সৃষ্টির আদিতে রয়েছে শিব। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সর্ব প্রথমে জন্ম হয়েছে ভগবান শিবের। তিনি আদি, অনন্ত ও অসীম। দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দিরে প্রভু শিব জাগ্রত অবস্থায় বিরাজমান। অতি প্রাচীন এই মন্দিরের লোকমত অনুসারে, জনশ্রুতি আছে যে, যেকোনো বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে ভক্তরা এখানে “মানদ” করলে ভক্তদের সকল মনস্কামনা পূর্ণ করেন থাকেন স্বয়ং ভগবান “শিবশম্ভু”। তিনি সবসময়ই ধ্যানরত অবস্থায় থাকেন এবং ধ্যানে তৃতীয় নেত্র দ্বারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডাকে পরিদর্শন করেন। বিশ্বের সকল জীবের দুঃখ-দুর্দশা দূর করেন এবং ভক্তদের সবসময় রক্ষা করে থাকেন। শিবকে “ভোলানাথ” হিসেবেও আমরা সবাই জেনে থাকি। তিনি সহজেই সব ভক্তের অপরাধ ভুলে যান এবং তাদের ক্ষমা করে দেন এজন্যই, তার আরেক নাম “বাবা ভোলানাথ”। প্রভু “শিবের” সাধনা করলে ভক্তরা কখনো খালি হাতে ফিরে যান না তিনি ভক্তদের সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে ভক্তদের কোনো না কোনো বর দিয়ে থাকেন। এটিই চন্দ্রনাথ মন্দিরের ভগবান “শিবের” অপার কৃপা যা ভক্তরা স্বয়ং প্রভু “শিবের” থেকে লাভ করে থাকেন।
পাহাড় পার্শ্ববর্তী এলাকায় আছে ‘ব্যাসকুণ্ড’। যার পাশে বসে মহামুনি ব্যাসদেব এবং অন্যান্য ঋষিগণ অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন।
বিশ্বের সনাতন ধর্মের অনুসারীদের কাছে শিব হলেন ‘পরমসত্ত্বা’। তিনিই ‘পরমেশ্বর’। ‘সৃষ্টি’ করেন ব্রহ্মারূপ ধারণ করে, ‘পালন’ করেন বিষ্ণুরূপ ধারণ করে এবং ‘সংহার’ করেন রুদ্ররূপ ধারণ করে। রাশিচক্রের ষষ্ঠ নক্ষত্র আর্দ্রার অধিপতি হলেন শিব। শিবপুরাণের “শতরুদ্র সংহিতা” (অধ্যায় ৪২/২-৪) অনুসারে, আর্দ্রা নক্ষত্রের রাতে দেবাদিদেব মহাদেব জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন মর্ত্যে। জ্যোতির্লিঙ্গ রূপ ধারণ করে তিনি আজও অবস্থান করছেন ভারতের বারোটি স্থানে। উত্তরাখণ্ডে কেদারনাথ। গুজরাটে সোমনাথ, নাগেশ্বর। মহারাষ্ট্রে ভীমশঙ্কর, ত্র্যম্বকেশ্বর, ঘৃষ্ণেশ্বর। উত্তরপ্রদেশে কাশী বিশ্বনাথ। মধ্যপ্রদেশে মহাকালেশ্বর, ওঙ্কারেশ্বর। ঝাড়খণ্ডে বৈদ্যনাথ। অন্ধ্রপ্রদেশে মল্লিকার্জুন ও তামিলনাড়ুতে রামেশ্বর রূপে।
হিমালয় শিবের আবাসস্থলঃ
দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ ধারণকারী স্থানগুলি ছাড়াও “দেবাদিদেব মহাদেব” বিরাজ করেন উত্তরাখণ্ডের আদি কৈলাস, ওম পর্বত, শিবলিং পর্বত, হিমাচলের কিন্নর কৈলাস, ট্রান্স-হিমালয়ের মাউন্ট কৈলাস বা গাং রিনপোচে পর্বত শৃঙ্গে। তিনি বিরাজ করেন কাশ্মীর হিমালয়ে ‘অমরনাথ’ রূপে। কুলুর পাহাড়ে ‘বিজলি মহাদেব’ রূপে। উত্তরাখণ্ডে রুদ্রনাথ, কল্পেশ্বর, তুঙ্গনাথ, মদমহেশ্বর রূপে। ভুটানের মহাকাল গুহায় ‘মহাকাল’ রূপে। তাই সনাতনধর্মালম্বীরা বিশ্বাস করেন মর্ত্যে দেবাদিদেবের মূল নিবাস হল তুষারমৌলি হিমালয় পর্বতে।
