কালী পূজা কি ও এর ইতিহাস, কেন করা হয়? একাল ও সেকালের পূজা

সনাতন ধর্মমতে কালী বা কালিকা হচ্ছেন শক্তির দেবী। কাল শব্দটির অর্থ সময় হতে পারে, আবার এটা রং ও বুঝাতে পারে কাল তথা কৃষ্ণবর্ণ, এর অর্থ হতে পারে মৃত্যুবোধক। যেমন আমরা বলি- ‘কাল’এসে গেছে, মৃত্যুর সময় সমাসন্ন, মহাকাল এসে গেছে। দেবীর নাম মহাকালীও বটে। কালীর নাম কাল না হয়ে কালী হলো এ কারণে যে শিবের অপর নাম কাল, যা অনন্ত সময়কাল বোধক। কালী হচ্ছে কাল এর স্ত্রীলিঙ্গ বোধক। মা কালী মা দুর্গা বা পার্বতী’র সংহারী রূপ। ঊনবিংশ শতাব্দীর সংস্কৃত ভাষার বিখ্যাত অভিধান শব্দকল্পদ্রুম এ বলা হচ্ছে ‘কাল শিবহ্। তস্য পত্নতি কালী।’ অর্থাৎ শিবই কাল বা কালবোধক। তাঁর পত্নী কালী। কালী হচ্ছেন মা দুর্গার বা পার্বতীর অপর ভয়াল রূপ। তিনি সময়ের, পরিবর্তনের, শক্তির, সংহারের দেবী। তিনি কৃষ্ণবর্ণা বা মেঘবর্ণা এবং ভয়ংকরা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ভয়ংকরেরও পূজা করেন। তিনি অশুভ শক্তি’র বিনাশ করেন। তাঁর এই শক্তি’র পূজা সনাতন সমাজকে প্রভাবিত করেছে, বিশুদ্ধ শক্তি সঞ্চারিত করেছে, অন্তর শুদ্ধি দিয়েছে, দুর্দিনের দুর্বলতায় সাহস দিয়েছে। শাক্ত সৃষ্টিতত্ত্ব মতে এবং শাক্ত-তান্ত্রিক বিশ্বাস মতে তিনিই পরম ব্রহ্ম। কালীকে এই সংহারী রূপের পরেও আমরা মাতা সম্বোধন করি। তিনি সন্তানের কল্যাণ চান তিনি মঙ্গলময়ী, তিনি কল্যাণী এটাই তাঁর প্রতি সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল আস্থা ও নির্যাস।

কালীর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু তথা বাঙালিদের কাছে এই দেবী বিশেষভাবে শক্তির দেবী রূপে পূজিত হন। এছাড়াও বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবী কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায় কালীপূজা করে থাকে। তন্ত্র অনুসারে, কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত দশজন প্রধান তান্ত্রিক দেবীর প্রথম। দশমহাবিদ্যার ইনি প্রথমা মহাবিদ্যা। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। বাঙালি হিন্দু সমাজে কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্যেই দেবী কালীর পূজা করা হয়। দেবী কালীর অসংখ্য নামের মধ্যে দক্ষিণ, সিদ্ধ, গুন্য, ভদ্র, শ্মশান, রক্ষা ও মহাকালী। দেবী কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, দেবাসুরের যুদ্ধে পরাজিত দেবতাদের প্রার্থনায় আদ্যাশক্তি ভগবতি পার্বতীর দেহ কোষ থেকে দেবী কৌষিকী আবির্ভূত হন। তখন ভগবতি দেবী কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেন বলে তাঁর নাম কালী বা কালিকা। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিনটি কাল নিয়ে মহাকাল। আর সেই মহাকালের শক্তি কালী। অনন্তকালে সৃষ্টি রূপিণী পরমা প্রকৃতির রূপ এই মহাকালী। যারা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করতে চান যারা তন্ত্র এবং মন্ত্র ক্ষমতায় যারা বিশ্বাস করেন, যারা মানুষরূপী হয়েও ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চান তারা মা কালী পূজা অত্যন্ত ভক্তি সহকারে করে থাকেন।

কালীপূজা বা শ্যামাপূজা হিন্দু দেবী কালীর পূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত একটি হিন্দু উৎসব। প্রধানত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এই উৎসব উপলক্ষে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষিত হয়। বাংলায় গৃহে বা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত কালীপ্রতিমার নিত্যপূজা হয়ে থাকে। কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত সাংবাৎসরিক দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়। এই দিন আলোকসজ্জা ও আতসবাজির উৎসবের মধ্য দিয়ে সারা রাত্রিব্যাপী কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, দীপান্বিতা কালীপূজার দিনটিতে ভারতের অন্যান্য জায়গায় দীপাবলি উৎসব পালিত হয়। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই দিন লক্ষ্মীপূজা অনুষ্ঠিত হলেও বাঙালি, অসমীয়া ও ওড়িয়ারা এই দিন কালীপূজা করে থাকেন। এছাড়া মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে ফলহারিণী কালীপূজাও যথেষ্ট জনপ্রিয়। ব্রহ্মযামল নামক তন্ত্রগ্রন্থের মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যা এবং প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবারে কালীপূজা হয়ে থাকে।

নাম-ব্যুৎপত্তি

‘কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। এই শব্দের অর্থ ‘কৃষ্ণ’ (কালো) বা ‘ঘোর বর্ণ’(পাণিনি ৪।১।৪২)। হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত-এ যে ভদ্রকালীর উল্লেখ আছে, তা দেবী দুর্গারই একটি রূপ (মহাভারত ৪।১৯৫)। মহাভারত-এ ‘কালরাত্রি’ বা ‘কালী’ নামে আরও এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ইনি যুদ্ধে নিহত যোদ্ধৃবর্গ ও পশুদের আত্মা বহন করেন। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী নামে এক দানবীর উল্লেখ পাওয়া যায় (হরিবংশ, ১১৫৫২)।‘কাল’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে: ‘নির্ধারিত সময়’ ও ‘মৃত্যু’। কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের মানে “সময়ের থেকে উচ্চতর”। সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, ‘কালী’ শব্দটি ‘কৃষ্ণবর্ণ’ বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। প্রকৃত অর্থে কাল(সময়) কে কলন(রচনা) করেন যিনি তিনিই (কাল+ঈ) কালী।

কালী নাম কেন হলঃ

কালী কেন শক্তির দেবী শক্তির দেবী হিসাবেই কালী পূজিত হন। সনাতন ধর্ম-মতে এর উল্লেখ মেলে। কালী-নাম মাহাত্ম্যে কাল-কে যদি আলাদা করে নেওয়া হয় তাহলে কাল-এর একাধিক অর্থ বের হয়। কাল মানে সময়, আবার কাল তথা কৃষ্ণবর্ণ। কাল-এর অর্থ-এ লুকিয়ে আছে সংহার- বা মৃত্যু ভাবনাতেও। কালীকে কাল অর্থাৎ সময়ের জন্মদাত্রী বলা যেতে পারে, আবার পালনকর্ত্রী এবং প্রলয়কারিণী নিয়ন্ত্রক বলা হয়। এবং সেই কারণেই দেবীর নাম কাল যুক্ত ঈ-কালী। সনাতন ধর্মে ঈ-কারের সৃষ্টি ও শব্দোচ্চারণ-কে উল্লেখ করা হয়েছে ঈশ্বরী বা সগুণ ও নিগুর্ণ ব্রহ্মকে উপলদ্ধি করার জন্য। আবার শ্রীশ্রী চণ্ডীতে উল্লেখ মেলে যে, ‘ইয়া দেবী সর্বভুতেষু চেতনেত্যাবিধীয়তে, নমস্তসৈ, নমস্তসৈ নমো নমোঃহ।’ এই কারণে অনেকেই কালী-কে ক্রোধাম্বিতা, রণরঙ্গিনী বা করালবদনা বলেও অভিহিত করে থাকেন। ‘কালী’ নাম কেন কাল-এর স্ত্রীলিঙ্গ হল কালী। আর শিব-কেও কাল নামে ডাকা হয়। কাল মানে অনন্ত সময়। এই সময়েরই স্ত্রীলিঙ্গ বোধক হচ্ছে কালী। শাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে যে কাল সর্বজীবকে গ্রাস করে, সেই কালকে আবার যিনি গ্রাস করেন-তাঁকেও কালী বলা হয়। জগতের উৎপত্তি, স্থিতি, মহাপ্রলয়-এর পিছনে রয়েছে কালশক্তি। সবচেয়ে মজার কথা এই সবের জন্য যে মহাকাল পরিস্থিতির উদ্ভূত হয় তাই আবার সব সৃষ্টিকে গ্রাস করে। সনাতন ধর্মে উল্লেখ যে মহাকালেরও পরিণাম আছে। মহাপ্রলয়ের কালশক্তি মহাকালীর ভিতরেই নিঃশেষ লীন হয়ে যায়।

মা কালীর উৎপত্তির পৌরাণিক ব্যাখ্যা

কালিকা পুরাণ থেকে জানা যায় পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই রাক্ষস ছিল এবং সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল । পৃথিবীতে চরম অত্যাচার শুরু করেছিলেন দুই রাক্ষস ভাতৃদ্বয়। তাদের আক্রমণে পৃথিবীর সকল মানুষ একপ্রকার চরম অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তারা তাদের আক্রমণের পরিধি শুধু পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি তাঁরা দেবলোকেও আক্রমণ করেছিল। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে এবং দেবতাদের দেবলোক ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। এমন সময় দেবতারা ভগবান বিষ্ণু,মহাদেব শিব এবং প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন । তখন তাদের সম্মিলিত উপদেশ যেন সকল দেবতারা মিলে আদ্যশক্তি মহামায়ার উপাসনা করেন । ফলে দেব লোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেব লোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন। তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাদের কাছে আবির্ভূত হন। মা মহামায়া অবতীর্ণ হলে তিনি দেবতাদের বরাভয় প্রদান করেন এবং অসুর নিধনে তার রুদ্র রূপ ধারণ করেন। দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয় যা কৌশিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত দেবী কৌশিকী মা মহামায়া দেহ থেকে নিঃসৃত হলে মা মহামায়া কাল বর্ণ ধারণ করে যা দেবী কালীর আদিরূপ বলে ধরা হয়।

মা কালী কেন আবির্ভূত হলেনঃ

মা কালী বা মা করুণাময়ী, তার কাছে কোনও পক্ষপাতিত্ব নেই। যিনি আকুল হয়ে ডাকবেন, তাকে রক্ষা করতে মা বার বার আবির্ভূত হবেন। তিনি দেবতা, রাক্ষস, দৈত্য বা মানুষ যিনিই হন। মা কালীকে অনেকেই অনেক কারণে ডেকে থাকেন, আর মা তার ভক্তদের দশ হাতে রক্ষা করেন। মাকে কেউ ডাকে আর্থিক উন্নতির জন্য, আবার কেউ ডাকেন সন্তানের জন্য, রোগ, শত্রু ও এই রকম নানা কারণে ভক্তরা মাকে ডেকে থাকেন।

রূপভেদ

তন্ত্র পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপভেদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তোড়লতন্ত্র অনুসারে, কালী আট প্রকার। যথা: দক্ষিণকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী। মহাকাল সংহিতার অনুস্মৃতিপ্রকরণে নয় প্রকার কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা: দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, গুহ্যকালী, কামকলাকালী, ধণকালিকা, সিদ্ধিকালী, সিদ্ধিকালী, চণ্ডিকালিকা। অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থদ্বয়ে কালীর ১৩টি রূপের উল্লেখ আছে। যথা: সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নিরুদ্রকালী, মহাকালী, মহাভৈরবঘোর ও চণ্ডকালী। জয়দ্রথ যামল গ্রন্থে কালীর যে রূপগুলির নাম পাওয়া যায়, সেগুলি হল: ডম্বরকালী, রক্ষাকালী, ইন্দীবরকালিকা, ধনদকালিকা, রমণীকালিকা, ঈশানকালিকা, জীবকালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী ও সপ্তার্নকালী। মুণ্ডকোপনিষদে মহাকালী স্বয়ং কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সধূম্রবর্ণা, বিশ্বরুচি, স্ফুলিঙ্গিনী, চঞ্চলজিহ্বা ইত্যাদি নামে ভূষিত হন। মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে পূজার নাম জৈষ্ঠ্যে ‘ফলহারিণী’ কালী পূজা।

অষ্টধা কালী

দক্ষিণাকালী

দক্ষিণাকালীর কালীর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ মূর্তি। ইনি প্রচলিত ভাষায় শ্যামাকালী নামে আখ্যাতা। দক্ষিণাকালী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তার বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুগলে বর ও অভয় মুদ্রা। তার গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। তার গলায় মুণ্ডমালার হার; কর্ণে দুই ভয়ানক শবরূপী কর্ণাবতংস; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। তার দন্ত ভয়ানক; তার স্তনযুগল উন্নত; তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দণ্ডায়মান। তার দক্ষিণপদ শিবের বক্ষে স্থাপিত। তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী।

তাত্ত্বিকের তার নামের যে ব্যাখ্যা দেন তা নিম্নরূপ: দক্ষিণদিকের অধিপতি যম যে কালীর ভয়ে পলায়ন করেন, তার নাম দক্ষিণাকালী। তার পূজা করলে ত্রিবর্ণা তো বটেই সর্বোপরি সর্বশ্রেষ্ঠ ফলও দক্ষিণাস্বরূপ পাওয়া যায়। বাংলা তথা হিন্দু বাঙালির গৃহে এই পূজার প্রচলনে নবদ্বীপের তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ দক্ষিণাকালীর শান্তি রূপকল্পনা করেন। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি নবদ্বীপে নিজের হাতে কালী প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে পূজা করেন, যা আগমেশ্বরী মাতা নামে খ্যাত।

সিদ্ধকালী মা

সিদ্ধকালী কালীর একটি অখ্যাত রূপ। গৃহস্থের বাড়িতে সিদ্ধকালীর পূজা হয় না; তিনি মূলত সিদ্ধ সাধকদের ধ্যান আরাধ্যা। কালীতন্ত্র-এ তাকে দ্বিভূজা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। অন্যত্র তিনি ব্রহ্মরূপা ভুবনেশ্বরী। তার মূর্তিটি নিম্নরূপ: দক্ষিণহস্তে ধৃত খড়্গের আঘাতে চন্দ্রমণ্ডল থেকে নিঃসৃত অমৃত রসে প্লাবিত হয়ে বামহস্তে ধৃত একটি কপালপাত্রে সেই অমৃত ধারণ করে পরমানন্দে পানরতা। তিনি সালংকারা। তার বামপদ শিবের বুকে ও বামপদ শিবের উরুদ্বয়ের মধ্যস্থলে সংস্থাপিত।

গুহ্যকালী

গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ গৃহস্থের নিকট অপ্রকাশ্য। তিনি সাধকদের আরাধ্য। তার রূপকল্প ভয়ংকর: গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা; নারদাদিঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন; তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। গুহ্যকালী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা। মুর্শিদাবাদ-বীরভূম সীমান্তবর্তী আকালীপুর গ্রামে মহারাজা নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত গুহ্যকালীর মন্দিরের কথা জানা যায়। মহাকাল সংহিতা মতে, নববিধা কালীর মধ্যে গুহ্যকালীই সর্বপ্রধানা। তার মন্ত্র বহু – প্রায় আঠারো প্রকারের।

মহাকালী

তন্ত্রসার গ্রন্থমতে, মহাকালী পঞ্চবক্ত্রা ও পঞ্চদশনয়না। তবে শ্রীশ্রীচণ্ডী-তে তাকে আদ্যাশক্তি, দশবক্ত্রা, দশভূজা, দশপাদা ও ত্রিংশল্লোচনা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। তার দশ হাতে রয়েছে যথাক্রমে খড়্গ,চক্র,গদা,ধনুক,বাণ,পরিঘ,শূল,ভূসুণ্ডি,নরমুণ্ড ও শঙ্খ। ইনিও ভৈরবী; তবে গুহ্যকালীর সঙ্গে এঁর পার্থক্য রয়েছে। ইনি সাধনপর্বে ভক্তকে উৎকট ভীতি প্রদর্শন করলেও অন্তে তাকে রূপ, সৌভাগ্য, কান্তি ও শ্রী প্রদান করেন।
মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর প্রথম চরিত্র শ্রী শ্রী মহাকালীর ধ্যানমন্ত্র এইরূপ

ওঁ খড়্গং চক্রগদেষুচাপপরিঘান শূলং ভুসূণ্ডিং শিরঃ|
শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্বাঙ্গভূষাবৃতাম্ ||
নীলাশ্মদ্যুতিমাস্যপাদদশকাং সেবে মহাকালিকাম্ |
যামস্তৌচ্ছয়িতে হরৌ কমলজো হন্তুং মধুং কৈটভম্ ||

সৃষ্টির আদিতে যে সময় বিষ্ণু যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন। বিষ্ণুর নাভিকমলে ব্রহ্মা বিরাজিত। সেই সময় বিষ্ণুর কর্ণফুল থেকে মধু ও কৈটভ, দুই দৈত্যর সৃষ্টি হয়। কোনও কারণে তারা বহ্মাকে আক্রমণ করতে গেলে, ব্রহ্মা তখন মহাকালীর স্তব করেন। প্রথম ভক্তের ডাকে মায়ের কালী রূপে আবির্ভাব।

