকে আনন্দ দেওয়া উচিত। যেহেতু এই তৃতীয়ার সব কাজ অক্ষয় থাকে তাই প্রতিটি পদক্ষেপ করতে হয় সতর্ক ভাবে।
তবে শতানিক মুনির গল্পের শেষে আরও একটু আছে। বিষ্ণুলোকে পৌঁছনোর পরে ভগবান বিষ্ণু সেই ব্রাহ্মণকে বলেন, তাঁর স্ত্রী মাত্র এক বার অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে ব্রাহ্মণকে অন্নজল দান করেছেন। কিন্তু সেই দান বা ‘অক্ষয়ব্রত’ পর পর আট বার করতে হবে। তবেই অক্ষয় পুণ্যলাভ হবে। এই বলে বিষ্ণু ব্রাহ্মণকে কী ভাবে অক্ষয় ব্রত পালন করতে হবে তা বিশদে বলে ফের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে আরও সাত বার অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে বিষ্ণু কথিত পদ্ধতিতে অক্ষয়ব্রত পালন করেন। এই ব্রতের প্রধান উপকরণ হল যব। শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে যব দিয়ে লক্ষী-নারায়ণের পুজো করে ব্রাহ্মণকে অন্ন, বস্ত্র, ভোজ্য, ফল ইত্যাদি দিয়ে বরণ করতে হয়। ব্রতীরা এ দিন যব দিয়ে তৈরি খাবার খান। এ পার-ও পার দুই বাংলাতেই এখনও এই দিনে সেই রীতি মেনে পালন করা হয় অক্ষয়ব্রত। সধবা মহিলারা (এয়ো) সূর্য ওঠার আগেই নদীঘাটে ফুল, দূর্বা, বেলপাতা, সিঁদুর, সরষের তেল প্রভৃতি উপকরণ নিয়ে জড়ো হন। সূর্য এবং গঙ্গাদেবীকে আবাহন এবং পরিবারের মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে স্নান সম্পূর্ণ করেন। গোত্রভেদে কোনও কোনও পরিবারে ‘সরিষা ধোওয়া’ রেওয়াজের প্রচলন রয়েছে। এই সরষে দিয়ে কাসুন্দি তৈরি করা শুরু হয়। ক্রমশ কমে এলেও গ্রামবাংলায় এখনও এই ব্রত পালনের রেওয়াজ রয়েছে। স্মার্ত রঘুনন্দন তাঁর ‘স্মৃতি তত্ত্বে’ অক্ষয়ব্রতের চারটি ভাগ করেছেন। অক্ষয়ঘট ব্রত, অক্ষয়সিঁদুর ব্রত, অক্ষয়কুমারী ব্রত এবং অক্ষয়ফল ব্রত। এই ব্রতগুলি চার বছর একটানা পালন করতে হয়। ব্রাহ্মণ থেকে কুমারী, সধবা, সর্বস্তরের মানুষকে জড়িয়ে অক্ষয়তৃতীয়া লৌকিক ধর্মাচরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
সেই পৌরাণিক যুগ থেকে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা যাচ্ছে। বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে ঘটা কিছু তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা একনজরে—
১) এদিনই বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম জন্ম নেন পৃথিবীতে।
২) এদিনই রাজা ভগীরথ গঙ্গা দেবীকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন।
৩) এদিনই গণপতি গনেশ বেদব্যাসের মুখনিঃসৃত বাণী শুনে মহাভারত রচনা শুরু করেন।
৪) এদিনই দেবী অন্নপূর্ণার আবির্ভাব ঘটে।
৫) এদিনই সত্যযুগ শেষ হয়ে ত্রেতাযুগের সূচনা হয়।
৬) এদিনই কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেন। এদিনই কুবেরের লক্ষ্মী লাভ হয়েছিল বলে এদিন বৈভব-লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
৭) এদিনই ভক্তরাজ সুদামা শ্রী কৃষ্ণের সাথে দ্বারকায় গিয়ে দেখা করেন এবং তাঁর থেকে সামান্য চালভাজা নিয়ে শ্রী কৃষ্ণ তাঁর সকল দুখ্হ মোচন করেন।
৮) এদিনই দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে যান এবং সখী কৃষ্ণাকে রক্ষা করেন শ্রীকৃষ্ণ। শরনাগতের পরিত্রাতা রূপে এদিন শ্রী কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন।