এই হিমালয়েরই পূর্বদিকের একটি অংশ হিমালয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছে। এরপর ভারতের অসম এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে, ফেনী নদী পেরিয়ে চট্টগ্রামের প্রায় সত্তর কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করেছে। ক্রমশ পর্বতমালাটি এগিয়েছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। এই পর্বতমালার বিখ্যাত শৃঙ্গগুলো হল রাজবাড়ি টিলা (৯০০ ফুট), সাজিঢালা( ৮০১ ফুট), নঙ্গরখানা (২৯৮ ফুট) ও বাটালি (২৮০ ফুট)। পর্বতমালাটির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল সীতাকুণ্ড বা চন্দ্রনাথ (১১৫২ফুট)। এই চন্দ্রনাথ পর্বতের চূড়ায় হাজার হাজার বছর ধরে বিরাজ করছেন জাগ্রত শিব ‘চন্দ্রনাথ’। এবং পর্বতের নিচে অবস্থিত জাগ্রত শক্তিপীঠে বিরাজ করছেন ‘মা ভবানী’।
চন্দ্রনাথ পর্বতটিকে নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন পৈরাণিক ইতিহাসঃ
বনবাসে থাকার সময় শ্রীরামচন্দ্র, ভাই লক্ষণ ও স্ত্রী সীতাদেবীকে নিয়ে একদিন শরভঙ্গ মুনির আশ্রমে গিয়েছিলেন। শরভঙ্গ মুনি তাঁদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এক দিব্য ঋষির। সেই ঋষি রামকে বলেছিলেন, রাম স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। রাক্ষসদের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যেই ‘রাম’ হয়ে জন্ম নিয়েছেন। সীতা হলেন দেবী লক্ষ্ণী। ঋষি এরপর শ্রীরামচন্দ্রকে বলেছিলেন, পূর্বদিকে চন্দ্রশেখর পর্বতে বিরাজ করছেন জাগ্রত ‘চন্দ্রনাথ’ শিব। তিনি রামচন্দ্রদের সেই স্থানে নিয়ে যেতে চান।
দিব্য ঋষির সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্র, লক্ষণ ও সীতা এসেছিলেন ‘চন্দ্রশেখর’ (বর্তমানের সীতাকুণ্ড বা চন্দ্রনাথ) পর্বতে। সেই যুগে ‘চন্দ্রশেখর’ পর্বতের নিচে ছিল মহামুনি ভার্গবের আশ্রম। চন্দ্রনাথ পর্বতে এসে মহামুনি ভার্গবের আশ্রমে গিয়েছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। তিনি যখন কথা বলছিলেন ভার্গব মুনির সাথে, মা সীতা সেই সময় একাকী স্নান করতে গিয়েছিলেন। শ্রীরামচন্দ্রের আগমনবার্তা পেয়ে তাঁদের স্নানের জন্য মহামুনি ভার্গব নিজের হাতে তিনটি কুণ্ড খনন করে রেখেছিলেন। তারই একটিতে স্নান করতে গিয়েছিলেন সীতা মা।
কুণ্ডের জলে ডুব দেওয়ার সাথে সাথে মা সীতার রূপ পালটে গিয়েছিল। নরকলেবর ত্যাগ করে মা সীতা ত্রিনেত্র ধারিনী, মেঘবর্ণা, অষ্টাদশভুজা রূপ ধারণ করেছিলেন। সীতা দেবীকে আশপাশে দেখতে না পেয়ে, শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছিলেন কুণ্ডটির কাছে। কুণ্ডে এসে মা সীতার কৃষ্ণকায়া ও ভীষণা রূপ দেখে শ্রীরামচন্দ্র কুণ্ডকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কলিযুগে চার হাজার বছর অবস্থান করার পর, অদৃশ্য হয়ে যাবে এই মায়াবী কুণ্ড। এরপর মা সীতা পুনরায় নরকলেবর রুপ ধারণ করেছিলেন। ভাই লক্ষণ ও সীতাদেবীকে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রনাথ শিব দর্শন করতে গিয়েছিলেন শ্রীরামচন্দ্র।
