একাদশী একটি চান্দ্র তিথি। চাঁদের শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথি, হিন্দু ধর্মমতানুসারে পুণ্যতিথি হিসেবে বিবেচিত। হিন্দুধর্মমতে নিরম্বু উপবাস বিহিত। একাদশী ব্রত অবশ্য পালনীয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তার লীলাবিলাসের প্রথম থেকেই “একাদশী উপবাসের” প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। শ্রীল জীব-গোস্বামী তার ভক্তিসন্দর্ভ গ্রন্থে স্কন্ধ পুরাণের একটি উদ্ধৃৃতি দিয়ে বলেছেন, “যে মানুষ একাদশীর দিন শস্যদানা গ্রহণ করে সে তার পিতা, মাতা, ভাই এবং গুরু হত্যাকারী, সে যদি বৈকুণ্ঠ লোকেও উন্নীত হয়, তবুুুুও তার অধঃপতন হয়়।”
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা ১৫/৮-১০)
বছরে ছাব্বিশটি একাদশী আসে। সাধারণত বার মাসে চব্বিশটি একাদশী। এইগুলি হচ্ছে-
১. উৎপন্না একাদশী – ২. মোক্ষদা একাদশী
৩. সফলা একাদশী , – ৪. পুত্রদা একাদশী
৫. ষটতিলা একাদশী – ৬. জয় একাদশী
৭. বিজয়া একাদশী – ৮. আমলকী একাদশী
৯. পাপমোচনী একাদশী – ১০. কামদা একাদশী
১১. বরুথিনী একাদশী – ১২. মোহিনী একাদশী
১৩. অপরা একাদশী – ১৪. নির্জলা একাদশী
১৫. যোগিনী একাদশী – ১৬. শয়ন একাদশী
১৭. কামিকা একাদশী – ১৮. পবিত্রা একাদশী
১৯. অন্নদা একাদশী – ২০. পরিবর্তিনী বা পার্শ্ব একাদশী
২১. ইন্দিরা একাদশী – ২২. পাশাঙ্কুশা একাদশী
২৩. রমা একাদশী – ২৪. উত্থান একাদশী
কিন্তু যে বৎসর পুরুষোত্তমাস, অধিমাস বা মলমাস থাকে, সেই বৎসর পদ্মিনী ও পরমা নামে আরও দুটি একাদশীর আবির্ভাব হয়। যারা যথাবিধি একাদশী উপবাসে অসমর্থ অথবা ব্রতদিনে সাধুসঙ্গে হরিকথা শ্রবণে অসমর্থ, তারা এই একাদশী মাহাত্ম্য পাঠ বা শ্রবণ করলে অসীম সৌভাগ্যের অধিকারী হবেন। চলুন জেনে নি কামদা একাদশীর মাহাত্ম্য।
চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের কামদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য বরাহ পূরাণে বর্ণিত আছে। মহারাজ যুধিষ্টির বলেন- হে বাসুদেব ! আপনি কৃপা করে আমার কাছে কামদা একাদশীর মহিমা কীর্তন করুন ।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন-হে মহারাজ ! এই একাদশী ব্রত সম্পর্কে এক বিচিত্র কাহিনী বর্ণনা করছি । আপনি একমনে তা শ্রবণ করুন ।
পূর্বে মহর্ষি বশিষ্ঠ মহারাজ দিলীপের কৌতুহল নিবারণের জন্য এই ব্রতা কথা কীর্তন করেছিলেন । ঋষি বশিষ্ঠ বলেন- হে মহারাজ । কামদা একাদশী তিথি পাপনাশক ও পূণ্যদায়ীনি । পূর্বকালে মনোরম নাগপুরে স্বর্ণনির্মিত গৃহে বিষধর নাগেরা বাস করত । তাদের রাজা ছিলেন পুণ্ডরীক । গন্ধর্ব, কিন্নর ও অস্পরাদের দ্বারা তিনি সেবিত হতেন । সেই পুরীমধ্যে অস্পরা শ্রেষ্ঠ ললিতা ও ললিত নামে গন্ধর্ব স্বামী-স্ত্রী রূপে ঐশ্বর্য্যপূর্ণ এক গৃহে পরমসুখে দিনযাপন করত । একদিন পুণ্ডরীকের রাজসভায় ললিত একা গান করছিল । এমন সময় ললিতার কথা তার মনে পড়ল । ফলে সঙ্গীতের স্বর-লয়-তাল-মানের বিপর্যয় ঘটল । কর্কটক নামে এক নাগ ললিতের মনোভাব বুঝতে পারল ।