৯) এদিন থেকেই পুরীধামে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষ্যে রথ নির্মাণ শুরু হয়।
১০) কেদার বদরী গঙ্গোত্রী যমুনত্রীর যে মন্দির ছয়মাস বন্ধ থাকে এইদিনেই তার দ্বার উদঘাটন হয়। দ্বার খুললেই দেখা যায় সেই অক্ষয়দীপ যা ছয়মাস আগে জ্বালিয়ে আসা হয়েছিল।
১১) এদিনই সত্যযুগের শেষ হয়ে প্রতি কল্পে ত্রেতা যুগ শুরু হয়।
১২) ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চন্দনযাত্রা শুরু হয় এই তিথিতে।
অক্ষয়তৃতীয়ার দিন বাড়িতে সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করা যায় সহজ কিছু উপায়ের মাধ্যমে—
• অক্ষয় তৃতীয়ার দিন সকাল বেলা স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরে যথা সম্ভব কিছু দান করুন। এই দিন দান বা পূণ্য করলে সংসারে অত্যন্ত মঙ্গল হয়।
• এই দিন সোনা, রুপো বা যে কোনও ধাতুর কোনও জিনিস গৃহে ক্রয় করা অত্যন্ত শুভ।
• অক্ষয়তৃতীয়ার দিন রাধাকৃষ্ণের চরণে চন্দনের ফোঁটা দিন।
• এই দিন বিবাহিত মহিলারা সাধ্য মতো কয়েক জনকে আলতা ও সিঁদুর দান করুন।
• অক্ষয়তৃতীয়ার দিন তামার ঘট, নারকেল, সুপারি ও চন্দন কাঠ দান করুন।
• এই দিন সামর্থ মতো কিছু জামা কাপড় দান করুন। এর ফলে অত্যন্ত শুভ ফল ভাল করা যায়।
পরিবারে শুভ শক্তির আগমন ঘটাতে, অশুভকে বিনাশ করতে এবং সুখ সম্বৃদ্ধি বাড়াতে এদিন কী কী করবেন?
১. এদিন সকাল সকাল স্নান সেরে নিন। শুদ্ধ পোশাক গায়ে চাপিয়ে যথা সম্ভব কিছু দান করুন। এতে সংসারের মঙ্গল হয়।
২. গণেশ ও লক্ষ্মীর মূর্তিতে সিদুঁর লাগান।
৩. ঈশ্বরকে ফল মিষ্টি নিবেদন করুন।
৪. বিবাহিত হলে এবং সম্ভব হলে কয়েকজন এয়োতিকে আলতা ও সিঁদুর দান করতে পারেন।
৫. তামার ঘট, নারকেল, সুপারি ও চন্দন কাঠ দান করাও অত্যন্ত শুভ।
৬. সোনা, রুপো কিংবা অন্য কোনও ধাতুর জিনিস কিনতে পারলে খুব ভাল।
৭. জামা-কাপড় কিংবা অন্ন তুলে দিতে পারেন দুস্থদের মুখে। এতে সংসারে শান্তি আসে।
৮. সন্ধেয় আবার হাত-মুখ ধুয়ে গণেশের আরতি করুন।
৯. লোভ সংযত করে ঈশ্বরের আরাধণা করার পর পরিবারে প্রসাদ বিতরণ করুন। এতে মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
অক্ষয় তৃতীয়ার, আজকের দিনে ভুলেও করবেন না এই সকল কাজ, ভিখারি হতে পারেন মা লক্ষ্মীর রোষে
অক্ষয় তৃতীয়া অত্যন্ত মাহেন্দ্র ক্ষণ শাস্ত্রজ্ঞ বিষয়ে নিপুণ পণ্ডিতরা জানাচ্ছেন৷ মা লক্ষ্মী সংসারে বাঁধা পড়েন সেই দিন বিশেষভাবে পুজো করলে৷ তবে মা লক্ষ্মীর রোষ দৃষ্টিও পড়তে পারে এ দিনটিতে কয়েকটি কাজ করলে৷ আর তার ফলে দেখা দিতে পারে অর্থাভাব৷ সাবধান হয়ে যান সেই কারণে৷ সে সম্পর্কে জেনেনিন
১. স্নান না করে তুলসী পাতা ছিড়বেন না অক্ষয় তৃতীয়ার দিন৷ তুলসী পাতা ভীষণ প্রিয় ভগবান বিষ্ণুর, সেই কারণে মা লক্ষ্মী কূপিত হন এমনটা করলে৷ আশপাশ পরিষ্কার রাখুন এ দিন মা লক্ষ্মীর পুজো করার সময়৷ মায়ের পুজো করুন পরিষ্কার বস্ত্র পরে৷
২. উপবাস ভাঙবেন না ব্রত শেষ হওয়ার আগে৷ উপনয়ন সংস্কার করা ঠিক নয় অক্ষয় তৃতীয়ার দিন৷ অশুভ মনে করা হয় এদিন এমন কাজ করাকে৷ এইদিন কেনা যায় নতুন বাড়ি৷ তবে নির্মাণ কাজ করা যায় না নতুন বাড়ি৷
এই জিনিসগুলি রেখে অক্ষয় তৃতীয়ার পূজা করতে পারেন