যে কুণ্ডে স্নান করেছিলেন মা সীতা, শ্রীরামচন্দ্রের অভিশাপে বর্তমানে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। তবে পৌরানিক যুগেই কুণ্ডটির নাম হয়ে গিয়েছিল সীতাকুণ্ড। আজ সেই কুণ্ডটির নাম থেকেই পাহাড়, এমনকি উপজেলাটিরও নাম সীতাকুণ্ড। যদিও সীতাকুণ্ড পাহাড়টি আজ ‘চন্দ্রনাথ’ পাহাড় নামেই বেশি পরিচিত। পাহাড়ের নিচে আছে সীতা মন্দির। মন্দিরে আছে দেবী সীতার মূর্তি। এছাড়াও চন্দ্রনাথ পাহাড়ে এসেছিলেন মহামুনি ব্যাসদেব। পাহাড় পার্শ্ববর্তী এলাকায় আছে ‘ব্যাসকুণ্ড’। যার পাশে বসে মহামুনি ব্যাসদেব এবং অন্যান্য ঋষিগণ অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন।
পাহাড়চূড়ায় যিনি নির্মাণ করেছিলেন মন্দিরঃ
’চন্দ্রনাথ’ পাহাড়ে ‘চন্দ্রনাথ’ শিবমন্দিরটি কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। নেপালের প্রাচীন পুঁথি ‘গোপালরাজ আলোক ‘ভামশাভালি’ থেকে জানা যায়, নেপালের ‘লিচ্ছবি’ রাজবংশের রাজা প্রচণ্ডদেবের স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন মহাদেব। তিনি রাজাকে পাঁচকোণে পাঁচটি শিবমন্দির নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। মহাদেবের স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাজা প্রচণ্ডদেব তাঁর সভার শাস্ত্রজ্ঞদের থেকে মতামত নিয়ে, পাঁচটি পবিত্রস্থানে পাঁচটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সেগুলি হলো নেপালের পশুপতিনাথ, কাশীর বিশ্বনাথ, পাকিস্তানের ভুতনাথ, মহেশখালীর আদিনাথ এবং সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির। কিন্তু অন্য আর একটি মত অনুসারে, চন্দ্রনাথ মন্দির এবং পার্শ্ববর্তী বিরুপাক্ষ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চট্টগ্রামেরই পরৈকোড়ার জমিদার নারায়ণ লালা। কিন্তু এই মতটি নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। পুরাণের কথা ধরলে ও সময়কাল বিচার বিবেচনা করলে, জমিদার নারায়ণ লালার সময়কালের বহু সহস্র বছর আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শিবের ‘চন্দ্রনাথ’ মন্দির।
সীতাকুন্ড বাজার থেকে ৪ কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত চন্দ্রনাথ পাহাড়ঃ
অটোরিক্সা স্ট্যান্ডের কাছেই আছে ‘চন্দ্রনাথ’ পর্বত এলাকায় প্রবেশের প্রথম দরজা। এরপর ইটের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে, আসবে পাহাড়ের নিচেরস্থল। সেখানে রাস্তাটি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। বাম দিক দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে পাহাড়চূড়ায় পৌঁছনোর ট্রেকিং রুট। পর্যটক ও ট্রেকাররা যান সেই পথে। তীর্থযাত্রীরা ও পথ ধরেন না। কারণ সে পথে কোনও মন্দির নেই। তাই তীর্থযাত্রীরা ধরেন ডানদিকের পথ।