ভদ্রকালীর

ভদ্রকালী নামের ভদ্র শব্দের অর্থ কল্যাণ এবং কাল শব্দের অর্থ শেষ সময়। যিনি মরণকালে জীবের মঙ্গলবিধান করেন, তিনিই ভদ্রকালী। ভদ্রকালী নামটি অবশ্য শাস্ত্রে দুর্গা ও সরস্বতী দেবীর অপর নাম রূপেও ব্যবহৃত হয়েছে। কালিকাপুরাণ মতে, ভদ্রকালীর গাত্রবর্ণ অতসীপুষ্পের ন্যায়, মাথায় জটাজুট, ললাটে অর্ধচন্দ্র ও গলদেশে কণ্ঠহার। তন্ত্রমতে অবশ্য তিনি মসীর ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা, কোটরাক্ষী, সর্বদা ক্ষুধিতা, মুক্তকেশী; তিনি জগৎকে গ্রাস করছেন; তার হাতে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ও পাশযুগ্ম। গ্রামবাংলায় অনেক স্থলে ভদ্রকালীর বিগ্রহ নিষ্ঠাসহকারে পূজিত হয়। এই দেবীরও একাধিক মন্ত্র রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ চতুর্দশাক্ষর মন্ত্রটি হল – ‘হৌঁ কালি মহাকালী কিলি কিলি ফট স্বাহা’।

চামুণ্ডাকালী

চামুণ্ডাকালী বা চামুণ্ডা ভক্ত ও সাধকদের কাছে কালীর একটি প্রসিদ্ধ রূপ। দেবীভাগবত পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর বর্ণনা অনুযায়ী, চামুণ্ডা চণ্ড ও মুণ্ড নামক দুই অসুর বধের নিমিত্ত দেবী দুর্গার ভ্রুকুটিকুটিল ললাট থেকে উৎপন্ন হন। তার গাত্রবর্ণ নীল পদ্মের ন্যায়, হস্তে অস্ত্র, দণ্ড ও চন্দ্রহাস; পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম; অস্তিচর্মসার শরীর ও বিকট দাঁত। দুর্গাপূজায় মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে আয়োজিত সন্ধিপূজার সময় দেবী চামুণ্ডার পূজা হয়। পূজক অশুভ শত্রুবিনাশের জন্য শক্তি প্রার্থনা করে তার পূজা করেন। অগ্নিপুরাণ-এ আট প্রকার চামুণ্ডার কথা বলা হয়েছে। তার মন্ত্রও অনেক। বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণে বর্ণিত চামুণ্ডা দেবীর ধ্যানমন্ত্রটি এইরূপ –

নীলোৎপলদলশ্যামা চতুর্বাহুসমন্বিতা ।
খট্বাঙ্গ চন্দ্রহাসঞ্চ বিভ্রতী দক্ষিণে করে ।।
বামে চর্ম্ম চ পাশঞ্চ ঊর্দ্ধাধোভাগতঃ পুনঃ ।
দধতী মুণ্ডমালাঞ্চ ব্যাঘ্রচর্মধরাম্বরা ।।
কৃশোদরী দীর্ঘদংষ্ট্রা অতিদীর্ঘাতিভীষণা ।
লোলজিহ্বা নিমগ্নারক্তনয়নারাবভীষণা ।।
কবন্ধবাহনাসীনা বিস্তারা শ্রবণাননা ।
এষা কালী সমাখ্যাতা চামুণ্ডা ইতি কথ্যতে ।।
 

শ্মশানকালী

কালীর “শ্মশানকালী” রূপটির পূজা সাধারণত শ্মশানঘাটে হয়ে থাকে। এই দেবীকে শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনে করা হয়। তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ রচিত বৃহৎ তন্ত্রসার অনুসারে এই দেবীর ধ্যানসম্মত মূর্তিটি হচ্ছে: শ্মশানকালী দেবীর গায়ের রং কাজলের মতো কালো। তিনি সর্বদা বাস করেন। তাঁর চোখদুটি রক্তপিঙ্গল বর্ণের। চুলগুলি আলুলায়িত, দেহটি শুকনো ও ভয়ংকর, বাঁ-হাতে মদ ও মাংসে ভরা পানপাত্র, ডান হাতে সদ্য কাটা মানুষের মাথা। দেবী হাস্যমুখে আমমাংস খাচ্ছেন। তাঁর গায়ে নানারকম অলংকার থাকলেও, তিনি উলঙ্গ এবং মদ্যপান করে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন। শ্মশানকালীর আরেকটি রূপে তার বাঁ-পাটি শিবের বুকে স্থাপিত এবং ডান হাতে ধরা খড়্গ। এই রূপটিও ভয়ংকর রূপ। তন্ত্রসাধকেরা মনে করেন, শ্মশানে শ্মশানকালীর পূজা করলে শীঘ্র সিদ্ধ হওয়া যায়। রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী সারদা দেবী দক্ষিণেশ্বরে শ্মশানকালীর পূজা করেছিলেন। কাপালিকরা শবসাধনার সময় কালীর শ্মশানকালী রূপটির ধ্যান করতেন। সেকালের ডাকাতেরা ডাকাতি করতে যাবার আগে শ্মশানঘাটে নরবলি দিয়ে শ্মশানকালীর পূজা করতেন। পশ্চিমবঙ্গের অনেক প্রাচীন শ্মশানঘাটে এখনও শ্মশানকালীর পূজা হয়। তবে গৃহস্থবাড়িতে বা পাড়ায় সর্বজনীনভাবে শ্মশানকালীর পূজা হয় না। রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন, শ্মশানকালীর ছবিও গৃহস্থের বাড়িতে রাখা উচিত নয়।

শ্রীকালী

গুণ ও কর্ম অনুসারে শ্রীকালী কালীর আরেক রূপ। অনেকের মতে এই রূপে তিনি দারুক নামক অসুর নাশ করেন। ইনি মহাদেবের শরীরে প্রবেশ করে তার কণ্ঠের বিষে কৃষ্ণবর্ণা হয়েছেন। শিবের ন্যায় ইনিও ত্রিশূলধারিনী ও সর্পযুক্তা। তিনি যেমন একদিকে মন্দ শক্তির বিনাশ কারিনী তেমনী ভক্তদের বিপদ তারিনী।।

মা কালীর জিভ বেরিয়ে থাকে কেন? কালীর পায়ের নীচে শিব থাকে কেনঃ

হিন্দু ধর্মে সকল দেব দেবীর মধ্যে মা কালী হলেন নারীদের ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক তথা শক্তিরূপের অন্যতম সেরা প্রতীক। এই রূপ দিয়ে মা সমস্ত বিশ্বকে একদিকে যেমন বুঝিয়েছেন অসুরদের বিনাশ এর জন্য তিনি এই রূপ ধারণ করেছেন, তেমনই নারীরা তাদের মমতাময়ী রূপের খোলস ত্যাগ করে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে সকল অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার শেষ করার ক্ষমতাও রাখে। মাতা কালী হলেন কৃষ্ণ বর্ণের বা শ্যামা বর্ণের ।তার যে রুদ্রমূর্তি আমরা দেখতে পাই তাতে দেখি তার দুই নেত্র ভয়ংকর রক্ত বর্ণের হয়ে থাকে। মাতা কালীর যে সকল মূর্তি ,চিত্র আমরা দেখতে পাই তাতে সবগুলিতেই আমরা দেখি মা কালী দাঁড়িয়ে আছেন ভগবান শিবের ওপর এবং তার জিভ সম্মুখে অগ্রস্থ অবস্থায় আছে। অনেকের মনেই এই প্রশ্ন দেখা যায় কেন মা কালী তার স্বামীর উপর এইরূপ জিভ বার করে দাঁড়িয়ে আছেন?

মা মহামায়া অবতীর্ণ হলে তিনি দেবতাদের বরাভয় প্রদান করেন এবং অসুর নিধনে তার রুদ্র রূপ ধারণ করেন। দেবতারা তখন এক প্রকার খুশি হন। কিন্তু অসুরেরা সম্মিলিত ভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। আর অসুরদের এরকম সম্মিলিত লড়াইয়ে মাতা মহামায়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং তার তৃতীয় নেত্র থেকে জন্ম নেয় এক অত্যন্ত রুদ্রমূর্তি এবং এই ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি হলো মা কালিকা বা মা কালী । যখন তিনি মা কালী রূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন তখন সকল অসুরদের বিনাশ করতে শুরু করেন এবং এক প্রকার হত্যাকাণ্ডের তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যান। অসুর হত্যা করে মা তাদের নরমুণ্ড হাতে ধরেন এবং নরমুণ্ডের মালা করে গলায় পরিধান করেন। এছাড়াও খড়্গের দ্বারা অসুরদের হাত কেটে তিনি তার পোশাক বানিয়ে পরিধান করে নেন নিম্নাঙ্গে। এইরকম অবস্থায় অসুরেরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তারা বুঝে উঠতে পারে না কিভাবে এই দেবীর মোকাবিলা করবে?

তখন শুম্ভ-নিশুম্ভ তাদের সেনাপতি রক্তবীজকে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ করেন। এই ভয়ঙ্কর দেবীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অসুরদের মধ্যে এক ভয়ংকর অসুর ছিল রক্তবীজ ।এই অসুর প্রজাপতি ব্রহ্মার আশীর্বাদে পেয়েছিলেন এক অভিনব বর। বরটি ছিল এইরূপ, অসুর রক্তবীজকে যদি কেউ হত্যা করতে উদ্যত হন কোন অস্ত্র বা তলোয়ার দিয়ে এবং তার শরীর থেকে যদি বিন্দুমাত্রও রক্তপাত হয় তাহলে সেই রক্তের বিন্দুকনা যেখানে যেখানে পড়বে প্রতিটি বিন্দু কণা থেকেই এক একটি করে রক্তবীজের পুনরায় জন্ম হবে অর্থাৎ একপ্রকার নিজেকে অমর করার বর চেয়ে নিয়েছিলেন প্রজাপতির কাছে অত্যন্ত চালাক অসুর রক্তবীজ। এই রুপ বরশালী রক্তবীজকে দেখামাত্রই মা রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন। খড়্গের আঘাতে রক্তবীজের শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করলে তার সারা শরীর থেকে রক্ত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং তখনই প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে সৃষ্টি হয় লক্ষ লক্ষ রক্তবীজ । এইভাবে মা প্রতিবার রক্তবীজকে মারতে উদ্যত হলে আরো লক্ষ লক্ষ নতুন রক্তবীজ জন্ম নেয় । তখন মা বুঝতে পারেন রক্তবীজের বরের কথা। তাই মা এইবার সকল রক্তবীজের রক্তকে তার মুখ দিয়ে পুরোটাই গ্রহণ করেন ,হত্যা করার পর ।এইভাবে তিনি রক্তবীজকে হত্যা করতে সফলতা লাভ করেন।

এরপরই শুরু হয় মায়ের তাণ্ডবনৃত্য । সেই তান্ডব নৃত্যে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কাঁপতে থাকে। দেবতারা যখন এই তান্ডব নিত্য দেখেন তখন তারা বুঝতে পারেন সারা পৃথিবী জুড়ে এক প্রলয়ের সৃষ্টি হতে চলেছে, যা তাদের পক্ষে রোধ করা এক প্রকার অসম্ভব ছিল। আর এই প্রলয় যে সকল কিছুকে ধ্বংস করে দেবে তা তারা উপলব্ধি করতে পারেন।

তখন তারা ছুটে যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। তখন মহাদেব সকলের অনুরোধ শুনে মা কালীর রুদ্রমূর্তি তাণ্ডবনৃত্য বন্ধ করার জন্য মায়ের সামনে আপন দেহ শায়িত করেন । তাণ্ডব নৃত্য করতে করতে মা কালী যখন ভগবান শিবের বুকে পা দেন তখন এক প্রকার সম্বিৎ ফিরে পান। তখন দেখেন তিনি তার স্বামীর বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ।আর তাই তখন হঠাৎ করে লজ্জায় তার জিভ সম্মুখে বেরিয়ে আসে ।আর এই সন্মুখে বেরিয়ে আসা মা কালীর রুদ্র মূর্তি আমরা প্রত্যক্ষ করি সকল রূপে এবং বিভিন্ন চিত্রকলায় ও বিভিন্ন মূর্তিতে। এই ভাবেই মায়ের চিরাচরিত সম্মুখ বের করা মূর্তি প্রসিদ্ধিলাভ করে এই পৃথিবীলোকে।

দেবী কালীকার রূপের শাস্ত্রগত ব্যাখ্যাঃ

মা কালী মহাশক্তি । যা ছিল , যা আছে এবং যা থাকবে সব মা কালীর মধ্যেই আছে । অনন্ত , আদি , বর্তমান সব কালী মায়ের মধ্যেই আছে । দেবী কালীকার প্রচলিত যে রূপটি পূজিত হয়, সেইরূপটির নাম দক্ষিণাকালী। বলা হয়, এই রূপটি এনেছেন তান্ত্রিক সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। এটি তাঁরই মানসচক্ষে পাওয়া মূর্তি। এ বার তাঁর কল্পিত মূর্তির শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা কী আছে বা তার তাৎপর্য কী, সেটা দেখে নেওয়া যাক।
● ধ্বংসের দেবীঃ কালী শব্দটির ব্যাখ্যা: ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ ‘কালী’। এই শব্দের অর্থ ‘কালো’ বা ‘ঘোর বর্ণ’। ধ্বংসের মধ্যেই সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে আছে । যেমন ঘন কালো রাত্রির পর দিন আসে । তেমনি ধ্বংসের পর সৃষ্টি হয় । ঘন কালো মেঘ বিদায় হলেই আকাশে ঝলমলে সূর্য ওঠে । তাই ধ্বংস ছাড়া সৃষ্টির বিকাশ সম্ভব নয় ।
● আদ্যাশক্তিঃ মা কালী হলেন আদ্যাশক্তি । জগতের মূল শক্তি ইনি । ইনি মহা সরস্বতী । ইনিই মহা লক্ষ্মী । ইনি রুদ্রানী শিবানী । ইনি ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী , নারায়নের শক্তি নারায়নী , শিবের শক্তি শিবা। ইনি নারসিংহী , ইনি বারাহী , ইনি কৌমারী , গন্ধেশ্বরী । ইনি শ্রী রামচন্দ্রের শক্তি সীতা দেবী ( বামস্য জানকী ত্বং হি রাবনধ্বংসকারিনী ) , ইনি শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি , ইনি শ্রী রামকৃষ্ণের সহধর্মিণী মা সারদা । ইনি মহিষমর্দিনী চণ্ডী , ইনি চামুন্ডা , কৌষিকী , দুর্গা ভগবতী । এই ব্রহ্মাণ্ড তাঁর ইচ্ছাতেই চলছে । মায়ের ইচ্ছা ভিন্ন গাছের একটা পাতাও নড়ে না ।
● সংহার রুপিনীঃ সংহার শব্দের অর্থ ঠিক ধবংস নয় । সংহরন । নিজের ভিতরে প্রত্যাকর্ষণ । যেমন সমুদ্রের ঊর্মিমালা সমুদ্রের বক্ষ থেকেই উদ্ভুত হয় আবার সমুদ্রেই লয় হয় । যেম্ন উর্ণণাভ নিজের গর্ভ থেকে জাল রচনা করে আবার নিজের পেটেই গুটিয়ে নেয় । মৃত্যুর অর্থ পৃথিবী থেকে , নিকট জনের থেকে চির বিদায় নেওয়া – কিন্তু সেই জগত জননীর কোলে আশ্রয় পাওয়া। এই ব্রহ্মাণ্ড সেই মহামায়ার ইচ্ছাতেই রচিত , সংহার কালে তিনি আবার সব গুটিয়ে নেন ।
● শিবের ওপর কালীঃ এখানে মা কালী শবরূপী শিবের উপর দণ্ডায়মান। শিব হচ্ছেন স্থির বা নীরব। আর কালী হচ্ছেন ‘গতির প্রতীক’। এখানে শিব দেখতে সাদা আর মায়ের রূপ কালো বা ঘন নীল। সাধারণত যাঁরা যোগী বা সাধক, তাঁরা সাধন কালের ‘কূটস্থ’ দর্শনকালে শুভ্র রং বেষ্টিত কালো দেখে থাকেন। আবার বলা হয়ে থাকে মহাদেব এখানে শব রূপ । এর মৃত্যুরুপ শিবের বুকে স্বয়ং জগত মাতা । এর মানে হল মৃত্যু কে জয় ।
● দিগম্বরীঃ দেবী কালী দিগম্বরী । এর অর্থ তিনি কোন কিছুর বন্ধনে আবদ্ধ নন । তিনি দেশ কালের ওপরে । তিনি সকল জীবের মাতা । এক দিকে দেবী বিশ্বমধ্যে, আবার অন্য দিকে তিনি বিশ্বব্যাপী ও বিশ্বাতীত। যাঁর স্বরূপ এমন, তাঁকে কি কোনও বস্ত্র দিয়ে আবরিত করা সম্ভব! কার কী এমন সাধ্য আছে তাঁর ওই রকম বস্ত্র তৈরী করার? তাই তিনি ঋষি কল্পনায় দিগম্বরী বা নগ্নিকা। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন কিছু পণ্ডিত বসনকে কামনা বাসনার প্রতীক বলেছেন । ভগবান শ্রী কৃষ্ণ গোপীনি দের বস্ত্র হরণ করেছিলেন । যারা মূর্খ , নাস্তিক তারা এর মধ্যে অশ্লীলতার প্রসঙ্গ খোঁজেন । এর মানে কিন্তু এই না আমাদের বসনহীন হয়ে থাকতে হবে । খালি কামনা বাসনা আদি ষড়রিপু বর্জন করতে হবে । তবেই দেবকৃপা পাওয়া যাবে । তাই সম্পূর্ণ রিক্ত হয়ে অহং ও অবিদ্যা কে ত্যাগ করেই মায়ের কাছে যেতে হবে ।
● মুক্তকেশীঃ মা মুক্ত স্বভাবা । তাই তিনি মুক্তকেশী । তাঁর মাথার ঘন কালো চুল বাঁধা অবস্থায় থাকে না। যোগশাস্ত্রে মুক্তকেশ বৈরাগ্যের প্রতীক। তিনি চিরবৈরাগ্যের প্রতীক। তিনি জ্ঞানের দ্বারা লৌকিক বা জাগতিক সকল বন্ধন ছিন্ন করতে পারেন। তাঁর জ্ঞান খড়গের দ্বারা অষ্টপাশ ছিন্ন হলেই নিস্কাম সাধক দেবীর কৃপা পান । তবেই মুক্তি ঘটে। রামপ্রসাদ তাই গাইলেন