জ্ঞানের ছনফভঙ্গের ব্যাপারটি সে পুণ্ডরীক রাজার কাছে জানাল । তা শুনে সর্পরাজ ক্রোধভরে কামাতুর ললিতকে-রে দুর্মতি ! তুমি রাক্ষস হও বলে অভিশাপ দান করল । সঙ্গে সঙ্গে সেই ললিত ভয়ঙ্কর রাক্ষসমূর্তি ধারণ করল । তার হাত দশ যোজন বিস্তৃত, মুখ পর্বত গুহাতুল্য, চোখ দুটি প্রজ্বলিত আগুনের মতো, উর্দ্ধে আট যোজন বিস্তৃত প্রকাণ্ড এক শরীর সে লাভ করল । ললিতের এরকম ভয়ঙ্কর রাক্ষস শরীর দেখে ললিতা মহাদুঃখে চিন্তায় ব্যাকুল হলেন । স্বেচ্ছাচারী রাক্ষস ললিত দূর্গম বনে ভ্রমণ করতে লাগল । ললিতা কিন্তু তার সঙ্গ ত্যাগ করল না । ললিত নির্দয়ভাবে মানুষ ভক্ষণ করত । এই পাপের ফলে তার মনে বিন্দুমাত্র শান্তি ছিল না । পতির সেই দুরবস্থা দেখে ব্যথিত চিত্তে রোদন করতে করতে ললিতা গভীর বনে প্রবেশ করল । একদিন ললিতা বিন্ধ্যপর্বতে উপস্থিত হল । সেখানে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রম দর্শন করে মুনির কাছে হাজির হল । তার চরণে প্রণাম করে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল ।
মুনিবর জিজ্ঞাসা করলেন-হে সুন্দরী ! তুমি কে, কার কন্যা কি কারণেই বা এই গভীর বনে এসেছ ? তা সত্য করে বল । তদুত্তরে ললিতা বলল- হে প্রভু ! আমি বীরধন্যা গন্ধর্বের কন্যা । আমার নাম ললিতা । আমার পতির পিশাচত্ব দূর হয় এমন কোন উপায় জানবার জন্য এখানে এসেছি । তখনই ঋষি বললেন- চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের কামদা নামে যে একাদশী আছে, তুমি সেই ব্রত যথাবিধি পালন কর । এই ব্রতের পুণ্যফল তোমার স্বামীকে অর্পণ করলে তৎক্ষনাৎ তার সমস্ত পাপ বিনষ্ট হএব ।বশিষ্ঠ ঋষি বললেন- হে মহারাজ দিলীপ ! মুনির কথা শুনে ললিতা আনন্দ সহকারে কামদা একাদশী পালন করল ।
তারপর ব্রাক্ষণ ও বাসুদেবের সামনে পতির উদ্ধারের জন্য–আমি যে কামদা একাদশীর ব্রত পালন করেছি, তার সমস্ত ফল আমার পতির উদ্দেশ্যে অর্পণ করলাম । এই পুর্ণ্যের প্রভাবে তাঁর পিশাচত্ব দূর হোক । এই কথা উচ্চারণ মাত্রই ললিত শাপ মুক্ত হয়ে দিব্য দেহ প্রাপ্ত হল । পুনরায় গন্ধর্ব দেহ লাভ করে ললিতার সাথে সে মিলিত হল । তাঁরা বিমানে করে গন্ধর্বলোকে গমন করল । হে মহারাজ দিলীপ এই ব্রত যত্নসহকারে সকলেরই পালন করা কর্তব্য । এই ব্রত ব্রক্ষহত্যা পাপবিনাশক এবং পিশাচত্ব মোচনকারী । এই ব্রত কথা শ্রদ্ধাপূর্বক পাঠ ও শ্রবণে বাজপেয় যজ্ঞের ফল লাভ হয় ।