ডানদিকের পথটির শুরুতে আছে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার মূল দরজা। যেটির ওপর লেখা আছে,“মহাপীঠ অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভবানী ও পীঠ অধিষ্ঠাতা চন্দ্রশেখর ভৈরব শ্রী শ্রী ক্রমদীশ্বর স্বয়ম্ভুনাথ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমিই একমাত্র ক্রমদীশ্বর। চন্দ্রনাথ পর্বতে আমি অষ্টশক্তি, অষ্টমূর্তি সহিত স্বয়ং আবির্ভূত, তাই শ্রী শ্রী ক্রমদীশ্বর স্বয়ম্ভুনাথ (স্বয়ম্ভুলিঙ্গ)।”
দরজাটির পিছনে, ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে সিঁড়িপথ। পৌঁছে গিয়েছে পাহাড়চূড়ার চন্দ্রনাথ মন্দির পর্যন্ত। এই পথ ট্রেকিং রুটটির চেয়ে অনেক কঠিন। প্রায় ২২০০ সিঁড়ি ভাঙতে হয় চন্দ্রনাথ মন্দিরে পৌঁছনোর জন্য। তোরণের সামনের দোকান থেকে তীর্থযাত্রীরা কুড়ি টাকার বিনিময়ে কিনে নেন বাঁশের লাঠি। তার পর “জয় বাবা চন্দ্রনাথ”, “জয় মা ভবানী”, “জয় বাবা চন্দ্রশেখর” ধ্বনি তুলে সিঁড়ি ভেঙে এগিয়ে চলেন পাহাড়ি পথে।
প্রাচীনকালে চন্দ্রনাথ মন্দিরে পৌঁছনোর জন্য কোনও সিঁড়ি ছিল নাঃ
বিপজ্জনক পথে, প্রায় প্রাণ হাতে নিয়ে আরোহণ করতে হতো। ঘটত অনেক দুর্ঘটনা। পরবর্তীকালে তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে সিঁড়ি প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন অসংখ্য সহৃদয় মানুষ। প্রথম উদ্দ্যোগটি নিয়েছিলেন অবিভক্ত চব্বিশ পরগণার গঙ্গারাম বিশ্বাস। তিনি তাঁর মাকে নিয়ে চন্দ্রনাথ ধামে এসেছিলেন। কিন্তু দুর্গমপথ দিয়ে তাঁর মা চন্দ্রনাথ মন্দিরে পৌঁছতে পারেননি। রেগে মা পুত্র গঙ্গারামকে বলেছিলেন, পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছবার জন্য সিঁড়ি তৈরি করে দিতে। মায়ের নির্দেশ মেনে ১৮৫৩ সাল নাগাদ ৭৮২টি সিঁড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন মাতৃভক্ত গঙ্গারাম।
কালের ছোবলে সিঁড়িগুলি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ১৯২২ সালে সিঁড়িগুলির সংস্কার করেছিলেন, চব্বিশ পরগনার জমিদার সূর্যকান্ত রায়চৌধুরী। পরবর্তীকালে অসংখ্য মানুষ সিঁড়ি নির্মাণে অর্থ দান করেছিলেন। তাই অধিকাংশ সিঁড়ির গায়ে আজও খোদাই করা আছে অর্থদাতাদের নাম। সিঁড়িগুলির নির্মাণের ফলে তীর্থযাত্রীরা পৌঁছতে পারেন চন্দ্রনাথ মন্দিরে। তবুও সিঁড়িপথে চন্দ্রনাথ মন্দিরে পৌঁছনো প্রচণ্ড কষ্টকর। কারণ সিড়ির ধাপগুলো প্রায় দেড়ফুট ফুট উঁচু।
তথ্য সূত্রঃ উইকোপিডিয়া
আরো আপডেট পেতে
#চন্দ্রনাথ #সীতাকুণ্ড #মন্দির
Bangla Panjika 2023 Paji 1430 Download করুন
For Bangla Calendar, Bangla Panjika, Bengali Calendar, Horoscope download Bangla Panjika 2023 Paji 1430