“ মুক্ত কর মা মুক্তকেশী
ভবে যন্ত্রনা পাই দিবানিশি । ”

দেবী কালীর সেই কেশ মৃত্যুর প্রতীক । চন্ডীতে আছে মহিষাসুরের হাতে পরাজিত দেবতারা যখন ত্রিদেবের কাছে গেলেন তখন ত্রিদেব ও সমস্ত দেবতাদের তেজ রাশি একত্রিত হয়ে ভগবতী মহামায়ার আবির্ভাব ঘটে । যমের তেজে দেবীর কেশরাশি গঠিত হয় ।
● মুন্ডমালাঃ মায়ের কন্ঠে মুণ্ডমালা। দেবীর গলায় ৫০টি পিশাচের কাটা মুণ্ডের মালা বা হার। প্রকৃতি অর্থে ৫০টি কাটা মুণ্ড ৫০টি সংস্কৃত বর্ণমালার প্রতীক ।, ১৪টি স্বরবর্ণ আর ৩৬টি ব্যঞ্জন বর্ণ। এখানে প্রতিটি বর্ণ মানে প্রতিটি বীজমন্ত্র। শব্দ ব্রহ্ম। তাই এখানে অক্ষর রূপ বীজমন্ত্রগুলি শক্তির উৎস। দেবী এখানে স্বয়ং শব্দব্রহ্মরূপিণী। কামধেনু তন্ত্রে দেবী স্বয়ং বলেছেন

“ মম কণ্ঠে স্থিতং বীজং পঞ্চাশদ্ বর্ণমদ্ভুতম্ । ”
রামপ্রসাদ তাই গেয়েছেন
যত শোন কর্ণপুটে সকল মায়ের মন্ত্র বটে ।
কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে ।
মুন্ডমালা হল জ্ঞান শক্তির প্রতীক । দেবী ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন । তিনি চেতনা দান করেন । অন্ধকারে আবদ্ধ জীবকে আলোর পথ দেখান ।
● হস্তের মেখলাঃ দেবী কালী কটি দেশে নর হস্তের মেখলা । কিন্তু কেন ? হস্ত কর্মশক্তির প্রতীক ।
● ত্রিনয়নীঃ দেবী কালীর ত্রিনয়ন । দেবীর একটি নয়ন চন্দ্র স্বরূপ , আর একটি সূর্য স্বরূপ । তৃতীয়টি অগ্নি স্বরূপ । দেবী ভূত , ভবিষ্যৎ , বর্তমান সব কিছুই প্রত্যক্ষ করেন ।‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’ অর্থাৎ অন্ধকার থেকে আলোতে বা জ্যোতিতে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আবার সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের অধিপতি। অর্থাত্ তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতেও অবস্থান করবেন। তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই ত্রিকাল নিয়ন্ত্রিত হয় । প্রকাশ্য দিবালোকে , সন্ধ্যায় বা রাত্রে আমরা যে কাজ করি নে কেন তিনি দেখছেন । আমরা যদি গোপনে পাপ কাজ করে প্রভাব খাটিয়ে এই পৃথিবীর বিচারসভার হাত থেকে নিস্কৃতি পাইও , তবুও দেবী সব দেখেন – তাঁর বিচার থেকে নিস্কৃতি পাওয়া যাবে না ।
● চারিহস্তঃ দেবীর চার হাত । তাঁর ওপরের দুহাতে অভয় ও খড়গ । নীচে বর মুদ্রা ও ছিন্ন নরমুণ্ড । অভয় ও বরামুদ্রা সৃষ্টির প্রতীক । খড়গ ও ছিন্ন নরমুণ্ড ধ্বংসের প্রতীক । দুটি বিপরীত কাজ হলেও আমরা মা কালীর মধ্যে দুটিকেই দেখতে পাই । এর অর্থ দেবী কালীর ইচ্ছাতেই সৃষ্টি হয় , তার ইচ্ছাতেই ধ্বংস হয় । দেবী তার খড়গ দ্বারা অবিদ্যা রুপী অসুরকে ধ্বংস করেন ।
● কৃষ্ণবর্ণঃ কালী মাতা কৃষ্ণবর্ণা। এখানে কালো মানে বর্ণাতীত। সকলেই জানেন কালোর মধ্যে সব বর্ণ মিলে যায়। কালো জগতের আলো। সাধকেরা দেবীকে অনেক সময় গাঢ় নীল বর্ণের দেখে থাকেন, কারণ তিনি গাঢ় নীল আকাশের মতোই অনন্ত অসীম। আদিতে যখন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কিছুই ছিল না তখনও তিনি ছিলেন । তিনি অনন্ত । তিনি আদিতেও ছিলেন , তাই তিনি কৃষ্ণবর্ণা । কখনো তিনি নীলবর্ণা । যা সুদীর্ঘ সুনীল নীল আকাশের তুলনীয় । এর অর্থ দেবী অনন্ত । অনন্ত তার লীলা প্রকাশ । যা ব্রহ্মা , বিষ্ণু , মহেশ্বরের অগোচর ।
● বিবসনা স্তন্যঃ দেবী কালী উলঙ্গিনী । তাই কিছু নাস্তিক , মূর্খ ও বুদ্ধিজীবি শ্রেনীর মানুষ অনেক সময় খারাপ কিছুর সঙ্গে উলঙ্গিনী মায়ের তুলনা করে বসেন । মা উলঙ্গিনী বটে – কিন্তু তিনি যে তাঁর বাৎসল্যের স্নেহধারা তাঁর সকল সন্তান দের জন্যই রেখেছেন । তিনিই ত অন্নপূর্ণা রুপে ধান , শস্যে ভরিয়ে দিয়েছেন । তিনি শাকম্ভরী , তিনিই শতাক্ষী । মা হল পরম করুণাময়ী । সন্তানের দুঃখে তিনি কাঁদেন , সন্তানের উল্লাসেই তিনি আনন্দিত হন । এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন । অনেক পণ্ডিতরা বলেন মা শীতলা নাকি সকলকে বসন্ত রোগের জীবানু দেন । এমন কোন মা আছে যে তার সন্তান দের তিনি রোগ দেবেন ? তাঁর সন্তান রা রোগে কষ্ট পাবে আর তিনি দেখবেন । এমন ধারনা ‘মা’ শব্দের অপমান ।
● রক্তমাখা জিহ্বাঃ দেবীর রক্তমাখা জিহ্বা রজঃ গুনের প্রতীক । তিনি তার শ্বেত দন্ত পাটি দ্বারা জিহ্বা কেটেছেন । শ্বেত বর্ণ হল স্বত্বঃ গুনের প্রতীক । এর মানে মা আমাদের স্বত্বঃ গুন দ্বারা রজঃ গুনকে সংহত করার শিক্ষে দিচ্ছেন । অর্থাৎ দাঁতের দ্বারা জিহ্বা স্থির রেখে বলতে চাওয়া হয়েছে ত্যাগের দ্বারা ভোগকে জয় করা।
● মহা শ্মশ্মান বাসিনীঃ দেবী মহাশ্মশ্মান এ বিচরণ করেন । কর্মফল ভোগান্তে জীবের শেষ আশ্রয় স্থল হল শ্মশ্মান । যেখানে তারা জননীর কোলে সুখে নিদ্রা যায় । মায়ের আঁচল এর তুলনা কোটী কোটি স্বর্গের সাথেও হয় না । যেখানে বাৎসল্যের ছোঁয়া লেগেই থাকে। “মায়ের কোলে ঘুমায় ছেলে , এ শান্তি মা কোথায় বল ?”
● বিপরীত রতাতুরাঃ মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম ।। অর্থাৎ আদ্যাশক্তি শ্রী শ্রী কালী বিশ্ব প্রসবিনী । পরম পুরুষ মহাকাল শিবের সাথে মিথুন ক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন । এই রতি ক্রিয়া পরমার্থিক ।
● কোমরবন্ধ মানুষের কাটা রক্তঝরা হাত: এখানে কাটা হাত কর্ম বা কর্মফলকে বোঝানো হয়েছে। তাই কাটা হাত কর্মের প্রতীক। মানুষের মৃত্যুর পর জীবাত্মা দেবীর অঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে থাকে, তিনি আবার সমস্ত কর্মের ফলদাত্রী। পরবর্তী জন্মে তাদের কর্মফল অনুসারে বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন গর্ভে জন্মগ্রহণ করে থাকে।

দীপাবলি ও আলোর উৎসব

শ্রী শ্রী কালী মা সাক্ষাৎ ব্রহ্মময়ী । তিনি আমাদের অবিদ্যা রুপিনী অন্ধকার কে নাশ করে আমাদের জ্ঞান দেন , চেতনা দেন । তাঁর ত্রিনয়ন চন্দ্র , সূর্য , অগ্নি । তার লোমকূপ সকল কোটি কোটি প্রতীপ্ত তারকা । তার আবির্ভাবে অন্ধকার ময় অবিদ্যা , আসুরিক শক্তি নাশ হয়ে যায় । তাই কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায় আমরা শত শত প্রদীপের আলোকমালায় সেই জগত মাতাকে বরন করে নেই । প্রার্থনা জানাই তিনি যেন আমাদের অন্ধকার অবিদ্যার জাল থেকে মুক্ত করে দেন ।

কেন মা চতুর্ভুজা?

শ্রীশ্রী কালী চতুর্ভুজা। সকাম ও নিষ্কাম, সাধক সাধারণত এই দুই প্রকার। সকাম সাধন সংসারে সাফল্য চান আর নিষ্কাম সাধক চান মুক্তি। মায়ের দক্ষিণ হাতে সকাম সাধককে অভয় ও বর দিচ্ছেন আর বাম হাতে খড়গ দ্বারা নিষ্কাম সাধককে মোহপাশ ছিন্ন করতে বলছেন। কালো কেশ আকর্ষণ করে মা তমোগুণকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলছেন। যেহেতু রক্ত রাজসিক গুণের প্রতীক তাই মা মস্তিষ্ক থেকে অসারিত রুধির ধারা শোষিত করে সত্ত্বগুণে উন্নীত হতে শিক্ষা দিচ্ছেন।

মা কালী ও সৃষ্টিঃ

কালিকাপুরাণে আমরা দেখি আদি শক্তি রূপে তিনি যোগীদের মন্ত্র ও তন্ত্র উদঘাটনে তত্‍পর। তিনি চতুর্ভূজা, খড়্গধারিণী, বরাভয়দায়িনী, নরমুণ্ডধারিণী। তিনি লোলজিহ্বা ও মুণ্ডমালা বিভূষিতা। তিনি মুক্তকেশী, কৃষ্ণবর্ণা, শিববক্ষে দণ্ডায়মানা মাতৃমূর্তি। তিনি মূলত শাক্তদের দ্বারা পূজিতা হন এবং একাধার দশমহাবিদ্যার প্রথমা দেবী ও বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। অন্ধকারবিনাষিণী তিনিই, দেবতা তথা শুভাশুভ শক্তির সম্মিলিত রূপ। ”ওঁ করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভূজাম। কালিকাং দৃক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালা বিভূষিতাম।।” প্রাক আর্য যুগ থেকেই ভারতে শক্তি উপাসনা প্রচলিত। সেই যুগে মানুষ প্রাকৃতিক শক্তির ভয়াল রূপকে ঠিক মতো ব্যাখ্যা করতে পারত না। প্রাকৃতিক নানান দুর্যোগের কাছে তারা তখন নিতান্ত অসহায়। সেই হেতু তারা সেই সমস্ত অলৌকিক ও দুর্জয় শক্তিকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করতেন। প্রকৃতিকে স্বয়ং শস্যশ্যামলা মাতৃরূপে তথা মাতৃশক্তিরূপিনী জগদম্বা রূপে কল্পনা করা হত। শ্রীশ্রীচণ্ডীতেও মহামায়াকে পরাশক্তির আদাররূপিনী রূপে কল্পনা করা হয়েছে। কালিকা পুরাণে আমরা দেখি, আদি শক্তিরূপে তিনি যোগীদের মন্ত্র ও মন্ত্রের মর্ম উদঘাটনে তত্‍পর। পরমানন্দা সত্ত্ববিদ্যাধারিণী জগন্ময়ী রূপ তাঁর। বীজ থেকে যেমন অঙ্কুরের নির্গমন হয় এবং জীবের ক্রমবিকাশ হয় তেমনই সেই সব সৃজনই তাঁর সৃষ্টিশক্তি।

শ্যামাকালী আর দক্ষিণাকালীর মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে কিঃ

দক্ষিণা কালী

চলছে কৃষ্ণপক্ষ। আর মাত্র কয়েকদিন পরই শক্তির আরাধনায় মাতবে বাংলা। শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপুজো খুবই ধুমধাম করে পালন করা হয়। যে কোনও পুজো ঘিরেই বহু গল্প প্রচলিত থাকে। তেমনই রয়েছে কালীকে ঘিরেও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর আদেশ পাওয়ার পরই পুজো শুরু হয় সর্বত্র। কেউ শ্মশান কালী, কেউ ডাকাত কালী আবার কেউ শ্যামা মা হিসেবেই পরিচিত। আদ্যাপীঠ হোক কিংবা ত্রিপুরেশ্বরী সকলে পুজো পান কালী হিসেবেই। তবে বেশিরভাগ মন্দিরেই যে কালীমূর্তি আমরা দেখি তা কিন্তু দক্ষিণাকালীর।

কথিত আছে, রামপ্রসাদ সেনের গুরু কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বপ্নে আদেশ পান কালীর প্রসন্ন ভাবমূর্তি রচনা করার। স্বপ্নে দেবী তাকে জানান পরবর্তী ভোরে যে নারীকে তিনি সর্বপ্রথম দেখবেন তার রূপ অনুযায়ী কালীর এক প্রসন্ন প্রতিমূর্তি তৈরী করতে। পরবর্তী ভোরে যে নারীকে প্রথম সে দেখেন তিনি কৃষ্ণবর্ণা, তার ডান পা সামনে, উন্মুক্ত কালো কেশ এবং বাম হাত উত্তোলনের দ্বারা দেয়ালে গোবর স্থাপন করছেন। আকস্মিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে সামনে দেখে সেই মহিলা খুব লজ্জা পেলেন এবং তার জিহ্বা বার করে দাঁত দিয়ে চাপলেন। সেই নারীর রূপ অনুসরণ করে আগমবাগীশ মহাশয় কালীর মূর্তিতত্ত্ব অনুযায়ী দক্ষিণা কালীর মূর্তি রচনা করেছিলেন। এর আগে কালী যন্ত্রে কালীপূজা হতো।

দক্ষিণা কালীর ডান পা শিবের বুকে। তিনি কালীর অন্যান্য রূপ থেকে ভিন্ন এবং তাকে ঘর এবং মন্দিরে পূজা করা হয়। দক্ষিণাকালী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তার বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুগলে বর ও অভয় মুদ্রা। তার গাত্রবর্ণ গভীর নীল, আকাশ এবং নীল সমুদ্রের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। তার গলায় মুণ্ডমালার হার; কর্ণে দুই শবরূপী কর্ণাবতংস; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। তার দন্ত উজ্জ্বল শ্বেতবর্ণ; তার স্তনযুগল উন্নত; তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দণ্ডায়মান। তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী। তার, দীর্ঘ এবং কালো চুল সভ্যতা থেকে প্রকৃতির স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে। দক্ষিণা কালীর তৃতীয় চক্ষুর নিচে সূর্য, চন্দ্র এবং অগ্নির প্রতীক দেখা যায় এবং এটি প্রকৃতির চালিকা শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। আবার কথিত আছে দক্ষিণদিকের অধিপতি যম কালীর ভয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করেছিলেন, সে জন্য তাঁর নাম দক্ষিণাকালী। দক্ষিণেশ্বরে যে কালীর পুজো করা হয় তিনি দক্ষিণা কালী। কালীঘাট, তারাপীঠ এসব শক্তিপীঠ হিসেবে খ্যাত। এখানে যে কালীর পুজো হয় মূলত তাঁরাও দক্ষিণা কালী হিসেবেই পুজো পান।

শ্যামাকালী

কালীপুজোর আগে আমরা রাস্তায় দুরকম কালীমূর্তি দেখতে পাই। একজনের গাত্রবর্ণ কালো, অন্যজনের তুঁতে। মূলত কালো ও নীলের মাঝে যে কালীর গাত্রবজ্ঞণ তা শ্যামাকালী নামে পরিচিত। এই মূর্তি তুলনায় অনেক কম দেখা যায়। দশমহাবিদ্যার অন্যতম এই দেবীর ভয়ঙ্করী রূপটিকে খানিকটা নরম করে দেখাতেই হয়তো এক সময় তাঁর গাত্রবর্ণ নীল রঙের দেখানোর প্রচলন শুরু হয়েছিল, সাহিত্য এবং শ্যামাসঙ্গীতেও তাঁর শ্যামা রূপটির উল্লেখ মেলে। পঞ্চমুণ্ডির আসনে পুজো হলেও কোনও বলি হয় না। পুরোপুরি বৈষ্ণব মতেই পুজো হয়। এই কালীকে ঘরের মেয়ে হিসেবেই পুজো করা হয়। অন্যদিকে দক্ষিণাকালী পুজো পান মা রূপেই।

