নীলষষ্ঠী বা নীল পুজো তথা নীলের উদ্দেশ্যে বাতিদান হল বাংলার হিন্দুসমাজের এক লৌকিক উৎসব। বঙ্গের মায়েরা তাদের সন্তান সন্ততির মঙ্গলের জন্য এই ব্রত করেন। চৈত্র মাস ভগবান শিবের পূজার মাস। কারণ চৈত্র মাসের সাথে ভগবান শিবের সাদৃশ্য আছে। চৈত্র মাসে বসন্তের অনুপম সুন্দর প্রকৃতি দেখা যায়। আবার দেখা যায় কালবৈশাখীর উন্মত্ত তাণ্ডব। ভগবান শিব শান্ত অবস্থায় আশুতোষ- ভক্তের মনোরথ শীঘ্রই পূর্ণ করেন। আবার ক্ষিপ্ত হলে তখন তিনি রুদ্র, নটরাজ। নৃত্য তাণ্ডবে ব্রহ্মাণ্ড লয় হয়। ভগবান শিবের এক নাম নীলকণ্ঠ। সমুদ্র মন্থনে উত্থিত বিষ পান করে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। সেই থেকে দেবাদিদেবের কণ্ঠ হল নীল। আর দেবাদিদেব মহাদেব প্রসিদ্ধ হলেন “নীলকণ্ঠ” নামে। এই সময় মাটি দিয়ে শোয়ানো অবস্থায় একটি দেব মূর্তি তৈরী করা হয়। যে মূর্তিকে শিবের মূর্তি বলা হয়। এটি অনেকটাই অমসৃণ থাকে। ঠিক শিবের আদল বোঝা যায় না। নরম মাটি দিয়ে তৈরী এই মূর্তির গায়ে খেজুর দিয়ে আবরণ দেওয়া হয়। চারি পাশে খেজুর পাতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। নীলকণ্ঠ বা নীল হল মহাদেব শিবের অপর নাম। নীলসন্ন্যাসীরা ও শিব-দুর্গার সঙেরা পূজার সময়ে নীলকে সুসজ্জিত করে গীতিবাদ্য সহযোগে বাড়ি বাড়ি ঘোরান এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। নীলের গানকে বলা হয় অষ্টক গান। কোথাও কোথাও মাটির মূর্তির বদলে একটি মাটির ঢিবি তৈরী করা হয়। এর পর ফুল-বেল পাতা দিয়ে শুরু হয় নীল পুজো। একই সঙ্গে চলে বালা গান। এই দিন বাড়ির মহিলারা সারাদিন ধরে উপোস করে থাকেন। বিকেলে পুজো দিয়ে তবেই কিছু মুখে দেন তাঁরা। সাধারণত পরিবারের সকলের স্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনার্থে নীলের উপবাস করে থাকেন।
আবার নীল ষষ্ঠীর দিনে সন্তানবতী হিন্দু নারীরা সারাদিন উপবাস রেখে সন্তানের আয়ু বৃদ্ধির কামনায় ‘নীল ষষ্ঠী’র ব্রত করে। সারা চৈত্রমাস শিব পূজো করে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন উপোবাস করে সন্ধ্যায় শিবের মন্দিরে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে মা ষষ্ঠীকে প্রার্থনা জানাতে হয়। নীলপূজার পর সন্ধ্যাবেলায় শিবমন্দিরে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে জলগ্রহণ করে।প্রচলিত ধারণা হল- নীলের ব্রত নিষ্ঠামতো পালন করলে কোনওদিন সন্তানের অমঙ্গল হয় না। তবে এই নীল পুজোর সঙ্গে ‘ষষ্ঠী’ নামটি কেন জুড়ে দেওয়া হল? সন্তানের মঙ্গল কামনায় বা সন্তান লাভের জন্য মা ষষ্ঠীর পুজো করা হয়। তবে পয়লা বৈশাখের আগে যে ‘নীল ষষ্ঠী’ পালন করা হয়, তখন কিন্তু পঞ্জিকায় ষষ্ঠী তিথি থাকেনা। অশোক ষষ্ঠী, লোচন ষষ্ঠী, জামাইষষ্ঠীর মতন এটি কোন ষষ্ঠী নয়। লোককথা থেকে জানা যায়, এই সময় ঋতু পরিবর্তন হয় তাই ভগবানের থানে গিয়ে সন্তানের মায়েরা তাদের সন্তান যেন সুস্থ থাকে এমন কথা জানান। তাই বোধহয় শিব, পার্বতীর বিয়ের দিন এর সঙ্গে ‘ষষ্ঠী’ কথাটা এমন ভাবে জুড়ে গেছে।