প্রদীপ: আপনি যদি অক্ষয় তৃতীয়ার দিন সোনার কেনাকাটা করতে সক্ষম না হন তবে কোনও মাটির পাত্র বা প্রদীপ এই দিনটিতে আপনার বাড়িতে আশীর্বাদ আনতে পারে।
নুন: অক্ষয় তৃতীয়ার দিন নুন খাওয়া এড়ানো উচিত। ব্রতী-দের একেবারেই লবণ খাওয়া উচিত নয়। তবে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন বাড়িতে সন্ধক লবণ রাখা শুভ বলে বিবেচিত হয়।
সরিষা: সরিষার ব্যবহার প্রায় প্রতিটি ঘরেই হয়। যদি আপনি এক মুঠো খাঁটি হলুদ সরিষা রাখেন তবে মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ আপনার উপর থাকবে।
ফল: অক্ষয় তৃতীয়ার পুজোর জন্য আপনি যেকোনও ফল আনতে পারেন। মরসুম অনুসারে যেকোনও ফল রাখতে পারেন।
তুলা: অক্ষয় তৃতীয়ায় তুলা রেখেও পুজো করতে পারেন।
অক্ষয় তৃতীয়ার দিন শুধু সোনা কিনলেই যে ঘরে লক্ষ্মী বিরাজ করবেন তা কিন্তু একেবারেই নয়। সোনা ছাড়া আপনি আপনার সাধ্যমত আরও অনেক কিছুই কিনতে পারেন। তাই মা লক্ষ্মীকে সন্তুষ্ট করতে কী কী কিনবেন তা জেনে নিন –
১) বিনিয়োগ করুন কোনও স্কীমে সোনা নয়, অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে আপনার পছন্দ অনুযায়ী কোনও বিশেষ স্কিমে বিনিয়োগ করতে পারেন। নিজের, সন্তানের কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য এই ধরনের প্ল্যানের দিকে মন দিন।
২) গাড়ি যেহেতু এই দিনটি অত্যন্ত শুভ একটি দিন তাই সোনা ছাড়াও এই দিনটিতে কিনতে পারেন আপনার পছন্দসই একটি গাড়ি। গাড়ি প্রেমী ব্যক্তিরা এই দিনে গাড়ি কিনলে ফিরতে পারে আপনার সৌভাগ্য।
৩) বাড়ি এই দিন কিনতে পারেন বাড়ি। বাড়ি কেনার পরিকল্পনা যদি আগেই থেকে থাকে, তবে এই দিনেই কিনে ফেলুন। এতে মা লক্ষ্মী তুষ্ট হবেন এবং ঘরে লক্ষ্মী বিরাজ করবেন। সৌভাগ্য ফিরে আসবে আপনার।
৪) জমি-জায়গা ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য এই শুভ দিনে কোনও জমি বা ছোট্ট জায়গা কিনতে পারেন। এতেও মা লক্ষ্মী তুষ্ট হবেন। ফিরবে আপনার সৌভাগ্য।
৫) ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অক্ষয় তৃতীয়ার দিন বাড়ির কিছু প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র কিনতে পারেন। যেমন – সোফা, ঘর সাজানোর সামগ্রী, টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, বাসনপত্র ইত্যাদি। এতেও মা লক্ষ্মী তুষ্ট হয়ে বিরাজ করবেন আপনার ঘরে।
৬) কাঁচা সবজি সোনা, বাড়ি, গাড়ি কেনার সামর্থ্য অনেকেরই থাকে না। তাই এই শুভক্ষণে নিজের সৌভাগ্য ফেরাতে এবং মা লক্ষ্মী-কে সন্তুষ্ট করতে কিনে আনুন কাঁচা শাক-সবজি। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে, পাতাওয়ালা সবজি আর্থিক সৌভাগ্য ফিরিয়ে আনে।
৭) শস্যদানা এই দিনে গৃহস্থলীর প্রয়োজনীয় শস্যদানা কিনতে পারেন। যেমন – চাল, ডাল, গম, ভুট্টা, বার্লি ইত্যাদি। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে, এগুলি কিনলে ঘরের সৌভাগ্য ফেরে এবং অশুভ প্রভাব-কে দূরে সরিয়ে রাখে।
৮) ঘি হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, এই দিনে বাড়িতে ঘি কিনলে শুভ শক্তির আগমন ঘটে এবং ঘরে লক্ষ্মী বিরাজ করেন। তাই ঘি কিনে লক্ষ্মী পূজার সময় ঘি দিয়ে প্রদীপ জ্বালান। সৌভাগ্য ফিরবে আপনারও।