পূজানুষ্ঠান

দুর্গাপূজার মতো কালীপূজাতেও গৃহে বা মণ্ডপে মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করা হয়। মন্দিরে বা গৃহে প্রতিষ্ঠিত প্রস্তরময়ী বা ধাতুপ্রতিমাতেও কালীপূজা করা হয়। মধ্যরাত্রে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দেবীকে ছিন্নমস্তক সহ বলির পশুর রক্ত, মিষ্টান্ন, অন্ন বা লুচি, মাছ ও মাংস উৎসর্গ করা হয়। গৃহস্থবাড়িতে সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যমতে আদ্যাশক্তি কালীর রূপে কালীর পূজা হয়। দেবীর পূজায় ছাগ মেষ বা মহিষ বলির প্রথা রয়েছে। সুদূর অতীতে নরবলি দিয়েও কালীপূজা হত। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কালী শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই কারণে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে শ্মশানে মহাধুমধামসহ শ্মশানকালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

কোনো কোনো মণ্ডপে কালী ও শিবের মূর্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার দুই বিখ্যাত কালীসাধক রামকৃষ্ণ পরমহংস ও বামাখ্যাপার মূর্তিও পূজিত হয়। কোথাও কোথাও কালীর সঙ্গে সঙ্গে দশমহাবিদ্যাও পূজিত হন। দর্শনার্থীরা সারারাত ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে কালীপ্রতিমা দর্শন করেন। কালীপূজার রাতে গৃহে আলোকসজ্জা সাজানো হয় এবং আতসবাজি পোড়ানো হয়।

কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে এই দিন দেবী কালীকে লক্ষ্মীরূপে পূজা করা হয়। হাজার হাজার ভক্ত এই দিন কালীঘাট মন্দিরে ভিড় করেন এবং দেবীর উদ্দেশ্যে বলি উৎসর্গ করেন। কলকাতার অপর বিখ্যাত কালীমন্দির দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতেও কালীপূজা উপলক্ষে মহাসমারোহ হয়। এইখানেই অতীতে রামকৃষ্ণ পরমহংস কালী আরাধনা করেছিলেন। সেই কারণে এই মন্দিরে কালীপূজা দেখতে প্রচুর পুণ্যার্থী এখানে ভিড় জমান।

মদ-মাংস লাগে কালীপুজোয়, জেনে নিন পাঁচ ‘ম’-এর রহস্য

কোন কোন জন্তুর মাংস প্রশস্ত তন্ত্রে তার উল্লেখ রয়েছে। এই সব প্রাণীদের মধ্যে ছাগ, মেষ, সজারু, হরিণ, সারস, হাঁস, বন্যকুক্কুট প্রভৃতির কথা বলা হয়েছে।‘নির্বাণতন্ত্র’-এ বলা হয়েছে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন— এই পাঁচটি পঞ্চম-কার। সাধকরা এই পঞ্চম-কার দিয়ে শক্তি আরাধনা করে থাকেন। অদ্বৈতভাব পরায়ণ ব্রহ্মনিষ্ঠ সাধকই পঞ্চতত্ত্বযুক্ত সাধনার অধিকারী। পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে পঞ্চমহাভূতকে দেখানো হয়েছে।

পঞ্চতত্ত্বের তিনটি প্রকারভেদ রয়েছে। ১. প্রত্যক্ষতত্ত্ব ২. অনুকল্পতত্ত্ব ৩. দিত্বতত্ত্ব।

প্রত্যক্ষতত্ত্বে মদ প্রসঙ্গে ‘পরশুরামকল্পসূত্র’-এ তাল খেজুর প্রভৃতি গাছের রস থেকে উৎপন্ন বা গাছের ছাল বা ফুল থেকে তৈরি মদের কথা বলা হয়েছে। অনুকল্পতত্ত্বের ব্যাখ্যায় মদ প্রসঙ্গে কাঁসার পাত্রে নারকেলের জল বা তামার পাত্রে দুধ প্রভৃতি বলা হয়েছে। দিব্যতন্ত্রের ব্যাখ্যায় মদ প্রসঙ্গে ‘ভৈরব যামল’-এ বলা হয়েছে, ব্রহ্মরন্ধ্রস্থিত সহস্রারপদ্মস্থ চন্দ্রকলা থেকে বিগলিত অমৃতধারাই সাধকের পেয়সুধা।

কোন কোন জন্তুর মাংস প্রশস্ত তন্ত্রে তার উল্লেখ রয়েছে। এই সব প্রাণীদের মধ্যে ছাগ, মেষ, সজারু, হরিণ, সারস, হাঁস, বন্যকুক্কুট প্রভৃতির কথা বলা হয়েছে। তন্ত্রমতে, শাল, বোয়াল ও রোহিত— এই তিন রকমের মাছ উত্তম। কাঁটাশূন্য তৈলাক্ত মাছ মধ্যম ও মৎস্যক্ষুদ্র হলে অধম। তন্ত্র মতে, যা চর্বণীয় তাই মুদ্রা। যেমন ছোলা বা মাষকলাই দিয়ে তৈরি ঘি অথবা তেলে ভাজা দ্রব্য মুদ্রা। আর যুগলের সংযোগে মৈথুন। সাধনার অঙ্গীভূত মুখ্য মৈথুন শিবস্বরূপ সাধকের সঙ্গে শিবস্বরূপিনী সাধিকার সংযোগ।

অনুকল্পতত্ত্বের ব্যাখ্যায় ‘ডামরতন্ত্র’ মতে, মাংসের অনুকল্প পিঠে। কৌলাবনী নির্ণয় অনুসারে মহিষদুগ্ধ, গোদুদ্ধ, ছাগদুগ্ধ এবং ফলমূল দগ্ধ হলেই আমিষ হয়ে যায়। নৈবেদ্যই মুদ্রা। আর মৈথুন প্রসঙ্গে ‘যোগিনীতন্ত্র’ বলা হয়েছে, রক্তকরবী লিঙ্গপুষ্প এবং কৃষ্ণ অপরাজিতা যোনিপুষ্প। এই উভয়ের সংযোগ পঞ্চমতত্ত্বের অনুকল্প।

দিব্যতত্ত্বের ব্যাখ্যায় মাংস প্রসঙ্গে ‘কুলার্ণবতন্ত্র’-এ বলা হয়েছে— জ্ঞান খড়গের দ্বারা পূণ্যাপুণ্য রূপ পশুকে বধ করে পরশিবে চিত্ত লয় করার নাম ‘মাংস’। ‘মৎস্য’ প্রসঙ্গে ‘আগমসার’-এ বলা হয়েছে— গঙ্গা ও যমুনার মধ্যে দু’টি মৎস্য সর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছে। যিনি মৎস্য দু’টি ভক্ষণ করতে পারেন তিনি মৎস্য সাধক। গঙ্গা ও যমুনা হচ্ছে ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী। মাছদু’টি ইড়া ও পিঙ্গলাতে প্রবাহিত নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাস। যিনি কুম্ভক করে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস রোধ করতে পারেন, অর্থাৎ এইভাবে মনস্থির করতে পারেন, তিনি মৎস্যসাধক। অসৎসঙ্গ পরিত্যাগকে ‘মুদ্রা’ বলা হয়। আর সাধক দেহে শিব-শক্তি মিলনই মৈথুন। পঞ্চতত্ত্ব সাধনা অদ্বৈতভাবের সাধনা। একমাত্র গুরুর কাছেই এই সাধনার ক্রিয়াকলাপ শিখতে হয়।

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মা কালীঃ

কালীকে যদি, বলি কল্পনা তবে সেই কল্পনাও ধর্মে বর্ণিত হয়েছে বর্তমান বিজ্ঞানের ধারণার হাজার হাজার বছর আগে। এ কথা বিজ্ঞান প্রথমতঃ স্বীকার করে যে, সৃষ্টির আদি যুগে অনন্ত ব্রহ্মা- ছিল নিকষ কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত, নিশ্চিদ্র তমসায় আবৃত, অনন্ত সৃষ্টিতে তখনো আলোর সৃষ্টি হয়নি। রবি শশী তারা বা কোন আলোকবর্তিকা তখনো ছিলনা। বিজ্ঞান মতে আলোর সৃষ্টির আগে অন্ধকার ছিল। এ বর্ণনায় কান পেতে শুনলে আমরা দেখি কৃষ্ণবর্ণা মা কালী সেই যুগের প্রতিনিধিত্ব করছেন। ধর্ম ও বিজ্ঞানের এখানে অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। দ্বিতীয়তঃ বিজ্ঞানের ‘বিগ্ ব্যাংগ্ তত্ত্ব’ মতে কাল বা সময় তখন সবে মাত্র সৃষ্টি হয়েছে, কাল্ বা সময় যখন সৃষ্টি হলো তথা যে দিন ভূমিষ্ঠ হলো, সেদিন নির্ধারিত হলো সেই কালেরও শেষ আছে, সংহার আছে। বিশ্ব ব্রহ্মা- সৃষ্টি যখন হয়েছে সময় এলে তা ধ্বংসও হবে। তার লয়ও অবশ্যম্ভাবী। কালী এই সংহারের প্রতিভূ, তিনি কাল এর জীবন্তকালের সীমারেখার নির্ধারণকৃত। তৃতীয়তঃ বিজ্ঞানীরা সৃষ্টির প্রথম যুগের মহাবিশ্বের যে বর্ণনা দেন তা ভয়াল ভীষণ তার মধ্যে সৃষ্টির চাইতে ধ্বংসই বেশী। প্রবল সংহারের মধ্যে দিয়ে অনন্ত ব্রহ্মা-ের সৃষ্টি। মা কালী সেই সংহারের প্রতিভূ তিনি ভয়াল দর্শনা সংহারের দেবী। সৃষ্টির সেই ক্রমবিকাশের যুগেই মা কালী মা জগজ্জননী প্রবল সংহারের মধ্যে দিয়েই তাঁর সৃষ্টি ও তাঁর কল্যাণময় রূপকে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। মা কালী যুগপৎ কাল, কৃষ্ণবর্ণ এবং সংহারের দেবী। কিছুই ছিল না, তখন দেবী ছিলেন। এই মাতৃপূজা মাতৃমূর্তি হিন্দুধর্মের আদিকথা।

দেশপ্রেম ও মা কালীঃ

ব্রিটিশ শাসিত বাংলা তথা ভারতে কালী উপাসনা বিশেষ তাৎপর্য পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। পরাধীন জাতির অন্তরের ক্ষোভ আর প্রতিবাদের উচ্চারণ কালীর দৃপ্ত ব্যক্তিত্বকে অনুসরন করতে চাইত। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ হিসেবে শক্তি আরাধনা তথা কালী উপাসনার প্রচলনের বহু প্রমান পাওয়া যায়। কালীর তেজোময়ী, লড়াকু ভাবময়তা তৎকালীন বিপ্লবীদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। প্রখর নারী সত্ত্বা যা ছিল উপেক্ষিত, বিপর্যয়ের ক্ষণে তা দৈবী স্বরূপে স্বীকৃত হয়। অপর কারণটি ছিল কালী সম্পর্কে শাসক জাতির অবহেলা মিশ্রিত আতঙ্ক ও ভয়। এই উগ্র ভয়াল প্রায় নগ্ন রূপ ব্রিটিশ মানসিকতাকে সজোরে আঘাত করে।

বাংলার রক্তক্ষরা বিপ্লব ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হয়ে উঠলেন মহাকালী। তাঁর সমগ্র ভাগবতী প্রকৃতি ঝঞ্ঝারুদ্র কর্মের প্রভায় প্রস্ফুরিত, তিনি রয়েছেন ক্ষিপ্রতার জন্য আশফুলদায়ী প্রক্রিয়ার জন্য, সাক্ষাৎ সঘন আঘাতে সব পরাভূত করে সম্মুখ আক্রমণের জন্য (শ্রীঅরবিন্দ)। অভয়ের ভগবতী মূর্তি রূপে মহাকালী বাংলার যুবসমাজের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেন। কালী অনুধ্যান কালানলের মত জ্বলে উঠল। বাংলার কালীসাধনার নতুন মহিমা প্রকাশ পেল। আদ্যাশক্তি মহামায়া বীর সন্তানের কাছেও ধরা দিলেন। বাংলার এই বীরভাবের সাধনার রূপটি বিবেকানন্দের কথায় ফুটে উঠেছে— “যাঁরা প্রকৃত মায়ের ভক্ত, তাঁরা পাথরের মত শক্ত, সিংহের মত নির্ভীক। মাকে তোমার কথা শুনতে বাধ্য কর। তাঁর কাছে খোসামোদ কি? জবরদস্তি। তিনি সব করতে পারেন।” বীরসাধনার অন্য পরিচয় দেখি বিবেকানন্দের কবিতায়

রে উন্মাদ, আপনা ভুলাও, ফিরে নাহি
চাও, পাছে দেখ ভয়ঙ্করা।
দুখ চাও, সুখ হবে বলে, ভক্তিপূজাছলে
স্বার্থ-সিদ্ধি মনে ভরা।
ছাগকণ্ঠ রুধিরের ধার, ভয়ের সঞ্চার
দেখে তোর হিয়া কাঁপে
কাপুরুষ! দয়ার আধার! ধন্য ব্যবহার
মর্মকথা বলি কাকে?

জগতজননী মা ও ভারতমাতা অভিন্না । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ‘আনন্দমঠ’ তিনি ভারতমাতা ও মহিষমর্দিনী দুর্গাকে এক বলে বর্ণনা করেছেন ।

“ বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি গড়ি মন্দিরে মন্দিরে ।
ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরনধারিনী
কমলা কমল – দলবিহারিণী ”

এই যে মা হইবেন । দশ ভুজ দশ দিকে প্রসারিত ,- তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত , পদতলে শ্ত্রু বিমর্দিত , পদাশ্রিত , বীরকেশরী , শ্ত্রুনিপীড়নে নিযুক্ত । দিগভুজা ” (আনন্দমঠ / একাদশ পরিচ্ছেদ )
পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতীয় বিপ্লবীরা ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যখন প্রস্তুত হতেন – প্রথমেই নিতে হত জগত জননী কালী মায়ের আশীর্বাদ । কথিত আছে বিপ্লবী রা কালীঘাট বা তারাপীঠ গিয়ে দেবীর চরণ ছুয়ে দেশমাতৃকার উদ্ধার এর জন্য কঠোর সংকল্প নিতেন । ফাঁসীর আগে যখন ক্ষুদিরাম কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল “ অন্তিম ইচ্ছা কি? ” ক্ষুদিরাম জানিয়েছিলেন , তিনি দেবী চতুর্ভুজার প্রসাদ খেতে চান । ( আঠেরোর দীপ্তশিখা ক্ষুদিরাম/ লেখক- সুশান্তকুমার সাহিত্যরত্ন)

পশ্চিমবঙ্গের ৭টি জাগ্রত কালী মন্দির

আজ শক্তি আরাধনার দিন। আদ্যশক্তি কালী মা’কে আজ ভক্তি ভরে সারা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের সকল ধর্মনিষ্ঠ হিন্দুরা পূজা করবেন। মা কালী শক্তির অন্যতম উৎস রূপে শক্তির অন্যতম উৎস রূপে যুগ যুগ ধরে পূজিত হয়ে আসছেন। তান্ত্রিক মত থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ্য মত সকল মতেই এই শক্তির আরাধনা করা হয় অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। আমরা জানি সারাদেশ জুড়ে ৫১টি সতীপীঠ ছড়িয়ে আছে এবং সেই পীঠস্থানগুলিতে সারা বছরে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। পশ্চিমবঙ্গেও ছড়িয়ে আছে এরকম বিশেষ কিছু সতীপীঠ এবং জাগ্রত কালী মায়ের মন্দির। যেখানে ভক্তরা বারবার ছুটে যান মায়ের পূজার উপলক্ষে এবং মায়ের কাছে তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করার কামনা জানান। এই সব জাগ্রত সতীপীঠ এবং মন্দিরে মা ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন বলেই শত শত বছর ধরে এই সব মন্দিরের মাহাত্ম্য লোকমুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে । দীপান্বিতা কালীপূজার এই শুভ লগ্নে আজ আমরা আমাদের প্রতিবেদনা তুলে ধরব এইসব বিশেষ মন্দিরের নাম এবং মাহাত্ম্য কথা

কীর্তিশ্বরী মন্দির, মুর্শিদাবাদ

৫১ পীঠের অন্যতম মন্দিরগুলির মধ্যে এই মন্দির হল একটি। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত এই মন্দিরটি এই জেলার অন্যতম প্রাচীন কালী মন্দির। এই মন্দিরের পুরাতন কাঠামো বর্তমানে নষ্ট হয়ে গেলেও গেলেও নতুন আঙ্গিকে এই মন্দির গড়ে তোলেন ঊনিশ শতকে রাজা বা জমিদার দর্প নারায়ণ। অত্যন্ত জাগ্রত মন্দির বলে প্রসিদ্ধ সারা বাংলা জুড়ে এই মন্দির। সারা মুর্শিদাবাদ তথা পশ্চিমবঙ্গ এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো থেকে নানা ধর্মপ্রাণ ধর্মপ্রাণ থেকে নানা ধর্মপ্রাণ থেকে নানা ধর্মপ্রাণ মায়ের উপাসকরা এই মন্দিরে ভক্তিভরে পূজা দিয়ে যান দিয়ে যান এবং তাদের মনষ্কামনা পূর্ণ করেন বলেই এই মন্দিরের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাচীন এই মন্দিরটি মুক্তেশ্বরী মন্দির নামেও পরিচিত। দেবী সতীর মুকুট এই স্থানে স্থানে পড়েছিলে বলে মনে করা হয় এই মন্দিরে বিশেষ কোন বিগ্রহের পূজা করা হয় না একটি কালো পাথরকেই বিগ্রহ রূপে পূজা করা হয়ে থাকে।

