অতি প্রাচীন জাগ্রত শিব “চন্দ্রনাথ” ও “দেবী ভবানী” মন্দিরের রহস্য ও ইতিহাস! চলুন জেনে নেই। পর্বঃ ২

 

জাগ্রত শক্তিপীঠ মন্দিরে ‘মা’ ভবানীঃ
ঘন বনের বুক চিরে পাহাড়ের উপরের দিকে উঠে গিয়েছে আঁকাবাকা পথ। নিচ থেকে কিছুটা ওপরে আছে জাগ্রত শক্তিপীঠ ‘ভবানী মন্দির’। সবুজে ঘেরা মনোরম নৈসর্গিক পরিবেশে মধ্যে অবস্থিত গোলাপি রঙের অতি সাধারণ একটি মন্দির। মন্দিরের ভেতরে শ্বেতপাথরের সিংহাসনে বিরাজ করছেন জাগ্রত দেবী ‘মা ভবানী’ ও তাঁর ভৈরব ‘চন্দ্র‌শেখর’। পীঠনির্ণয় তন্ত্রমতে দেবীর চৌদ্দতম পীঠ হল ‘ভবানী শক্তিপীঠ’। এই পীঠে সতীর দক্ষিণ হস্ত বা ডান হাত পতিত হয়েছিল।

পীঠনির্ণয়তন্ত্রে তাই বলা হয়েছে, “চট্টলে দক্ষবাহুর্মে ভৈরব চন্দ্রশেখরঃ ব্যক্ত রূপা ভগবতী ভবানী যত্র দেবতা। এই শক্তিপীঠের উল্লেখ পাওয়া যায় মঙ্গলকাব্যের সর্বশেষ শক্তিমান কবি, অন্নদামঙ্গলের স্রষ্টা ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের লেখাতেও। তিনি লিখেছিলেন,” চট্টগ্রামে ডানহস্ত অর্ধঅনুভব, ভবানী দেবতা চন্দ্রশেখর ভৈরব ।।” সারাবছর ধরেই দেশ বিদেশ থেকে ভক্তেরা আসেন সতী মায়ের কাছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন সতী মায়ের কাছে কোনও কিছুর জন্য প্রার্থনা করলে, মা তা পূরণ করেন। মন্দিরটির উচ্চতা বেশি না থাকায় বয়স্ক মানুষ, যাঁরা পাহাড়ের শীর্ষে চন্দ্রনাথ মন্দিরে যেতে পারেন না, তাঁরা সতী মাকে দর্শন করে পাহাড় থেকে নেমে আসেন।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ের আরও কিছুটা ওপরে আছে স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির। ষোড়শ শতাব্দীতে চট্টগ্রামের পরৈকোড়ার জমিদার ধনমানিক্য বাহাদুর, মুক্তাগাছার জমিদার বিদ্যাময়ী দেবী ও আরও কয়েকজনের অর্থের দানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির। দু্‌ই হাজারের বেশি সিঁড়ি পেরিয়ে চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাওয়া যাদের পক্ষে সম্ভব হয় না, তাঁরা স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরে মহাদেবকে পুজো দিয়ে ফিরে আসেন।

 

দুর্গম পথ পেরিয়ে চলে আরও ওপরেঃ
প্রথমদিকে তেমন কষ্ট না হলেও, ক্রমশ মইয়ের মতো খাড়া পথ ধরে উঠতে থাকবে সিঁড়ি। কোনও কোনও জায়গায় পথ এতটাই সরু, দু’জন মানুষ একসাথে পাশাপাশি ওঠানামা করতে পারেন না। এর ওপর একপাশে পাহাড় অন্যপাশে গভীর খাদ। একটু এদিক ওদিক হলেই পড়তে হবে তিনশো চারশো ফুট নীচে। তাই স্থানীয় মানুষরা তীর্থযাত্রীদের বারে বারে বলেন, ঘণ্টা তিনেক সময় হাতে নিয়ে ধীরে সুস্থে উঠতে।

 

 

পথে কোনও কোনও জায়গায় আছে বসবার বেঞ্চ। সিমেটের ও বাঁশ দিয়ে তৈরি। আছে টুকিটাকি খাবার, ফল, জল ও পুজোর উপকরণের দোকান। সবকিছুর দাম স্বাভাবিকের প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি এত উচ্চতায় হাতের কাছেই পাচ্ছেন, সাথে করে বইতে হচ্ছে না, এটাই বা কম কি। তাই বেশি দাম দিতে কৃপণতা করেন না তীর্থযাত্রীরা।
পথে যেতে যেতে তীর্থযাত্রীদের কানে ভেসে আসবে পাখির ডাক। চোখে পড়বে একগাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে যাওয়া বানরের পাল। এইভাবে প্রায় দেড় দুঘণ্টা যাওয়ার পর দেখা দেবে চন্দ্রনাথ পর্বতের দুটি চূড়া। দুটি চূড়াতেই আছে দুটি মন্দির। কাছাকাছি মনে হলেও, দুটি মন্দিরের মধ্যে দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। বামদিকের চূড়ায় আছে ‘বিরুপাক্ষ’ মন্দির। যে মন্দিরে পুজো দিতে আসেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও। ডানদিকে, আরও ওপরে থাকা চূড়াটিই চন্দ্রনাথ পর্বতের শীর্ষস্থান। সেখানেই আছে বিখ্যাত চন্দ্রনাথ মন্দির। যার টানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চন্দ্রনাথধামে ছুটে আসছেন দেশবিদেশের মানুষ।