এদিকে নীল বা শিবের সাথে নীলচণ্ডিকা বা নীলাবতী পরমেশ্বরীর বিয়ে উপলক্ষ্যে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান সংঘটিত হয়। ভিন্ন কাহিনি অনুসারে, দক্ষযজ্ঞে দেহত্যাগের পর শিবজায়া সতী পুনরায় সুন্দরী কন্যারূপে নীলধ্বজ রাজার বিল্ববনে আবির্ভূত হন। রাজা তাঁকে নিজ কন্যারূপে লালন-পালন করে শিবের সাথে বিয়ে দেন। বাসর ঘরে নীলাবতী শিবকে মোহিত করেন এবং পরে মক্ষিপারূপ ধরে ফুলের সঙ্গে জলে নিক্ষিপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন; রাজা-রাণীও শোকে প্রাণবিসর্জন দেন। নীলপূজা শিব ও নীলাবতীরই বিবাহ-অনুষ্ঠানের স্মারক।
নিম বা বেল কাঠ থেকে নীলের মূর্তি তৈরি হয়। চৈত্রসংক্রান্তির বেশ আগেই নীলকে মণ্ডপ থেকে নীচে নামানো হয়। নীলপূজার আগের দিন অধিবাস; অধিক রাত্রে হয় হাজরা পূজা অর্থাৎ বিয়ে উপলক্ষে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা। হাজরা পূজায় শিবের চেলা বা ভূত-প্রেতের দেবতাকে পোড়া শোল মাছের ভোগ দেওয়া হয়। পরদিন নীলপূজার সময় নীলকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন লালশালু কাপড় পরিয়ে অন্ততপক্ষে সাতটি বাড়িতে নীলকে ঘোরানো হয়।
নীলসন্ন্যাসীরা একইরকম লাল কাপড় পরে পাগড়ি মাথায়, গলায় রুদ্রাক্ষমালা ও হাতে ত্রিশূল নিয়ে নীলকে সঙ্গে করে এই মিছিল করেন। এদের দলপতিকে বলা হয় বালা। সাথে থাকে ঢাক-ঢোল, বাঁশী বাজনদারের দল এবং কাল্পনিক শিব-দুর্গার সাজে সঙেরা। গৃহস্থ মহিলারা উঠানে আল্পনা দিয়ে নীলকে আহ্বান করে বরাসনে বসিয়ে তাঁর মাথায় তেলসিঁদুর পরিয়ে দেন।
এরপর নীলের গান শুরু হয়৷ এই সব গানে থাকে সংসারী হর-পার্বতীর কথা, শিবের কৃষিকাজ, গৌরীর শাঁখা পরা প্রভৃতি এবং ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণা শিবানীর দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের কাহিনি। গানের প্রথম অংশ দলপতি বালারা এবং পরবর্তী অংশ অন্য নীলসন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন।গানের শেষে গৃহস্থরা সন্ন্যাসীদের চাল-পয়সা, ফল প্রভৃতি ভিক্ষাস্বরূপ দেয় |
নীল পূজার কাহিনীঃ এক বামুন আর বামনীর পাঁচছেলে আর দুটি মেয়ে। তারা খুব পুজোআচ্চা করত। কিন্তু এত পুজো, বারব্রত করেও তাদের সব ছেলেমেয়েগুলো একে একে মরে গেল। তখন বামনীর ঠাকুরদেবতায় বিশ্বাস চলে গেল। তাদের আর সেই জায়গায় থাকতেও ভালো লাগল না। বামুন-বামনী ঠিক করল সব ছেড়েছুড়ে তারা মনের দুঃখে কাশীবাসী হবে। দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নান করে অন্নপূর্ণার পুজো করে মণিকর্ণিকার ঘাটে বসে আছে, এমন সময় মা-ষষ্ঠী এক বুড়ি বামনীর বেশে এসে বললে ” কি ভাবছ গো মা?” বামনী বললে “আমার সব ছেলেমেয়েদের হারিয়েছি। এত পুজোআচ্চা সব বিফলে গেল আমাদের। সব অদৃষ্ট। ঠাকুর দেবতা বলে কিছ্ছু নেই। ” ষষ্ঠীবুড়ি বললেন “বারব্রত নিষ্ফল হয়না মা, ধর্মকর্ম যাই কর ঈশ্বরে