কঙ্কালীতলা মন্দির, বোলপুর

৫১ পীঠের অন্যতম শেষ পীঠ এই মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের নিকট অবস্থিত। এখানে দেবী সতীর কঙ্কাল অথবা কোমর পড়েছিল পড়েছিল বলে মনে করা হয়। অত্যন্ত জাগ্রত এই মন্দিরটি কোন বিগ্রহ বা প্রতিমা পুজো করা হয়ে থাকে না। ভক্তিভরে সারা বছর ধরে প্রতিটি আমাবস্যায় এই মন্দিরে পূজা দিয়ে যান হাজার হাজার হাজার ভক্তরা। কথিত আছে এই মন্দিরে দেবী সতীর কোমর পড়েছিল এবং সেই কোমরকে ভগবান শিব স্বয়ং এক কুন্ডের মধ্যে কুন্ডের মধ্যে মধ্যে এক কুন্ডের মধ্যে কুন্ডের মধ্যে মধ্যে গুপ্ত অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন। আর তাই এই মন্দিরের কুণ্ডটি অত্যন্ত পবিত্র কুণ্ড বলে ধরা হয়ে থাকে। এছাড়াও বলা হয়ে থাকে এই কুন্ডলীর সঙ্গে মণিকর্ণিকা মণিকর্ণিকা নদীর গুপ্ত সংযোগ আছে এবং বছরের কোন সময়ই এই কুন্ডের জল শুকিয়ে যায় না এবং বর্ষাকালেও উপচে উপরেও উঠে না ।প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসে বাৎসরিক পূজার সময় মা কালীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করা হয়ে থাকে। এছাড়াও মন্দির সংলগ্ন সংলগ্ন শ্মশান ঘাটে প্রতিদিন শত শত শব দাহ করা হয়ে থাকে। তবে বাৎসরিক পূজার সময় পূজা অনুষ্ঠান শুরু হয় না যতক্ষণ না পর্যন্ত এই শ্মশানে কোন শব দাহ করা না হয়।

কনকদুর্গা মন্দির, ঝাড়গ্রাম

পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রাম এর চিল্কিগড় এর এর অবস্থিত এই মন্দিরটি সমগ্র বাংলার ধর্মপ্রাণ মানুষদের কাছে অত্যন্ত জাগ্রত মন্দির। মন্দিরটি জঙ্গলঘেরা গা-ছমছমে গা-ছমছমে এক জায়গার মধ্যে অবস্থিত ।কথিত আছে এই মন্দিরে পূর্বে নরবলি প্রথা চালু ছিল ।এই মন্দিরটি অত্যন্ত জাগ্রত একটি মন্দির ।এই মন্দিরে এসে মনষ্কামনা করলে তা মা পূরণ করেন বলে জানা যায়। শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরটির বজ্রপাতে সম্পূর্ণভাবে দ্বিখন্ডিত হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে নতুন করে নব মন্দির স্থাপনা করা হয়েছে। পূর্বের মন্দিরের পাশেই নতুন মন্দিরটি পূর্বমুখী। পশ্চিমবঙ্গের ৭টি জাগ্রত কালী মন্দির; যেখানে গেলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবেইপ্রাচীন মন্দিরের গায়ে আর্য এবং অনার্য ভাবধারার সংমিশ্রণ এবং উড়িষ্যা ঘরানার নিদর্শন দেখা যায়।প্রাচীন মন্দিরটি একটি বিষ্ণু মন্দির ছিল বলেই অনুমান করেন অনেকেই মন্দিরের শীর্ষে লাগা চক্র দেখে। ঢুলুঙ নদীর তীরেই অবস্থিত এই মন্দিরটি।এই মন্দিরের আরাধ্য দেবী কনক দুর্গা।এখানে দেবী দুর্গার মহাভোগে হাঁসের ডিমও দেওয়া হয়। পুরাতন বর্তমানে পরিত্যক্ত এই মন্দিরটি চিল্কিগড় এর রাজা নির্মাণ করেছিলেন। কালিকা পুরাণ মতে এবং তন্ত্র মতে এই দেবীর নিত্য পূজা হয়ে থাকে হয়ে থাকে হয়ে থাকে এবং নিত্য পূজাতেও ডিম ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে। এছাড়াও মন্দির সংলগ্ন স্থানে নানা শিবলিঙ্গের দেখা মেলে এবং কথিত আছে এখানে ১০৮টি শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন চিল্কিগড় এর রাজারা।

সর্বমঙ্গলা মন্দির,গড়বেতা

কথিত আছে রাজা বিক্রমাদিত্য শব দেহের উপর বসে এই মন্দিরের দেবীকে তুষ্ট করেছিলেন। এছাড়াও জনমতে শোনা যায় এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। এছাড়াও কথিত আছে এক রাতের মধ্যেই এই খানে সাতটি পুকুর খনন করা হয়েছিল এবং এই পুকুরের মধ্যেই এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। এই মন্দিরের আরাধ্য দেবী সর্ব মঙ্গলা এখানে দেবীর অষ্টধাতুর। দশোভূজা মূর্তি দেখা যায় যদিও পোশাকের এবং আবরণী দিয়ে ঢাকা থাকে তার দেহ।

তারাপীঠ, বীরভূম

সারা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের অন্যতম সতীপীঠের একটি হলো তারাপীঠ । কথিত আছে এই মন্দিরে দেবী সতীর ত্রিনয়ন পড়েছিল। এখানে দেবী পূজিতা হন মা তারা রূপে। এই মন্দির জুড়ে নানা লোককথা প্রচলিত আছে। শোনা যায় সাধক বামাক্ষ্যাপা এই মন্দিরে মা তারার পূজা করতেন এবং পাশেই শ্মশান ক্ষেত্রে তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। এই মন্দিরে কোন বিগ্রহ পূজা করা হয় না, একটি পাথরকে বিগ্রহ রূপে পূজা করা হয়ে থাকে। যদিও এই পাথরের উপর মা তারার প্রতিকৃতি এবং পদচিহ্ন বসিয়ে ভক্তি সহকারে পূজা করা হয়ে থাকে। সারা বছর ধরে লক্ষ লক্ষ ভক্তরা এই মন্দিরে পূজা দিয়ে যান। এই মন্দিরের পাশেই শ্মশান ক্ষেত্র তান্ত্রিক এবং মন্ত্র সাধকদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জায়গা হিসেবে পরিগণিত হয়। কৌশিকী অমাবস্যার দিন এই মন্দিরে অত্যন্ত জনসমাগম হয়ে থাকে।

দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির, কলকাতা

কলকাতা শহরের বিখ্যাত কালী মন্দির হল দক্ষিণেশ্বর হল দক্ষিণেশ্বর দক্ষিণেশ্বর মন্দির হল দক্ষিণেশ্বর হল দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির।১২৬২ বঙ্গাব্দে১৮ই জ্যৈষ্ঠ এবং ইংরেজি ১৮৫৫ খ্রি:৩১শে মে এই মন্দিরটি স্থাপনা করা হয়। এই মন্দিরের আরাধ্য দেবী হলেন ভবতারিণী দেবী। রানী রাসমণি এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন । এই মন্দিরে দেবী কালীকে ভবতারিণী রূপে পূজা করা হয়। উনবিংশ শতাব্দীর পরম যোগী শ্রীরামকৃষ্ণ দেব এই মন্দিরে দেবী কালিকাকে মাতৃ রূপে পূজা করতেন। কথিত আছে রাণী রাসমণি মা কালীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের দাদা রামকুমার ছিলেন এই মন্দিরের প্রথম এবং প্রধান পুরোহিত। মূল মন্দিরটি একটি নবরত্ন মন্দির। মূল মন্দির ছাড়াও এই মন্দির প্রাঙ্গনে রয়েছে দ্বাদশ শিব মন্দির শিব মন্দির গুলি প্রত্যেকটি আটচালা শিবমন্দির।

কালীঘাট মন্দির, কলকাতা

সতীপীঠের অন্যতম একটি মন্দির হল কালীঘাট মন্দির । কথিত আছে এখানে পুরান মতে দেবী সতীর ডান পায়ের চারটি বা অনেকের মতে একটি অঙ্গুলি এই পীঠে পড়েছিল। কালীঘাটের এই মন্দিরটি হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত এটি হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত এটি নদীর তীরে অবস্থিত এটি প্রায় দুই শতাব্দী প্রাচীন এক মন্দির। এই মন্দিরের স্থাপন সম্পর্কে অনেক কথা লোকমুখে শোনা যায় ,কথিত আছে এই হুগলি নদী তীরে এক ব্রাহ্মণ সাধনা করছিলেন এবং তিনি দেখেন নদীর নিকটস্থ একই স্থান থেকে অলৌকিক আলো আস্তে দেখেন তখন তিনি সেই উদ্দেশ্যে গমন করেন কাছে গিয়ে তিনি দেখেন একটি আঙ্গুলের মতো মূর্তি । তিনি সেটি তুলে নিয়ে এসে পূজা করতে শুরু করেন। মূল মন্দিরটি ৬ টি খন্ডে বিভক্ত নাটমন্দির,ষষ্ঠী তলা, হাড়কাঠতলা,রাধাকৃষ্ণ মন্দির,চোর বাংলা, কুন্ড পুকুর। বর্তমানে যে মূর্তিটি পূজা করা হয় সেটি কষ্টি পাথরের তৈরি।এছাড়াও সোনা এবং রুপার অলংকার ধাতু নিয়ে এই মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। সালে এই মূর্তির জিভটি পাল্টানো হয় জীভটি ২কিলোগ্রাম রুপো এবং ৫১৬গ্রাম সোনা দিয়ে তৈরি করা। এছাড়াও দেবীর খড়গটি ২কেজি সোনা দিয়ে তৈরি। লোক মুখে শোনা যায় পূর্বে এই মন্দিরে নিয়মিত ছাগ বলি দেওয়া হতো। বর্তমানে বিশেষ বিশেষ দিনে এই ছাগ বলি দেওয়া হয়। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে দেবীকে স্নান করানো হয় যা “স্নানযাত্রা” নামে পরিচিত। ভক্তদের কাছে এই মন্দিরটি অত্যন্ত জাগ্রত মন্দির নামে পরিচিত।

বাংলাদেশে প্রসিদ্ধ কালী মন্দির সমূহঃ

বাংলাদেশে অনেক কালী মন্দির আছে। এর অনেকগুলোই সুপ্রাচীন। অধুনা লুপ্ত ঢাকার রমনা কালী মন্দির তেমনি একটি পুরাতন কালী মন্দির। ব্রহ্মযামলে উল্লেখ আছে ‘কালিকা বঙ্গদেশে চ’, অর্থাৎ, ‘বঙ্গদেশে দেবী কালিকা বা কালী নামে পূজিতা হন।’ চট্টগ্রাম শহরের চট্টেশ্বরী শ্রী কালীবাড়ী, গোলপাহাড় শ্মশান কালীবাড়ী, দেওয়ানহাটের দেওয়ানেশ্বরী কালীবাড়ী,সদরঘাট কালীবাড়ী, পটিয়া পিঙ্গলা কালীবাড়ী, ধলঘাট বুড়াকালীবাড়ী সহ চট্টগ্রামে অনেক প্রসিদ্ধ কালী মন্দির বর্তমান। এর প্রায় প্রত্যেকটিতে প্রত্যেক শনি ও মঙ্গলবার এবং অমাবস্যায় কালীপূজা হয়। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা’র দিন কালীপূজা বিশেষভাবে পালিত হয়।

ইতিহাস

বর্তমান সময়ের দীপান্বিতা উৎসব যদি মোহনা হয় তবে এই তরঙ্গিনীর উৎস সম্পর্কে আগ্রহ স্বাভাবিক। এই অনুসন্ধান সহজ নয়। কালের প্রবাহে উপনদীর মতো অসংখ্য উপগাথা এসে মিশে গেছে মূল তথ্যে – আজ তাদের পৃথক করা বেশ কঠিন কাজ। অনেক সময়ই অসম্ভব। তবে প্রতিটি অংশই অতীব চিত্তাকর্ষক তাতে সন্দেহ নেই। পুরান তথা বিভিন্ন সাহিত্য থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কালীর বর্তমান রূপ পরিগ্রহে সময় লেগেছে অন্তত দুই হাজার বছর। কালীর বৈদিক পরিচয় অথর্ব বেদের সুত্রে। এই বেদে প্রথম কালীর স্বরূপ প্রকাশিত হয়। তবে মার্কণ্ডেয় পুরাণ, কালিকা পুরাণ ইত্যাদিতে ও কালীর উল্ল্যেখ পাওয়া যায়। মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে কালরাত্রি নাম্নী এক দেবীর বর্ণনা পাই। এই দেবী কালিকারই অন্য রূপ বলে উল্লিখিত হয়ে থাকে। অরিজিন খুঁজতে গিয়ে দেবী কালীর প্রথম পর্যায়ের সাথে অনার্য সম্বন্ধের সম্ভাবনা জোরালো ভাবে উঠে আসে। হরপ্পা – মহেঞ্জদরো সভ্যতায় মাতৃ পূজা প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। এই সভ্যতা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। পূজিতা এই দেবীর সাথে দেবী কালিকার প্রভূত সাদৃশ্য পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ কালীকে আদিবাসি সম্প্রদায়ের দেবী রূপে ও বর্ণনা করে থাকেন। সপ্তম – অষ্টম দশকের কিছু লেখায় এর উল্ল্যেখ আছে তবে ঈষৎ ভিন্ন ভাবে। যেমন বান ভট্টের নাটক কাদম্বরীতে দেবী চণ্ডীর উপাখ্যান পাওয়া যায়। ইনি শবর জাতির দ্বারা পূজিতা হতেন। সমকালীন কবি বাকপতি বিরচিত ” গৌড় বহও ” নামক প্রাকৃত ভাষায় রচিত কাব্য গ্রন্থে বিন্ধ্যবাসিনি নামে এক দেবীর কথা আছে যিনি ছিলেন শবরদের আরাধ্যা। তাঁর সাথে ও কালীর বিশেষ মিল পাওয়া যায়। মূল বর্ণনা অনুযায়ী এই দেবী ভীষণ দর্শনা, মুণ্ডমালিনী, প্রায় নগ্ন এক মূর্তি। খ্রিস্ট পূর্ব ৩০০ থেকে প্রায় ৬০০ খ্রিস্টাব্দ অবধি কালী মূলত যুদ্ধের দেবী রূপে পূজিতা হতেন। বৈদিক দেবী হলেও তৎকালীন সময়ে সনাতন হিন্দু ধর্মের মূল স্রোতে তিনি কিছুটা ব্রাত্যই ছিলেন। কালীর আরাধনা বিশেষত নিম্ন বর্ণ বা অবৈদিক সমাজেই বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। নগরের বাইরে শ্মশানের কাছাকাছি অঞ্চলেই কালী মন্দিরের অবস্থান বেশি পরিলক্ষিত হয়। তবে ষষ্ঠ শতকের ‘দেবী মাহাত্মম’ রচনায় মহাকালী রূপে কালীর রূপ ও মাহাত্ম্যের বিস্তৃত বর্ণনা পাই। অশুভ বিনাশ করে ইনি শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা করেন। দেবী দুর্গার ললাট উৎপন্না মহা শক্তিশালিনী দেবী রূপে তিনি স্বীকৃতি পান। আবার স্বামী অভেদানন্দের মতে বৈদিক দেবী ‘রাত্রি’ পরবর্তীতে দেবি কালিকা হয়ে ওঠেন। তবে তন্ত্র সাধনার সাথে সুনিবিড় যোগাযোগ এক সুদীর্ঘ সময় কালীকে সাধারন মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এক ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা এর কারণ হয়তো। তবে পরবর্তীতে এই সম্পর্ক ধীরে ধীরে সহজ হয়। সতেরশ খ্রিস্টাব্দ উত্তর সময়ে কালী সাধনা এক অন্য রূপ পায়। ভয়াল ভয়ঙ্কর রক্ত পিপাসু দেবী স্নেহময়ী মা হয়ে ওঠেন। সাধক রাম প্রসাদ, সাধক বামাখ্যাপা তথা শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ন্যায় কালী উপাসকেরা দেবী কালিকার ভবতারিনি মাতৃ রূপ পূজা প্রচার করেন। ক্রমশ এই রূপ সাধারন বাঙালী মনের কাছাকাছি আসে । বাঙালী হৃদয় আসনে তখন থেকেই তাঁর করুনাঘন অবস্থান।

চামুণ্ডাচর্চিকা কালীর পূজা বাংলা ও বহির্বঙ্গে প্রাচীন উৎসব হলেও বর্তমান আকারে কালীপূজা আধুনিক কালের। ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত তথা নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মীপূজার বিধান দিলেও, কালীপূজার উল্লেখ করেননি। ১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, “কাশীনাথ এই গ্রন্থে কালীপূজার পক্ষে যে ভাবে যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা দেখিলেই মনে হয়, কালীপূজা তখনও পর্যন্ত বাঙলা দেশে সুগৃহীত ছিল না।” তবে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালীপূজার প্রচলনের কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

সপ্তদশ শতকের নবদ্বীপের প্রথিতযশা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়। তাঁর পূর্বে কালী উপাসকগণ তাম্রটাটে ইষ্টদেবীর যন্ত্র এঁকে বা খোদাই করে পূজা করতেন। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়িয়া পূজা করিতেন। আগমবাগীশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া বাংলার সাধক সমাজ অনেকদিন চলেন নাই; লোকে ‘আগমবাগিশী’ কাণ্ড বলিয়া তাঁহার পদ্ধতিকে উপেক্ষা করিত।” অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এই সময় রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালীপূজা করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বর্তমানে কালীপূজা বাংলায় দুর্গাপূজার মতোই এক বিরাট উৎসব।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্রের কালী আরাধনা নিয়েও অনেক কাহিনী শোনা যায়। কালীপূজায় তাঁর এক হাজার মণ মিষ্টান্ন ও সেই ওজনের চিনি, চাল-কলা ইত্যাদি সহ এক হাজারটি শাড়ি ও মেয়েদের এক হাজার রেশমি পোশাক ইত্যাদির হাজার রকমের ভোগ নিবেদনের কাহিনী পাওয়া যায়। ঐ কাহিনী অনুসারে এই কালীপূজায় মহিষ, পাঁঠা ও ভেড়া (প্রতিটি এক হাজার করে) বলি দেবার খরচ পড়েছিল প্রায় দশ হাজার টাকা আর পূজার অন্যান্য খরচ ধরলে আরও প্রায় কুড়ি হাজার টাকা! এই বেহিসেবী ব্যয় মেটাতে গিয়ে ঈশানচন্দ্রকে নাকি সর্বস্বান্ত হতে হয়েছিল।