 

প্রথমে দর্শন দেন ‘বিরুপাক্ষ’ শিবঃ
তীর্থযাত্রীরা প্রথমে এগিয়ে যান বিরুপাক্ষ মন্দিরের দিকে। শীর্ষটির ওপরে সামান্য সমান স্থানে অবস্থিত এই সুপ্রাচীন বিরুপাক্ষ মন্দির। মন্দিরের ভেতরে বিরাজ করছেন জাগ্রত শিব ‘বিরুপাক্ষ’। তীর্থযাত্রীরা যে যার সাধ্যমতো পূজা দেন। কয়েকঘণ্টা ধরে চড়াই ভাঙার পরিশ্রমে ক্লান্ত তীর্থযাত্রীরা বিশ্রামও নেন বিরুপাক্ষ মন্দির প্রাঙ্গণে। তবে চারপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য নিমেষেই ভুলিয়ে দেয় সমস্ত ক্লান্তি। মন্দিরের তিনদিকে নেমে গিয়েছে গভীর পাহাড়ি খাদ। পশ্চিমদিকে তাকালে, দৃষ্টি চলে যাবে সীতাকুণ্ড বাজার পেরিয়ে আরও অনেক দূরে। যেখানে চট্টগ্রামের সবুজ বনানীকে গভীর কোলাকুলিতে আবদ্ধ করেছে ঘন নীল বঙ্গোপসাগর।

জয় বাবা চন্দ্রনাথঃ
আধঘণ্টার মতো বিশ্রাম নিয়ে তীর্থযাত্রীরা ধরেন পূর্বদিকে চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাওয়ার পথ। বিরুপাক্ষ মন্দির থেকে চন্দ্রনাথ মন্দির পর্যন্ত পথে সিঁড়ি তৈরি করে দিয়েছিলেন গোপাল চন্দ্র সাহা ও মধুসূধন সাহা নামের দুই ভাই। কিন্তু সিঁড়িগুলি খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। অত্যন্ত সংকীর্ণ এই পথকে ঘিরে আছে লম্বা লম্বা ঘাস ও ঝোপঝাড়। খুব সাবধানে এই পথটুকু পার হন তীর্থযাত্রীরা।

 

 

এক সময় অবসান হয় সব কষ্টের, সব প্রতীক্ষার। ‘জয় বাবা চন্দ্রনাথ’ ধ্বনি তুলে তীর্থযাত্রীরা পৌঁছে যান চন্দ্রনাথ মন্দির আঙ্গিনায়। তাঁদের ক্লান্ত শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবুজ উপত্যকা দাপিয়ে বেড়ানো মাতাল হাওয়া। বাবার আশীর্বাদে মুহূর্তের মধ্যে দূর হয়ে যায় সকল ক্লান্তি। দ্বিধান্বিত আনন্দে পুলকিত হয় দেহমন। সামনেই সেই মন্দির।যে মন্দিরের ভেতরে ছোট্ট একটি কুণ্ডে ‘লিঙ্গ’ রূপ ধারণ করে বিরাজ করেছেন ‘শ্রী শ্রী চন্দ্রনাথ’ শিব। আবেগ বিভ্রান্ত ভক্তেরা মন্দিরের দালানে শুয়ে পড়ে ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন ‘চন্দ্রনাথ’ শিবকে। দুধ ও ডাবের জল দিয়ে শিবকে স্নান করান। যথাযথভাবে পূজা দেন।

প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী বা শিব চতুর্দশী তিথিতে ‘শ্রীশ্রী শিবরাত্রি ব্রত’ উপলক্ষ্যে চন্দ্রনাথধামে বসে বিরাট মেলা। চন্দ্রনাথ মন্দিরে হয় চন্দ্রনাথের বিশেষ পূজা। সে সময় প্রায় দশ লক্ষ মানুষের সমাগম হয় চন্দ্রনাথধামে। তীর্থযাত্রীরা আসেন ভারত, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার এমনকি শ্রীলঙ্কা থেকেও। মূল মেলাটি তিনদিন ধরে চললেও, মেলার রেশ থাকে দোল পূর্ণিমা পর্যন্ত।
চন্দ্রনাথ মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে তীর্থযাত্রীরা ঘন সবুজ উপত্যকার অপরূপ দৃশ্যাবলী উপভোগ করেন। বেশ কিছুক্ষণের জন্য তাঁদের সম্মোহিত করে রাখে, নীচে রেখে আসা জনপদগুলি, রেললাইন, হাইওয়ে, সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক, জুমচাষের রঙবেরঙের ক্ষেত, ছোট বড় হ্রদ, অসংখ্য ছোট ছোট টিলা ও হাতছানি দেওয়া সাগর। উপত্যকার আকাশে ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতটাই সুন্দর মনোরম, মনে হয় কোনও চিত্রশিল্পী বুঝি তাঁর তুলির আঁচড়ে এইসব দৃশ্যাবলী ফুটিয়ে তুলেছেন প্রকৃতির ক্যানভাসে।

