রথযাত্রা , অম্বাবুচি, খার্চি পূজা এই অনুষ্ঠান গুলির পড়ে আসে গুরু পূর্ণিমা। প্রত্যেক বছর আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই বিশেষ অনুষ্ঠান পালিত হয় ।অনেকেরই মনে এই ধারণা জাগতে পারে যে গুরুর আরাধনার জন্য, ডাকার জন্য, কোন বিশেষ দিনে কেন প্রয়োজন?আমরা তো যে কোন দিনে করতে পারি। কথাটা কিন্তু চিরন্তন সত্য। তাহলে আসুন জেনে নেই কেন আষাঢ় মাসের শুক্ল পূর্ণিমা তিথিতে গুরু পূর্ণিমা পালন করা হয়?
গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর।
গুরুরেব পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ
ভারতের অনেক জায়গায় আবার এই পূর্ণিমাকে ‘ব্যাস পূর্ণিমা’ বলা হয় । গুরু পূর্ণিমাকে মহাঋষি বেদব্যাসের জন্মতিথি হিসেবেও মানা হয়। তিনি ছিলেন ঋষি পরাশর এবং মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর সন্তান। জন্মের পরে তাঁকে পরিত্যাগ করেন জন্মদাত্রী সত্যবতী।
আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে ঋষি বেদব্যাসের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন ঋষি পরাশরের পুত্র। আষাঢ় মাসের শুক্লা পূর্ণিমা তিথিতে একটি দ্বীপে তিনি জন্মলাভ করেন। ঋষি বেদব্যাসের আরেকটি নাম ছিল কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। জন্মের সময় বেরোব সে গায়ের রং শ্যাম বর্ণ থাকায় উনাকে ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন নামে অনেকে জানেন। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ শ্রীমৎ ভাগবত এর রচয়িতা হলেন ঋষি বেদব্যাস। ঋষি বেদব্যাস ছিলেন মহা পন্ডিত।
এই সন্তানই মহাঋষিতে পরিণত হন। তিনি বেদ কে শতশাখাপ্রশাখাযুক্ত চার ভাগে ভাগ করেন বলে তাকে ব্যাসদেব বলা হয়। মহাভারতের রচয়িতা এই ব্যাসদেব। তার জন্ম হয়েছিলো এই পূর্ণিমা তিথিতে। মনে করা হয় তার মাধ্যমের এই গুরু শিষ্যের রীতির প্রচলন হয়। এই দিন তার শিষ্যরা ২১৬ স্তোত্রের ‘গুরুগীতা’ থেকে স্তোত্র পাঠের মাধ্যমে ‘ ব্যাস পূজা’ শুরু করে।
অতীত ,বর্তমান , ভূত ভবিষ্যৎ,চন্দ্র,সূর্য,নক্ষত্র,গীতা, মহাভারত সবকিছু সম্পর্কে তার পাণ্ডিত্য ছিল সবার উপরে। তিনি প্রায় ৬০ লক্ষ শ্লোকের রচনা করেছিলেন। যদিও এই লক্ষাধিক শ্লোকের মধ্যে মাত্র ১ লক্ষ শ্লোক মর্ত্যলোকের জন্য ছিল। ৩০ লক্ষ শ্লোকের সংহিতা শুধুমাত্র দেব লোকের জন্যই ছিল। ১৫ লক্ষ শ্লোকের সংহিতা প্রচারিত হয়েছিল পিতৃ লোকের জন্য। আর বাকি ১৪ লক্ষ শ্লোক এর সংহিতা রচিত হয়েছিল অক্ষ লোকের জন্য।
অষ্ট চিরঞ্জীবী মধ্যে একজন ছিলেন মহর্ষি বেদব্যাস। তিনি জগতের গুরু।
আর এভাবেই প্রচলিত হয় গুরু পূর্ণিমা। নেপালে এই দিনটিকে ‘ শিক্ষক দিবস ‘ হিসেবে পালন করা হয়। বৌদ্ধধর্মেরগুরু শব্দটি সংস্কৃত, ‘গু’ এবং ‘রু’ এই দুটি শব্দ দ্বারা গঠিত। গু শব্দের অর্থ অন্ধকার বা অজ্ঞতা এবং রু শব্দের অর্থ আলো। অর্থাৎ যিনি অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যান তিনিই গুরু। মনের অন্ধকারকে দূর করে শিষ্যকে আলোর পথ দেখান গুরু। প্রাচীনকালে ছাত্র শিক্ষক বা গুরু শিষ্যের সম্পর্ক কিরুপে ছিলো তা বোঝা যায় এই পূর্ণিমার নাম করণ হতে। শুধু মাত্র জগতের সকল গুরদের উৎসর্গ করা হয়েছে এই একটি দিন। আর তাই এই পূর্ণিমা গুরু পূর্ণিমা নামে পরিচিতি লাভ করে। আষাঢ় মাসের এই পূর্ণিমাকেই আমরা গুরু পূর্ণিমা নামে জানি।
প্রথম গুরুর জন্মের দিন হল গুরু পূর্ণিমা। যোগের সংস্কৃতিতে, শিবকে ভগবান মানা হয় না, তাকে আদি-যোগী বলে গণ্য করা হয়। সর্বপ্রথম যোগী। যেই দিন তিনি নিজেকে একজন গুরু হিসেবে রূপান্তরিত করলেন, আদি-যোগীতে রূপান্তরিত করলেন, সেই পূর্ণিমার দিনটিকে গুরু পূর্ণিমা হিসেবে উদযাপন করা হয়।
আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে, বছরের ঠিক এমন সময়ে, দেবাদুদেব মহাদেব নজর ফেরালেন তার সাত শিষ্যের ওপর – যাদের আমরা আজ সপ্ত-ঋষি বলে জানি। অত্রি, বশিষ্ঠ, পুলহ, অঙ্গীরা, পুলস্থ্য, মরীচি এবং ক্রতু ( নাম নিয়ে মতভেদ আছে) এই সাতজন চুরাশি বছর ধরে তারা নিজেদের তৈরি করছিলেন। তারপর যখন পৃথিবীর গতিপথ উত্তর থেকে দক্ষিণমুখি হল, যেটাকে আমরা উত্তরায়ন-দক্ষিণায়ন বলি, সেই দিন আদি-যোগী সপ্তঋষিদের দিকে চেয়ে দেখলেন যে তারা উজ্জ্বল দীপ্তিশীল আধার হয়ে উঠেছে। তখন তিনি তাদের আর উপেক্ষা করতে পারলেন না। মন দিয়ে তাদের নিরীক্ষণ করলেন, এবং তার পরের পূর্ণিমাতে তাদের গুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। দক্ষিণমুখি হয়ে, যোগ-বিজ্ঞানের শিক্ষাপ্রদান শুরু করলেন। আদিযোগী শিব এই তিথিতে আদিগুরুতে রূপান্তরিত হন। তিনি এদিন ওই সাত ঋষিকে মহাজ্ঞান প্রদান করেন। তাই এই তিথি হল গুরুপূর্ণিমা |
অনুসারীদের কাছের এই দিনটি বিশেষ গুরুত্ববহ। কথিত আছে, এক আষাঢ়ি পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধার্থ রূপে মাতৃগর্ভে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন।
সূত্রঃ