কালীপূজার আড়ম্বরে এমনই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া আর এক রাজার গল্প পাওয়া যায় শ্রীরামপুরের মিশনারি উইলিয়াম ওয়ার্ডের লেখায় (১৮১৫)। এই রাজা রামকৃষ্ণ বরানগরে কালীর এক মর্মরমূর্তি প্রতিষ্ঠার উৎসবে নাকি তখনকার দিনে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন। ওয়ার্ড লিখেছেন, কালীর নামে রাজা বিপুল সম্পত্তি দান করেছিলেন, সেই সম্পত্তির আয় থেকে দৈনিক পাঁচশ’ লোক খাওয়ানো হয়।… কালীপূজার খরচের ফলে এখন তিনি প্রায় সর্বস্ব হারিয়েছেন।

সারা বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ‎ঐতিহ্যমন্ডিত কালী-আরাধনার কেন্দ্র আর তাদের নিয়ে প্রচলিত নানা কাহিনীরও শেষ নেই! যেমন, মুর্শিদাবাদের ডাহাপাড়ার দেবী কীরিটেশ্বরী, জনশ্রুতি – বাংলার নবাব মীরজাফর অসুস্থ অবস্থায় এই দেবীর চরণামৃত পান করতেন। এ-রকম আরো কয়েকটি কালীমন্দিরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শান্তিপুরে শাক্ত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশ আর বৈষ্ণব অদ্বৈত আচার্যের বংশধরদের প্রতিষ্ঠিত কালী, রামপ্রসাদের সাধনপীঠ কুমারহট্টের (হালিশহর) ও কমলাকান্তের কোটালহাটের কালী, ভদ্রপুরে মহারাজা নন্দকুমারের প্রতিষ্ঠিত দ্বিভুজা কালী, বিষ্ণুপুরের ময়নাপুরে প্রাচীন কালী, কালনা, সিঙ্গুর ও রাণাঘাটের সিদ্ধেশ্বরী, সিউড়ি ও নবদ্বীপের ভবতারিণী, চূঁচুড়ার দয়াময়ী, নলহাটির ললাটেশ্বরী, শেওড়াফুলির নিস্তারিনী, বাগনানের মহাকালী, বর্ধমানের কঙ্কালেশ্বরী ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া বীরভূমে বীরসিংহপুরের কালী, অম্বিকা-কালনার দারুময়ী অম্বিকা ও ২৪ পরগ্ণার ময়দার কালীও বিখ্যাত।

পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও বিশ্রুত কালীক্ষেত্রের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ঝাড়খন্ডে ধানবাদের নিকটবর্তী কল্যাণেশ্বরী ও রাজরাপ্পার ছিন্নমস্তার মন্দির ভক্তদের কাছে সুপরিচিত। এ ছাড়া পূর্ববঙ্গে (বাংলাদেশ) বিক্রমপুরে সোনারঙের কালী, ঢাকার জয়দেবপুরে শ্মশানকালী, বগুড়ার কালঙ্কেশ্বরী (বা প্রেতাসনা কালী), ত্রিপুরার মেহারে মেহার-কালী ইত্যাদিও সুপরিচিত। তমলুকের দেবী বর্গভীমা এবং কাঁথির কপালকুণ্ডলার নামাঙ্কিত মন্দির বা বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরে পূজিতা দেবীও আদতে কালীরই নানা রূপ। বীরভূমের তারাপীঠে পূজিতা দেবী কালীর নিকটতম রূপান্তর তারার মন্দিরের কথা ছেড়ে দিলেও সেখানে রয়েছে বোলপুরের কাছে কঙ্কালী, ভাঙ্গালি ও বর্ধমান সীমান্তে অট্টহাস ইত্যাদি কালী-উপাসনাস্থলগুলি, যার মধ্যে কয়েকটি শক্তিপীঠ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। এছাড়াও রয়েছে নানা ডাকাতের নামের সঙ্গে জড়িত অগণিত কালীমন্দির।

এ-রকমই একটি, সিঙ্গুরের ডাকাতকালীর মন্দির দেখতে যাবার এক বিবরণ মেলে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিখ্যাত বই ‘বাংলার ডাকাত’-এ। শেওড়াফুলি যাবার পথের বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখছেন, “শীর্ণ সংকীর্ণ সর্পিল পথ। চৈত্র মাস। শুষ্ক পথের পাশে স্থানে স্থানে জঙ্গলঘেরা ডোবা। অতিকষ্টে মন্দিরের কাছে আসিলাম। ডাকাত কালীর মন্দির ভগ্ন ও জীর্ণ। ইঁট খসিয়া পড়িতেছে। এদিক ওদিক সাপ ছোটাছুটি করিতেছে। দিনের বেলায়ও অন্ধকার। মন্দিরে ভীষণাকৃতি কালীমূর্তি। ভিতরে আবর্জনা পূর্ণ।……একপাশে একটি বড় হাড়িকাঠভূমিতে পড়িয়া আছে।……আমি ডাকাতে কালীকে দেখিতে আসিয়া ভয়ে বিস্ময়ে শিহরিয়া উঠিলাম…। নানা আগাছায় পূর্ণ ভয়াল স্থান। দিনের বেলায়ও ভয় করে।…” সিঙ্গুরের এই ডাকাতে কালীর মন্দির কিন্তু আজও আছে, যদিও প্রাচীন জরাজীর্ণ মন্দিরের সংস্কার হয়েছে। এই কালীর নাম সিদ্ধেশ্বরী। গগন সর্দার, সনাতন বাগদি, রঘু ডাকাত ইত্যাদি নানা ডাকাতের নাম ও গল্প সিঙ্গুরের এই কালীর সঙ্গে জড়িত।

এই সূত্রে কালীপূজোয় আরও দুটি বিদেশী-লিখিত নরবলির বিবরণের উল্লেখ এখানে করা যায়। একটি পর্তুগীজ জার্নালে ক্যাপটেন নরোনহা নামে এক ধর্মভীরু পর্তুগীজের বিবরণ পাওয়া যায়। মেদিনীপুরের কাছাকাছি কোনো স্থানে ডাকাতদের সঙ্গে গিয়ে তিনি এক বটগাছের নীচে তিনি তাদের আরাধ্যা কালীমূর্তি দেখতে পান। বলি হিসেবে সেখানে দু’টি অর্ধমূর্ছিত বালক ও অদুরে সিঁদুর মাখানো খড়গ দেখে তিনি ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। আর একটি বিবরণ যার লেখা, তিনি ধর্মে ক্যাথলিক হলেও পেশায় ছিলেন ডাকাত। এক স্থানীয় জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি খুলনা ও নোয়াখালি অঞ্চলে ডাকাতি করতেন, পরে পালিয়ে যান সুন্দরবনের গভীরে। সেখানে তিনি ‘ভবানীপূজা’র আয়োজন করেন বলে জানিয়েছেন, যাতে নরবলির জন্য মানুষ কেনাবেচার কথা পাওয়া যাচ্ছে ও বলির যোগ্য মানুষের লক্ষণ মিলিয়ে সওদা করছেন স্ব্য়ং পুরোহিত!

ওয়ার্ডের বিবরণে এরকম আরো কালীভক্তদের বিবরণ মেলে, যারা কালীপূজো উপলক্ষে বিপুল ব্যয় করতেন, যেমন ধরা যাক, খিদিরপুরের ন্যায়নারায়ণ ঘোষাল বা গোপীমোহন নামে কলকাতার এক বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ। প্রথমজন নাকি ১৭৯৫ সাল নাগাদ কালীপূজায় পঁচিশ হাজার টাকা ব্যয় করে ২৫টি মহিষ, ১০৮টি পাঁঠা ও ৫টি ভেড়া বলি দিয়েছিলেন। অপর ব্যক্তি ১৮১১ সালে কালীপূজায় দশ হাজার টাকা ব্যয় করেছিলেন।

কলকাতার আরেক বাবু শোভাবাজারের কালীশঙ্কর ঘোষের বাড়ির কালীপূজার আড়ম্বরের বিবরণ পাওয়া যায় হরিহর শেঠের লেখায়ঃ- “কালীশঙ্কর ঘোষের বাটীতে তান্ত্রিকমতে অতি ভয়ানক ভাবে কালীপূজা হইত। শ্যামাপূজার রাত্রে মদ্যপান অব্যাহতভাবে চলিত এবং বলির রক্তে প্রাঙ্গণ ভরিয়া যাইত, নর্দমা দিয়া রক্তস্রোত বহিয়া যাইত।” এই বাড়ির পূজোতেই পশুবলির বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন পূর্বে উল্লিখিত পাদ্‌রি ওয়ার্ড তাঁর বইয়ে। বাড়ির মাঝখানে খোলা আঙিনায় রয়েছে বলির পশুগুলি, পাশেই স্ব্য়ং কালীশংকর। তাঁর কয়েকজন সঙ্গী ও বলির কাজে সহায়তার জন্য জনা বিশেক লোক। আঙ্গিনার চারদিক ঘিরে দালান, তার একটি ঘরে উত্তরমুখী করে প্রতিমা বসানো, অপর কয়েকটি ঘর দর্শকে ঠাসা। এর পর এই পাদরি জানিয়েছেন যে, প্রথমে বলি পড়ে পাঁঠা, তারপর মহিষ ও সবশেষে দু’ তিনটি ভেড়া। ওয়ার্ডের বর্ণনা কিছুটা শোনা যাকঃ- “একজন পূজারী বলি দেওয়া পাঁঠার মুন্ডুটি ধরে নাচতে নাচতে মূর্তির সামনে নিয়ে গেল। সদ্য কাটা মুন্ড থেকে তাজা রক্ত তার সর্বাঙ্গে গড়িয়ে পড়তে থাকে। বলিদান শেষ হলে কালীশঙ্কর, যে লোকটি বলি দিল, তাকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন। তাকে বস্ত্র ইত্যাদি প্রভূত জিনিষপত্র দান করা হলো। পশুর মুন্ড, রক্ত, দেহের বিভিন্ন অংশের মাংস পূজারী দেবীকে নিবেদন করলেন। তারপর বালির ওপর আগুন জ্বেলে ঘৃত সহযোগে হোম শুরু হলো। তখন সারা আঙিনা রক্তে ভাসছে।” এ-ছাড়াও কালীপূজার বিষয়ে ওয়ার্ড যে-সব তথ্য জানিয়েছেন, তার মধ্যে আছে, দেবীকে যে মদ্য নিবেদন করা হয়, তা কর্তা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের লোকেরা একান্তে পান করে। আর প্রতিমার সম্মুখে নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।

পশুবলি অবশ্য গৃহস্থ বাড়ির কালীপূজোয় ছিল বহুল প্রচলিত প্রথা। কাঁসারিপাড়ার মল্লিকবাড়িতে আর সিমলার হোগলকুঁড়িয়ায় গুহবাড়িতে কালীপূজোয় মহিষ বলির প্রথা ছিল বলে জানা যায়। পাঁঠা বলি তো ছিল সাধারণ ব্যাপার! আবার বিখ্যাত ধনী আশুতোষ দেবের (ছাতুবাবু) বাড়ির কালীপূজায় কোনো বলিই হতো না। ১৭৫৭ সালে সুতানুটি অঞ্চলে রাজা মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত পুঁটে-কালীর মন্দিরে বৈশিষ্ট্যই ছিল অসংখ্য বলিদান। পলাশির যুদ্ধের সমকালে যখন কলকাতার অধিকাংশ জায়গা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ, তখন ডাকাতি করতে যাবার আগে কালীমূর্তির সামনে এমন কি, নরবলি দেবার গল্পও শোনা যায়। চিতু ডাকাতের প্রতিষ্ঠিত চিত্তেশ্বরী কালী মন্দিরে ১৭৭৮ সালের গ্রীষ্মের এক অমাবস্যায় এমনই নরবলি হয়েছিল বলে জানা যায়। কালীঘাটেও কোম্পানির আমলে নাকি একবার নরবলির জন্য একজনের ফাঁসি হয়েছিল বলে ডঃ ডাফের বিবরণে উল্লিখিত আছে।

কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত কালীক্ষেত্র কালীঘাটের মন্দিরে কার্তিকী অমাবস্যায় কালী আরাধনার আড়ম্বরের উল্লেখ করে মিশনারি ওয়ার্ড জানিয়েছেন যে, এই পূজায় প্রায় হাজার চারেক লোকের সমাগম হতো। অনেকেই পূজা উপলক্ষে প্রচুর খরচ করত। ১৭৬৫ সালে রাজা নবকৃষ্ণ নাকি এই কালীমন্দিরের পূজোয় লাখ খানেক টাকা ব্যয় করেন ও মূর্তির জন্য দান করেন সোনার মুন্ডমালা। পাদরি ওয়ার্ডের বিবরণ অনুযায়ী এই রাজা কালীমূর্তির জন্য দান করেন হাজার টাকা মূল্যের সোনার হার সহ অন্যান্য অলঙ্কার ও রুপোর বাসনপত্র। তিনি দু’ হাজার আতুরকে অর্থদান করেন ও যে-পরিমাণ ভোজ্যবস্তু ও মিষ্টি দান করেন, তা দিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল এক হাজার মানুষকে। এই বিশ্রুত কালীমন্দিরে কালীর নিত্যপূজাও হতো এবং সে সূত্রে এর সঙ্গে নানা ধনাঢ্য মানুষের নাম শোনা যায় নানাজনের লেখা বিবরণে ও সমকালের সংবাদপত্রের পাতায়। শোভাবাজারের রাজা গোপীমোহন দেব ১৮২২ সালে একবার কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে ধূমধাম সহকারে কালীঘাটে পূজো দিয়েছিলেন ও এই পূজো দেখতে এত ভীড় হয় যে শান্তিরক্ষায় পুলিশের প্রয়োজন হয়েছিল। রাজা বাহাদুর কালীমূর্তির হাতের রুপোর খড়্গ আর সোনার নরমুন্ড গড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও নানা রকমের অলঙ্কার পট্টবস্ত্র আর শাল-দোশালায় মূর্তিকে মন্ডিত করেন।

অতীত বাঙলার, এমন কি, ভারত ও নেপালের নানা ধনী ভক্তজন নানা সময়ে কালীঘাটের কালীমূর্তির জন্য বিভিন্ন আভরণ দান করেন বলে শোনা যায়। দেবীর চারটি রুপোর হাত দিয়েছিলেন খিদিরপুরের গোকুলচন্দ্র ঘোষাল। পরে চারটি সোনার হাত দেন কলকাতার কালীচরণ মল্লিক। বেলেঘাটার রামনারায়ণ সরকার দিয়েছিলেন সোনার একটি মুকুট আর পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ দেবীর সোনার জিভটি গড়িয়ে দেন। পাতিয়ালার মহারাজা দিয়েছিলেন দেবীমূর্তির গলার একশো আটটি নরমুন্ডের মালা, মূর্তির মাথার ওপরের রুপোর ছাতাটি নাকি দেন নেপালের প্রধান সেনাপতি জঙবাহাদুর।

মূর্তির পরেই কালীঘাটের মন্দিরের ও মন্দির পরিসরের নানা অংশের নির্মাণেও রয়েছে নানা বিচিত্র মানুষের যোগদান। ১৭৭০-৭১ সাল নাগাদ মন্দিরের সামনের গঙ্গার ঘাটটি এক বিশ্বস্ত পাঞ্জাবি সৈনিক হুজুরিমল্লের শেষ ইচ্ছানুযায়ী বাঁধিয়ে দেয় ইংরেজ সরকার। কালীর বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণ হয়েছিল বরিশার জমিদার সন্তোষ রায়চৌধুরী ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের সৌজন্যে। এছাড়াও শ্যামরায়ের মন্দির, তোরণদ্বার, বিভিন্ন ভোগঘর, নহবতখানা ইত্যাদির নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাওয়ালির বৈষ্ণব জমিদার উদয়নারায়ণ মণ্ডল, গোরখপুরের টীকা রায়, শ্রীপুরের জমিদার তারকচন্দ্র চৌধুরী, তেলেনিপাড়ার জমিদার কাশীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নাম। ১৮৩৫ সালে নাটমন্দিরটি তৈরি করান আন্দুলের জমিদার রাজা কাশীনাথ রায়। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, এই নাটমন্দিরেই ১৮৯৯ সালে কালী সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের বিদেশিনী শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা। সে এক অন্য কাহিনী!