 

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে রহস্যময়ী দেবী উল্টাকালীঃ
সীতাকুণ্ড পাহাড়ের পরতে পরতে আছে রহস্য। চন্দ্রনাথ মন্দিরের পিছন দিক থেকে অত্যন্ত সরু একটি পাকদণ্ডি পথ নেমে গিয়েছে পাহাড়ের সবচেয়ে দুরারোহ স্থানে। পথের পাশেই বিশাল খাদ। পা পিছলে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। এই পথে পার হতে হয় পাহাড়ি ঝর্না। ভয়ঙ্কর ও রোমাঞ্চকর পথের শেষে, গা ছমছম করা পরিবেশে বিরাজ করেন মা ‘পাতালকালী’।একটি প্রকাণ্ড কালো পাথরের গায়ে উল্টোভাবে খোদাই করা আছে দেবী কালিকার মূর্তি। তাই দেবীর নাম ‘উল্টাকালী’।
কীভাবে এই পাথরটি এখানে এসেছিল, কেনই বা কালীমুর্তিটিকে উল্টোভাবে পাথরের গায়ে খোদাই করা হয়েছিল, তার উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। সনাতন ধর্মানুসারীদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র এই স্থানটি। তবুও উল্টাকালীর কাছে আসেন না বেশিরভাগ তীর্থযাত্রীই। কারণ দুরারোহ ও ভয়াবহ এই পাহাড়ি পথ সবার জন্য নয়। এ ছাড়াও এই এলাকায় ডাকাতেরও উপদ্রব আছে।

তাই চন্দ্রনাথ ধামে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী এলেও পাতালকালীর দর্শন করার সৌভাগ্য বেশিরভাগ তীর্থযাত্রীরই হয় না। তাই সীতাকুণ্ড পাহাড়ের এই অংশটি আজও প্রায় অমীমাংসিত থেকে গেছে। তবে কালীপুজোর দিন ‘উল্টাকালী’ স্থানে জাঁক জমক করে মায়ের পূজা করা হয়। সেদিন প্রচুর তীর্থযাত্রী যান ‘উল্টাকালী’ কে দর্শন করতে।

 

চন্দ্রনাথ ধামে এসেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দঃ
চন্দ্রনাথ মন্দির থেকে নামার সময় ডান দিকের সিঁড়িপথ ধরে নীচে নেমে আসেন তীর্থযাত্রীরা। নেমে আসেন এক অব্যক্ত অনুভূতি নিয়ে। যে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তাই তো চন্দ্রনাথকে নিজের চোখে দেখার বাসনা নিয়ে ১৯০১ সালের এপ্রিল মাসে চন্দ্রনাথ ধামে এসেছিলেন বীর সন্ন্যাসী “স্বামী বিবেকানন্দ”।

কামাখ্যা যাওয়ার পথে চন্দ্রনাথে এসেও, মা খুড়িমা ও বোনকে চন্দ্রনাথ মন্দির দর্শন করাতে পারেননি স্বামীজী। ঘন জঙ্গল ও দূরারোহ পথের জন্য। তাই পাহাড়ের নিচে পঞ্চবট স্থাপন করে, সেখানেই করেছিলেন মহাদেবের পূজা। আজও আছে স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতি বিজড়িত ‘পঞ্চবটি’। সীতাকুণ্ডের শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম স্থানটিকে সংরক্ষণ করে রেখেছে। রহস্যময় শৈবতীর্থ চন্দ্রনাথের আকর্ষণ তাই অনিবার্য। উত্তরোত্তর জমায়েত বাড়ছে চন্দ্রনাথে। আকুল হয়ে বাবাকে দর্শন করতে ছুটে আসছেন লক্ষ লক্ষ ভক্ত। অনেকের ইচ্ছা থাকলেও আসতে পারেন না চন্দ্রনাথ ধামে। স্থানীয় মানুষরা বলেন, কেউ যদি ‘চন্দ্রনাথ’ ধামে আসতে নাও পারেন, ‘চন্দ্রনাথ’ ধামের কথা শ্রবণ বা পাঠ করলেও ‘চন্দ্রনাথ’ দর্শনের সমান পুণ্য হয়।

 

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া

#চন্দ্রনাথ #সীতাকুণ্ড #মন্দির

আরো আপডেট পেতে

Bangla Panjika 2023 Paji 1430 Download করুন

For Bangla Calendar, Bangla Panjika, Bengali Calendar, Horoscope download Bangla Panjika 2023 Paji 1430

 

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.