বিশ্বাস চাই। তুমি মা-ষষ্ঠীকে মানো? তাঁর পুজো করেছ কখনো? তিনি সন্তানদের পালন করেন। বামনী বললে “আমি এযাবতকাল সব ষষ্ঠী করে আসছি কিন্তু তবুও আমার ছেলেরা রইল না। ষষ্ঠীবুড়ি বললেন, “তুমি নীলষষ্ঠীর পুজো করেছ কখনো? চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন উপোস করে শিবের পুজো করবে। শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে জল খাবে। সন্তানদের মঙ্গলকামনা করবে” বামনী সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে পুনরায় মাতৃত্ব লাভ করলে।
নীল ষষ্ঠী করার পদ্ধতিঃ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত উপবাস করা হয়। দুধ, গঙ্গাজল, মধু, নারকেল জল ঢালা হয় শিবলিঙ্গে। শিবের অন্য পূজার মতো এতেও থাকে আকন্দ ফুল ও বিল্ব পত্র। আর এই পুজোর জন্য উৎসর্গীকৃত পাঁচটি ফলের মধ্যে একটি ফল কে বেল হতেই হবে।
মা ষষ্ঠী যেনো আমাদের সমগ্র মানব জাতিকেই কথাগুলি বললেন। দম্ভ, অহঙ্কার নিয়ে পূজা করলে তা বৃথাই যায়। কারণ ভগবান দর্প চূর্ণ করেন। আর দর্প নিয়ে ঈশ্বর কৃপা পাওয়া যায় না। দেবী এরপর বামন বামনীকে উপদেশ দিয়ে নীল ষষ্ঠী ব্রত করতে বললেন। দেবী নিজেই ব্রতের সব নিয়ম বলে দিলেন। গৃহে ফিরে এবার উদার মনে বামনী নীল ষষ্ঠী ব্রত করলেন। এবার থেকে বামনীর যতগুলি সন্তান সন্ততি হল- তারা দীর্ঘায়ু হল। আসলে এসব ঘটনার মাধ্যমে শাস্ত্রকারেরা আমাদের মানব জাতিকে বিভিন্ন পথ দেখিয়েছেন। দম্ভ নিয়ে পূজা হয় না। দম্ভ থাকলে আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় না।
ভগবান শিবের পূজা করা উচিৎ। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে লেখা আছে- “যাহারা শিব পার্বতীর পূজা না করে ভোজন করে- তাদের মুখ দর্শন নিষিদ্ধ”। ঐ পুরাণেই লেখা ভগবান শিব অষ্টদিকেই বিরাজ করেন। যথা-
পূর্ব্বস্যাং দিশি বৈ শম্ভোঃ ক্ষিতিমূর্ত্তির্দ্বিজর্ষভ।
দক্ষিনস্যাৎ বহ্নিমূর্ত্তির্নভোমমূর্ত্তিস্ত পশ্চিমে।।
উত্তরে সোমসূত্রঞ্চ সোমমূর্ত্তিঃ প্রকীর্ত্তিতা।
জলাগ্নিযজমানার্কা অগ্নিনৈর্ঋতকাদিষু।।
সর্ব্বো ভবো রুদ্র উগ্রো ভীমনামা পশোঃপতিঃ।
মহাদেবস্তথেশানঃ পূর্ব্বাগ্ন্যাদিষু সংজ্ঞিতাঃ।।
মধ্যে শিবশ্চ সম্পূজ্যো বেদ্যাং শক্তিশ্চ পূজ্যতে।
ততো জপ্ত্বা নৃত্যগীতবাদ্যৈঃ স্তুত্বা প্রণম্য চ।।
(বৃহদ্ধর্ম পুরাণ/ মধ্যখণ্ড/ সপ্তবিংশো অধ্যায়/ ৬৬-৬৯)
অর্থাৎ- পূর্বদিকে মহাদেবের ক্ষিতি মূর্তি বিরাজ করিতেছেন। দক্ষিণ দিকে অগ্নিময়ীমূর্তি, পশ্চিমে ব্যোমমূর্তি , উত্তরদিকে সোমসূত্র ও সোমমূর্তি বিরাজিত আছেন। আর অগ্নি ও নৈর্ঋত, বায়ু ও ঈশান কোনে যথাক্রমে জল, অগ্নি, যজমান ও সূর্যমূর্তি আছেন। পূর্বাদি অষ্টদিকে দক্ষিণাবর্ত্তে যথাক্রমে সর্ব, ভব, রুদ্র, উগ্র, ভীম, পশুপতি, মহাদেব ও ঈশান নাম উল্লেখ করে পূজা করবে।
আপদকালীন সময়ে কেও মন্দিরে গিয়ে বিপদ বাড়াবেন না। ঘরে বসেই পূজা করুন। সরকারী নির্দেশ মেনে চলুন। ভীড় ও জমায়েত করবেন না। ঘরে বসে ঈশ্বরকে ডাকলেও সেটা ভজন সাধন হয়।