অ্যালবার্ট হলে [অর্থাৎ এখনকার কফি হাউস] কালী বিষয়ে তাঁর প্রথম বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন আইরিশ দুহিতা নিবেদিতা। শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন কলকাতার শিক্ষিত সমুদায় ও ব্রাহ্মসমাজের নানা বিশিষ্ট ব্যক্তি, যেমন সত্যেন্দ্রমোহন ঠাকুর, ব্রজেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ডাঃ নিশিকান্ত চ্যাটার্জি ও ড: মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখ। সাধারণ শ্রোতারা নিবেদিতার ভাষণে সন্তুষ্ট হলেও কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তি তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। নিবেদিতা এই বক্তৃতায় কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে সবচেয়ে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন মহেন্দ্রলাল। কলকাতার কালীবিরোধীদের বক্তব্যের জবাব দেবার সুযোগ আসে যখন কালীঘাট মন্দিরের সেবায়েত হালদারেরা নিবেদিতাকে মন্দির প্রাঙ্গনে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানান। এই কালীঘাটেই নাটমন্দিরের চত্বরে নিবেদিতা ২৮শে মে শ্রোতায় ঠাসা এক সভায় কালী আরাধনার বলিপ্রথা, মূর্তিপূজা ও মূর্তির তথাকথিত কুৎসিত রূপ ইত্যাদি অভিযোগের জবাব দিয়েছিলেন। পরে তাঁর এই বক্তৃতা পুস্তিকাকারে প্রকাশ করেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। উল্লেখযোগ্য যে, ‘কালী দি মাদার’ নামে নিবেদিতার একটি বইও আছে।

কালীঘাটের কালীর প্রতি শুধু যে বাঙালি বা হিন্দুরাই ভক্তি বা বিশ্বাস পোষণ করতেন, এমন কিন্তু নয়। শোনা যায়, পাঞ্জাব আর বার্মা দখল করবার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে কালীঘাটে ষোড়শোপচারে পূজো পাঠানো হয়েছিল। মার্শম্যানের বিবরণেও এর সমর্থন মেলে। কালীপূজোয় কোম্পানির এই এলাহি খরচের পেছনে অবশ্য ভক্তির চেয়ে দেশী সেপাইদের সন্তুষ্ট করার বাসনাই সম্ভবত কাজ করেছিল। কিন্তু পাদরি ওয়ার্ড কালীঘাট সহ বিভিন্ন কালীমন্দিরে অহিন্দু ভক্তদের আনাগোনার কথা লিখেছেন। তিনি জানাচ্ছেন, “শুধু হিন্দুরাই যে এই কালো পাথরের দেবীমুর্তির পূজা করে, এমন কিন্তু নয়। আমি জানতে পেরেছি, অনেক ইয়োরোপীয় বা তাদের এ-দেশীয় স্ত্রীরা কালী মন্দিরে যায় ও দেবীর আরাধনায় হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে। আমি যে-ব্রাহ্মণের সাহায্য নিয়ে এই বিবরণ প্রস্তুত করেছি, তিনি বলেছেন, তিনি…… বহুবার সাহেব-মেমদের কালী মন্দিরে পূজো দিতে পালকি করে আসতে দেখেছেন।…… তাঁকে মন্দিরের কর্তৃপক্ষ সুনিশ্চিত ভাবে জানিয়েছেন, কোনো প্রার্থনা নিয়ে কালীর কাছে দিতে ইয়োরোপীয়রা প্রায়ই এসে থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক বিশিষ্ট কর্মচারী সম্প্রতি মামলা জিতে কালীদেবীকে দু’তিন হাজার টাকা দামের টাকা মূল্যের নানা সামগ্রী দান করেছেন।”

কালীঘাটের মন্দির সম্পর্কে পাদ্রি ওয়ার্ড লিখেছেন, “কলকাতার কাছে কালীর এক বিখ্যাত মন্দির রয়েছে। সমগ্র এশিয়া, এমন কি, সমগ্র বিশ্বের হিন্দু এই দেবীর পূজা করে।” ওয়ার্ডের বিবরণে এই অতিরিক্ত সংবাদও পাওয়া যায় যে, প্রায় পাঁচশো মুসলমান নাকি প্রতি মাসে কালীকে পূজো দিয়ে যেতেন। এর পরে তাঁর অধিকন্তু মন্তব্যঃ- “কি আশ্চর্য ভাবেই না এই দেবীমূর্তি সাধারণ লোকের মনে প্রভাব বিস্তার করেছে! ……বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সমসংখ্যক গণিকারা এসেও মন্দিরে পূজো দিয়ে যায়। তাদের কারো প্রার্থনা উপপতির রোগমুক্তি, কেউ বা চায় তার ঘরে আরও বেশি লোকের আগমন!” পবিত্রকুমার ঘোষ জানিয়েছেন, একসময় অবিভক্ত বাংলার, পরে পূর্ব পাকিস্তানের জননেতা শহিদ সুরাওয়ার্দি নাকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার বাসনায় কালীঘাটে মানত করেছিলেন ও কলকাতায় দু’জন লোক পাঠিয়ে তাঁর হিন্দু বন্ধুদের মারফৎ ‘বিরাট ডালা সাজিয়ে’ কালীঘাটে পূজো দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। আর একজন বিখ্যাত বাঙালি শিল্পপতি স্যার বীরেন মুখার্জিও নাকি প্রতি সপ্তাহে কালীঘাটের মন্দিরে পূজো দিতেন।

কালীঘাট ব্যতিরেকে কলকাতার অন্যান্য প্রাচীন কালী মন্দিরগুলি নিয়েও আড়ম্বর-বৈচিত্র্যের কাহিনী কম নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিপত্তিশালী দেওয়ান গোবিন্দরাম মিত্রের প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী কালীর মন্দির ছিল কলকাতার মনুমেন্টের থেকেও উঁচু, আর তা খ্যাত ছিল ‘ব্ল্যাক প্যাগোডা’ নামে। এই মন্দির বেশ কয়েকবার ঝড়ে আর ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে ও তা পুনরায় তৈরি করা হয়। তাঁর কালীপূজোর ঘটাও নাকি ছিল খুব বিখ্যাত।

কলকাতার কালীমন্দিরগুলোর মধ্যে সম্ভবত প্রাচীনতা আর খ্যাতির বিচারে কালীঘাটের পরেই চিত্তেশ্বরী মন্দিরের নাম উল্লেখ্য। অতীতের সেই যুগে গঙ্গার তীর ধরে তীর্থযাত্রীরা চিৎপুরে দেবী চিত্তেশ্বরী বা চিত্রেশ্বরী কালীমন্দিরে পূজো দেবার পর মশাল জ্বালিয়ে দল বেঁধে যেত কালীঘাটে। জনশ্রুতি আছে, এই পথের ধারেই তীর্থযাত্রীদের ওপর লুঠপাট চালাতো চিতে ডাকাত, এমন কি, এইসব অসহায় যাত্রীকে ধরে নাকি বলিও দিত কালীর সামনে। এই চিতু ডাকাতের নাম থকেই দেবী চিত্তেশ্বরী বা চিৎপুর নামের জন্ম হয়েছে (বা এর উল্টোটাও হতে পারে), এমন লোকশ্রুতিও আছে (কলকাতা কলেক্টরেটের ১৭৬১ সালের এক পাট্টায়ও এ কথার উল্লেখ আছে)। জঙ্গলাকীর্ণ এই পায়ে চলা রাস্তাটি ইংরেজদের নথিতে পরিচিত ছিল পিলগ্রিমস রোড নামে। বর্তমানে এই চিত্তেশ্বরী মন্দিরে (কাশীপুরে) প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহটি দুর্গা বা চন্ডীর হলেও কলকাতার আদিযুগে এটি যে কালীমন্দির হিসেবেই পরিচিত ছিল, তার বহু প্রমাণ আছে। ‘ক্যালকাটা রিভিয়ু’ পত্রিকায় ১৮৪৫ সালে লেখা হয়েছিল, “Chitrapur was noted for the temple of ChitreswariDeby or the goddess of Chitru, known among Europeans as the temple of Kali at Chitpore”। এখানে আরও লেখা হয়েছিল, “This was the spot where the largest number of human sacrifices was offered to the goddess in Bengal before the establishment of the British Government.” একই ধরনের কথা পাওয়া যায় কটন সাহেবের ‘ক্যালকাটাওল্ড অ্যান্ড নিউ’ গ্রন্থেও। এই বইটির মতে এই স্থানটি ছিল “noted for the temple of Chitru or Kalee, renowned for the number of human sacrifices formerly offered at her shrine.”

কলকাতা বা তার উপকন্ঠের আর একটি প্রসিদ্ধ কালীক্ষেত্র দক্ষিণেশ্বর, যা রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৫৫ সালের ৩১শে মে এই মন্দিরে ভবতারিণী কালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠার দিনের কাহিনী পাওয়া যায় ‘সমাচার দর্পণে’, সেদিন নাকি “কলিকাতার বাজার দূরে থাকুক্‌, পাণিহাটি, বৈদ্যবাটি, ত্রিবেণী ইত্যাদি স্থানের বাজারেও সন্দেশাদি মিষ্টান্নের বাজার আগুন হইয়া উঠে। এইমত জনরব যে পাঁচশত মণ সন্দেশ লাগে।” এই দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণির পূজারী হিসেবে নিযুক্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসের দৌলতে এই মন্দির পরবর্তী কালে বিশ্বখ্যাত হয়ে ওঠে। অথচ একথা আজ হয়তো অনেকেই জানেন না, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান শিষ্য বিবেকানন্দের এই মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছিল সমুদ্র অতিক্রম করে ম্লেচ্ছদেশে যাবার কারণে! এই মন্দিরের কালীকে নিয়ে ইংরেজিতে চমৎকার একটি কবিতা লিখেছিলেন হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।

বাংলার কালী আরাধনার রূপঃ

কালী তথা ভবতারিণীর পরম উপাসক শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব শাক্ত মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেছিলেন কেনারাম ভট্টাচার্যের কাছে। পরবর্তীতে রানি রাসমণির আনুকূল্যে ও অর্থে সৃষ্ট দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির পূজারী রূপে সাধনজীবন শুরু করেন। দেবী ভবতারিণীর পাষানপ্রতিমাকে ‘মা মা’ বলে আপন খেয়ালে তিনি কথা বলতেন। নিজ কণ্ঠে গান শোনাতেন। কখনও তাঁর ‘ভাব-সমাধি’ হত। রামকৃষ্ণের সেই ভাব-সমাধির মুহূর্তে মনে করা হত তিনি স্বয়ং মাকে প্রত্যক্ষ করছেন। রামকৃষ্ণের অলৌকিক কাণ্ডকারখানা ও তাঁর ভাব-সমাধি জনশ্রুতি সৃষ্টি করেছিল। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ গ্রন্থে শ্রীম জানিয়েছেন, ঠাকুর বলতেন, ”এমনি মহামায়ার মায়া রেখেছ কী কুহক করে ব্রহ্মা বিষ্ণু অচৈতন্য জীবে কি তা জানতে পারে।”

১২৮০ সালের ১৩ই জৈষ্ঠ্য ফলহারিনী কালী – পূজার দিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীশ্রীমাকে সাক্ষাৎ ষোড়শী জ্ঞানে পূজা করেন। সেই মহাঘটনা পৃথিবীর ধর্মজগতের ইতিহাসে রেখে গিয়েছিল। এক গভীর তাৎপর্য। জগতের ইতিহাসে শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনা তুলনাবিহীন – আর এই সাধনাপথের যাত্রা শুরু হয়েছিলো কালীসাধনার মধ্য দিয়ে। কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপ -তাঁর রঙ কালো। সাধনার সুচলালগ্নে তো সাধককে অন্ধকার পথেই এগোতে হয়, শ্রীরামকৃষ্ণের কালী সাধনা যেন তাঁরই প্রতীক। এর পর আরো কত পথে তিনি সাধনা করেছেন, বিভিন্ন পথে খুজেছেন ইশ্বরকে, শেষে বন্দনা করেছেন মানবী রূপ ধারিণ দেবী ষোড়শীর।

এছাড়া ইতিহাস সাক্ষী হয়ে রইল নতুন যুগান্তকারী একটি দৃষ্টিভঙ্গীর, আপামর পৃথিবীবাসী দেখল দাম্পত্য প্রেমের সম্পূর্ণ এক নতুন দিক। ফলহারিণী কালিকা অমাবস্যা নামে বিখ্যাত এই অমাবস্যা তিথি যেন সংবৎসর পুরুষদের স্মরণ করিয়ে দেয় গৃহরমণীদের স্থান কোথায় এবং তাদের প্রকৃত স্বরূপ কি। নিজ মাতাকে মন্ত্রপাঠ সহযোগে দেবীজ্ঞানে পূজার কথা শাস্ত্রে রয়েছে, কিন্তু নিজ ধর্মপত্নীকে দেবীর বেদিমূলে বসিয়ে উপাচার সহ পূজা করা জগতের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।

“আমার কালী-মা কোথায় গেলে গো”রামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর শিশুর মত কেঁদে উঠলেন সারদামণি। কালী আর রামকৃষ্ণ তাঁর কাছে অভিন্ন। কালী কালী অজপার মধ্য দিয়ে রামকৃষ্ণ কালী হয়ে উঠলেন। ইষ্ট আর ভক্ত এক। সন্তানের বশীভূত জননী। মায়ের সঙ্গে কখনো মান-অভিমানের পালা, কখনো বা নিঃশেষ আত্ম-সমর্পণের শান্ত মূহুর্ত, কখনো রাগ, কখনো রফা, কখনো কান্না, কখনো জবরদস্তি, কখনো দীনতা, কখনো অহঙ্কার, কখনো দাস্য, কখনো প্রভুত্ব। ভক্তির কাছে জননীর বশ্যতা স্বীকার। সন্তানকে চোখে-চোখে রাখা, ঘিরে থাকা। ভক্তের আবদার রাখতে গিয়ে অঘটনপটীয়সীর নানা খেলা।

রামপ্রসাদের বেড়া বেঁধে দিয়ে গেলেন কালী। মায়ে-ছেলের লুকোচুরি খেলা। মা ছাড়া আর কিছু নেই ছেলের কাছে। যত ওজর-আপত্তি-নালিশ সব মায়ের কাছে। আবার অভিযোগ, প্রচণ্ড অভিমানদ্বারে দ্বারে যাব ভিক্ষা মাগি খাব, মা মলে কি তার সন্তান বাঁচে না।” মন্ত্র নয়, আচার-অনুষ্ঠান নয়, যাগ-যজ্ঞ কিছুই নয়শুধু মাকে মায়ের মত করে পাওয়ার ব্যকুলতা, মুখে শুধু ‘মা’ ‘মা’। মাতৃসাধনার এই গোড়াপত্তন প্রথম দেখি কমলাকান্তে। রামপ্রসাদের মধ্যে দেখি এই সহজ সরল দিব্যসাধনার পরিপূর্ণ রূপে।

মায়ে পোয়ে মোকদ্দমা,
ধূম হবে রামপ্রসাদ বলে।
আমি ক্ষান্ত হব যখন আমায়
শান্ত করে লবে কোলে।

কালীভাবনায় সারা দেশ ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন রামপ্রসাদ। ক্ষেত্র বুঝি তৈরি হল। রামকৃষ্ণ এলেন। অবতার আসবার আগে যেমন আসেন পূর্বসাধক, ভবিষ্যৎ আধ্যাত্মিক বিপ্লবের জীবন্ত ভূমিকা হয়ে। কমলাকান্ত ও রামপ্রসাদের কালী করালী নন, করুণাময়ী। রামকৃষ্ণের কালী ভবতারিণী। তাঁর তপস্যার মধ্য দিয়ে বাঙালী কালীসাধনার অভিনব বেদ রচিত হল।

রামকৃষ্ণ কালীময়। তাঁর শক্তির আধার বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দের সাধনার ভিতর দিয়ে ভবতারিণী বাংলার অসংখ্য বীর বিপ্লবী তরুণের মনে প্রলয়ঙ্করী মহাকালী রূপে আবির্ভূতা হলেন। বিবেকানন্দের বাণীতে তাঁরা উদ্দীপ্ত “মাকে বুকের রক্ত দিয়ে পুজো করতে হয়, তবে যদি তিনি প্রসন্না হন। মার ছেলে বীর হবে, মহাবীর হবে। নিরানন্দে দুঃখে মহালয়ে মায়ের ছেলে নির্ভীক হয়ে থাকবে।” কালী প্রশস্তিমূলক গান তথা শ্যামাসঙ্গীত বাংলা গানের একটি ভিন্ন ধারা। কালীসাধক রাম প্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য এ ধারায় অন্যতম অবদান রাখেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং কাজী নজরুল ইসলামও এ ধারার উৎকৃষ্ট মানের গান রেখে গেছেন। নিরক্ষর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবী কালী সচেতনতায় সিক্ত হয়ে অনবদ্য বাণী উচ্চারণ করতেন যা শ্রীশ রচিত অমর গ্রন্থ ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’তে স্থান পেয়েছে। ‘মৃত্যুরূপা কালী’ দেবী কালীকে নিয়ে আছে স্বামী বিবেকানন্দ রচিত একটি বিখ্যাত সুদীর্ঘ কবিতা। ভগিনী নিবেদিতা মাতৃরূপা কালী নামক একটি কালী বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

শ্রীঅরবিন্দের ভাষায় “ক্ষিপ্র, ঋজু, অকপট যে সকল প্রেরণা, অকুণ্ঠ অব্যভিচারী যেসব গতিধারা, অগ্নিশিখায় ঊর্ধ্বগামী যে অভীপ্সাতাই মহাকালীর পদক্ষেপ। অদম্য তাঁর প্রবৃত্তি, তাঁর দৃষ্টি, তাঁক সংকল্প শ্যেনপক্ষীর ব্যোমবিহারের মত উত্তুঙ্গ দূরপ্রসারী, ঊর্ধ্বপ্রসারিত পথে ক্ষিপ্র তাঁর গতি, হস্ত তাঁর প্রসারিত দণ্ডবিধানের জন্যঅভয়প্রদানের জন্য। কারণ তিনিও মাতাঁর স্নেহ তাঁর ক্রোধেরই মত তীব্র, তাঁর কারুণ্য সুগভীর, আবেগ-আপ্লুত। আপন শক্তিতে তিনি যদি নেমে আসতে পারেন, তবে যেসব বাধা আমাদের চলৎশক্তিহীন করে রাখে, দস্যু যারা অন্বেষুকে আক্রমণ করে, তারা সংহতি-বিহীন বস্তুর মত এক মূহুর্তে চূর্ণ হয়ে যায়।

কালীপুজো কেন করা উচিত্‍?

প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে ষড়রিপু ষড়রিপু এরা হলেন কাম, ক্রোধ ,লোভ, মোহ, মায়া এবং মাৎসর্য ।আর এই ষড়রিপু আমাদের খারাপ পথে নিয়ে যায়। তাই আদ্যশক্তি মা দেবী কালী পূজার কালী পূজার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভেতরে থাকা এই ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি । মনের মধ্যে সকল অন্ধকার দূর করে সমাজের অন্ধকার দূর করতে সচেষ্ট হতে পারি ।তাই শক্তির আরাধনা অবশ্যই প্রত্যেককে করতে হবে একমাত্র শক্তিবান মানুষই পারে সকল বিপদ থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে উদ্ধার করতে। তাই সমাজের সকল খারাপ বা অসৎ এবং অসামাজিক কাজকর্ম দূর করার জন্য শক্তির আরাধনা স্বরূপঃ আমরা দেবী কালীর পূজা ভক্তি সহকারে এবং শ্রদ্ধা সহ করব।

কালী পূজার বিভিন্ন পদ্ধতি

তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মধ্যরাত্রে অর্থাৎ অমাবস্যার রাত্রে মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে কালী পূজা করা হয়। এক্ষেত্রে মা করা হয়। এক্ষেত্রে মা মা কালীকে পশু রক্ত বা পশু বলি করে উৎসর্গ করা হয়। এছাড়াও লুচি প্রসাদ এবং নানা ফল ভোগ হিসাবে দেওয়া হয়ে থাকে। গৃহস্থ বাড়িতে সাধারণত সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ মতে মা কালীর পুজা দেখা যায় ।এক্ষেত্রে অনেক সময় জমিদার বাড়িতে ছাগ বা মহিষ ছাগ বা মহিষ বা মহিষ বলি দেওয়া হতো এবং বর্তমানেও অনেক জায়গায় পশু বলির মাধ্যমে পূজার প্রচলন দেখা যায় ।পুরাকালে বা প্রাচীন সময়ে বিভিন্ন ডাকাতের দল নরবলির মাধ্যমে কালী পূজা করত করত বলে শোনা যায়।

কালীপুজোর পদ্ধতি ও উপকরণ

সাধারণত যে কোন পূজায় ভক্তি সহকারে সহকারে করলে আরাধ্য দেবতা বা দেবী আশীর্বাদ দিয়ে থাকেন। যেহেতু মা কালী আদ্যা শক্তির দেবী অর্থাৎ শক্তি এবং সাহস অর্জন করার জন্য এই দেবীর পূজা করা হয় তাই কালী পূজার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিশেষ নিয়ম অবশ্যই মেনে চলতে হয়। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় কালির দোয়াত কালী পূজার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পুজোর শুরু হওয়ার পূর্বে অনামিকা অঙ্গুলি দ্বারা কালির দোয়াত বা লিখনী দোয়াত দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন অঙ্কন করা হয়। স্বস্তিক অঙ্কন সম্পন্ন সম্পন্ন হলে দেবীর পূজা শুরু হয় ।বহুল আয়োজন বা ঘনঘটা করে অনুষ্ঠান করলে দেবী যে প্রসন্ন লাভ করেন তা কিন্তু নয় ।কালীপুজোর অন্যতম প্রধান উপাদান হলো জবাব জবাব জবাব ফুল তাই কালীপুজোর ক্ষেত্রে মা জবা ফুল খুবই পছন্দ করেন অন্যতম প্রধান উপকরণ হিসেবে অবশ্যই রাখতে হয় জবা ফুল। এছাড়াও আস্থা ভক্তি এবং শ্রদ্ধা সহকারে পূজা করা হলে মায়ের আশীর্বাদ অবশ্যই লাভ করা যায় কালীপুজোয় অন্যতম প্রধান ভোগ হিসাবে সোম রস রস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাধারণত মধ্য রাতে এই পূজা শুরু হয় এবং ভোররাতে এ পূজা সম্পন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত আরতি ,আহ্বান এবং পুষ্পাঞ্জলির দ্বারা এই পূজা সম্পন্ন করা হয় এছাড়াও অনেক সময় ধ্যান করতেও দেখা যায় এই পূজার ক্ষেত্রে। অনেক সময় ধ্যানের মাধ্যমে দেবী কালীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে আবাহন ও পুষ্পাঞ্জলির মাধ্যমে দেবী কালীর পূজা পদ্ধতি সম্পন্ন হয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। জবা ফুল, চন্দন ,পুষ্প, ধূপ, দীপ ইত্যাদি কালী পূজার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

গৃহে মা কালীর আরাধনার কিছু মন্ত্রঃ

মা কালীর প্রার্থনা করার কিছু মন্ত্রঃ ঈশ্বরের প্রার্থনা করার বা ডাকার কোনও বাঁধাধরা নিয়ম হয় না। ভক্তিই হল মূল মন্ত্র। তবে বৈদিক মতে পুজো-অর্চনার তো বিধিবদ্ধ নিয়ম আছেই। তা ছাড়া কালীপুজোর দিন পুজোর জন্য উপবাস থেকে জপতপ ইত্যাদির সুফল পাওয়া যায়। মা কালী সময়ের প্রতীক। অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার জন্য। এখন দেখে নেওয়া যাক কী ভাবে মা কালীর প্রার্থনা করলে সুফল পাওয়া যাবে। এ ছাড়া গৃহে মা কালীর চিত্র বা মূর্তির সামনে বিভিন্ন পুজোর দ্রব্যাদি-সহ সহজ প্রার্থনার কিছু মন্ত্র-

 

প্রদীপ বা মোমবাতি প্রদানের মন্ত্র-
‘এষ দীপ ওম ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ।’
ধূপকাঠি প্রদানের মন্ত্র-
‘এষ ধুপঃ ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ।’
কর্পূর প্রদানের মন্ত্র-

‘ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ আরাত্রিকম্ সমর্পয়ামি।’
দুধ-স্নানাদি প্রদানের মন্ত্র-

‘ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ পয়স্নানাম্ সমর্পয়ামি।’
দই-স্নানাদি প্রদানের মন্ত্র-

‘ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃদধিস্নানাম্ সমর্পয়ামি।’
পঞ্চামৃত-সহ স্নানের দ্রব্যাদি প্রদানের মন্ত্র-

‘ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ পঞ্চামমৃত স্নানম্ সমর্পয়ামি।’
গঙ্গাজল স্নানের প্রদানের মন্ত্র-

‘ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ গঙ্গাস্নানম্ সমর্পয়ামি।’
পঞ্চফল প্রদানের মন্ত্র-

‘ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ পঞ্চফলম্ সমর্পয়ামি।’
পুষ্প প্রদানের মন্ত্র-

‘এষ গন্ধপুস্পে ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ।’

প্রণাম মন্ত্র-
‘ওঁ ক্রীং ক্রীং হৃং হৃং হিং হিং দক্ষিণে কালীকে ক্রীং ক্রীং ক্রীং হৃং হৃং হ্রীং হ্রীং হ্রীং স্বহা।
ওঁ কালী কালী মহাকালী কালীকে পাপহারিণী
ধর্মার্থমোক্ষদে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে।’
এরপর জপ একশো আটবার করা যায় এই মন্ত্রে-
‘ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ।’

মা কালি পুজোর কিছু মন্ত্রঃ

অনুষ্ঠান সামগ্রী

মহাকালির চিত্র, পরনে শ্বেত বস্ত্র, ভোগ ও নৈবেদ্য, ধুপ ও দীপ, ফুল ফল। সাধনা কালে উপবাস থেকে সন্ধ্যাকালে হাল্কা ফল মুল ভোজন করবেন । পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করবেন । অনুষ্ঠানের আগে স্নান আবশ্যক তার পর স্বচ্ছ বস্ত্র ধারন করবে । আসনে কালি মূর্তি স্থাপন তার সামনে ধুপ দীপ জ্বালাবে আর নৈবেদ্য রাখবে । সর্ব প্রথম গুরু কে স্মরণ করে মা কালির ধ্যান করবে । ধ্যান করার সময় মন বশে রেখে এক দৃষ্টি কালির দিকে তাকিয়ে থাকবেন , কালি আরাধনার শক্তিলাভ , দুঃখ , শোক , রোগ , মারীভয় নিবারণ ,গ্রহ শান্তি , দারিদ্রতা নাশ , শত্রু ক্ষয় , সর্বপরি সিদ্ধি লাভ , মুক্তি লাভের জন্য কালী পুজা করা । শাস্ত্রে দেখা যায় কালী আরাধনা ব্যতিত মুক্তি অসম্ভব।

প্রণাম মন্ত্র

জয়ন্তী মঙ্গলা কালীভদ্রা কালী
কপালিনীদূগা শিবা সমাধ্যাতীসাহা
সুধা নমস্তুতে।
ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয়হেতবে , নিবেদয়ামি চাত্মানংত্বং গতিঃ পরমেশ্বরঃ ।
ওঁ কালি কালি মহাকালি কালিকে পাপহারিনি দেবী নারায়ণী নমস্তুতে ,মহিষাঘ্নি মহামায়ে চামুণ্ডে মুণ্ডমালিনী আয়ুরোগয় বিজয়ং দেহি দেবী নমস্তুতে । এষ পুস্পাঞ্জলিঃ শ্রীমদ্দদক্ষিণকালিকায়ৈ নমঃ ।

ধ্যান মন্ত্র

ওঁ শবারুঢ়াং মহাভীমাং ঘোরদংস্ট্রাং বরপ্রদাম্।
হাস্যযুক্তাং ত্রিনেত্রাঞ্চ কপালকর্ত্তৃকাকরাম্।।
মুক্তকেশীং লোলজিহ্বাং পিবন্তীং রুধিরং মুহু।
চতুর্ব্বাহু যুতাং দেবীং বরাভয়করাং স্মরেৎ।।
 

মায়ের গায়ত্রী মন্ত্র

ওঁ কালিকায়ৈ বিদ্মহে শশ্মানবাসিন্যৈ ধীমহি তন্নো ঘোরে প্রচোদয়াৎ ……… (১০ বার জপ করুন)
 

জপের মন্ত্র

ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুং হুং হ্রীং হ্রীং
দক্ষিণ কালিকে ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুং হুং হুং স্বাহা
 

আচমন

ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু ওঁ তদবিষ্ণুঃ পরমং পদং পশ্যন্তি সুরয়ঃ । দিবীব চক্ষুরাততম ।। ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু ।।
 

পুস্প শুদ্ধি

ওঁ পুস্পে পুস্পে মহাপুস্পে সুপুস্পে পুস্পে পুস্পসম্ভবে । পুস্পেচয়াবকীরনে ওঁ হুং ফট স্বাহা ।
 

পুজা মন্ত্র

এষ গন্ধ ওঁ গণেশায় নমঃ,
এতৎ সচন্দন পুষ্পম ওঁ গণেশায় নমঃ,
এষ ধুপ ওঁ গণেশায় নমঃ,
এষ দীপ ওঁ গণেশায় নমঃ,
এতন নৈবেদ্য ওঁ গণেশায় নমঃ।
জপঃ ওঁ গণেশায় নমঃ
এষ গন্ধ ওঁ শ্রী সূর্যায় নমঃ,
এতৎ সচন্দনপুস্পম ওঁ শ্রী সূর্যায় নমঃ,
এষ ধুপ ওঁ শ্রীসূর্যা নমঃ,
এষ দীপ ওঁ শ্রী সূর্যায় নমঃ,
এতন নৈবেদ্যম ওঁ শ্রী সূর্যায় নমঃ ।
 

সূর্যের ধ্যান

ওঁ রক্তাম্বুজাসনমশেষগুনৈকসিন্ধুং , ভানুং সমস্তজগতামধিপং ভজামি ।
পদ্মদ্বয়াভয়রবান দধতং করাজৈর মানিক্যমৌলিমরুণাঙ্গরুচিং ত্রিনেত্রম ।
 

কালীকবচম্

ভৈরব উবাচ কালিকা যা মহাবিদ্যা কথিতা ভুবি দুর্ল্লভা।
তথাপি হৃদয়ে শল্যমস্তি দেবি কৃপাং কুরু।।
কবচন্ত মহাদেবী কথয়সানুকম্পা।
যদি নো কথ্যতে মাতব্বিমুঞ্চামি তদা তনুম।।
দেব্যুবাচ: শংকাপি জায়তে বৎস তব স্নেহাৎ প্রকাশিতম।
ন বক্তব্যং ন দ্রষ্টব্যমতি গুহ্যতমং মহৎ।।
কালিকা জগতাং মাতা শোকদুঃখাদি বিনাশিনী।
বিশেষত কলি যুগে, মহাপাতকহারিণী।।
কালী মে পুরুত: পাঠু পৃষ্ঠতশ্চ কপালিনী।
কুল্বা মে দক্ষিনে পাতু করণৌ চগ্রোপ্রভামতা।।
বদনং পাতু মে দীপ্তা নীলা চ চিবুকং সদা।
ঘনা গ্রীবাং সদা পাতু বলাকা বাহুযুগ্মকম।।
মাত্রা পাতু করদ্বন্দং বক্ষো মুদ্রা সদাবতু।
মিতা পাতু স্তনদ্বন্দং যোনিং মন্ডল দেবতা।
ব্রাম্মী মে জঠরং পাতু, নাভিং নারায়ণীং তথা।
ঊরু মাহেশ্মরী নিত্যং চামুন্ডা পাতু লিঙ্গকম।
কৌমারী চ কটিং পাতু তথৈব জানুযুগ্মকম।
অপরাজিতা পাদৌ মে বারাহী পাতু চাঙ্গুলীঃ।
সন্ধিস্থানং নারসিংহী পত্রস্থা দেবতাবতু ।।
রক্ষাহীনঞ্চ যৎ স্থানং বর্জ্জিতং কবচেন তু।
তৎ সর্ব্বং রক্ষ মে দেবী কালিকে ঘোর দক্ষিণে।।
ঊর্দ্ধং-মধ্যস্তথা দিক্ষু পাতু দেবী স্বয়ং বপুঃ।।
হিংস্রেভ্যঃ সর্ব্বদা পাতু সাধকঞ্চ জলাধিকাৎ।
দক্ষিণা কালিকে দেবী ব্যাপকত্তে সদাবতু।
ইদং কবচমজ্ঞাতা যো জপেদ্দেবদক্ষিনাম
ন পুজাফলমাপ্নোতি বিঘ্নস্তস্য পদে পদে।
কবচেনাবৃতো নিত্যং যত্র তত্রৈব গচ্ছতি
তত্র তত্রভয়ং তস্য ন ক্ষোভং বিদ্যতে ক্কচিৎ।
 

কালীপুজোয় রাত জাগবেন? তা হলে মাথায় রাখুন এসব

কালীপুজোর রাতে রাত জাগুন নিয়ম মেনে। কালীপুজো মানেই উপোস করে সারা রাত জেগে পুজো। গোটা একটা দিন উপোস, তার উপর সারা রাত পুজোয় অংশ নেওয়া— সব মিলিয়ে শরীর কিন্তু সমস্যায় ফেলতে পারে। খালি পেটে সারা রাত পুজোর নানা কাজে অংশ নেওয়া খুব সহজ নয়। উপোসের অভ্যাস না থাকলে শরীর খারাপ তো হবেই, সঙ্গে হঠাৎ রক্তচাপ কমে গিয়ে বড় বিপদও ঘটতে পারে। তাই কালীপূজাতে রাত জাগার আগে মেনে চলুন কিছু পরামর্শ, যাতে রাত জাগলেও অসুস্থ হয়ে পড়বেন না সহজে।
● উপোস করলে ডাবের জলে গলা ভেজান মাঝে মাঝেই।
● নির্জলা উপোস কিন্তু শরীরের জন্য একেবারেই ভাল নয়। তাই চেষ্টা করুন তা এড়িয়ে চলতে। এতে অ্যাসিডিটির আশঙ্কা কমবে। উপোস বলতে মূলত ভারী কোনও খাবার না খাওয়া। সে ক্ষেত্রে বদহজম ও অ্যাসিডিটি এড়াতে সারা দিন চা-কফি, ডাবের জল, লস্যি বা ফল খেতে পারেন।
● উপোস করে রাত জাগলে পুজো শুরুর আগে একটু ঘুমিয়ে নিন। এতে শরীর একটু হলেও আরাম পাবে। বাকি রাত জাগতে সুবিধা হবে।
● পুজোর সময় চেষ্টা করুন ধূপ-ধুনোর ধোঁয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখুন। একেবারে খালি পেটে থাকলে এ সব ধোঁয়া শরীরে প্রবেশ করলে ক্লান্তি তো বাড়বেই, সঙ্গে ধোঁয়ার কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস শরীরকে অসুস্থ করে তুলবে সহজেই।
● একান্ত হোম-যজ্ঞের মাঝে বসতে হলে একটা পাতলা রুমাল বা কাপড় নাকে ঢেকে বসুন।
● অনেকেই উপোস করেন না কিন্তু পুজোয় রাত জাগেন। রাত জাগার ইচ্ছা থাকলে মদ্যপান একেবারেই নয়। মদ শরীরের স্নায়ু ও মস্তিষ্ককে শিথিল করে, ফলে ঘুম পেতে বাধ্য।

কালী পূজোর দিন কিছু টোটকার মাধ্যমে ভাগ্য ফেরান

১) কালী পূজোর দিন সকাল থেকে সারা রাত একটা ঘি-এর প্রদীপ ঘরের ঠাকুরের আসনে জ্বালিয়ে রাখুন, খেয়াল রাখতে হবে সেটা যেন নিভে না যায়।
২) কালী ঠাকুরের মন্দিরে কিছুটা আতপ চাল, একটি গোটা নারকেল, ১০৮ টি জবা ফুলের মালা এবং কিছুটা ঘি দান করুন।
৩) কালী পূজার দিন রাতে বাড়ির ছাদে একটি কালো পাঁচ-মুখী প্রদীপ জ্বালুন।
৪) কালী পূজার দিন সন্ধ্যার পর বট গাছের গোঁড়ায় তিন বার কালো তিল রাখুন। মনের আশা পূর্ণ হবে।
৫) কালী পূজার উপবাস যারা করেন, তারা পূজার পরের দিন ব্রাহ্মণ ভোজন করান, তাতে ফল খুব ভাল পাবেন।
৬) কোনও মন্দিরে একটি খাড়া দান করুন।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.