আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মান্ড, কতা জানা অজানা রহস্যে ঘেরা। সৃষ্টির পর থেকে প্রতিনিয়ত আমরা ছুটে চলছি অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে, ঘটে চলছে নিত্য নূতন বিস্ময়কর ঘটনা। আর যার সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন একজন , যার আদি নেই ,অন্ত নেই, কখনো নিরাকার আবার কখনো সাকাররুপে বিরাজমান, যিনি হচ্ছেন স্বয়ম্ভু ভগবান বা ঈশ্বর।
সবকিছুর ক্ষেত্রে ‘বিশ্বাস’ হচ্ছে সব থেকে গুরুত্ত্বপূর্ণ। কেননা এ কথা আমরা সকলেই জানি যে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’।আপনি যদি মনে প্রাণে কোন কিছু বিশ্বাস করে থাকেন তাহলে তা বাস্তবে রূপ নিবেই। সে ভালো বা মন্দ হোক।
ঠিক তেমনি মানুষের এই বিশ্বাসের উপরেই আজো টিকে আছে ধর্ম এবং যতদিন এই বিশ্বাস মানুষের মনের মধ্যে থাকবে ততদিন ধর্ম চলতে থাকবে তার আপন মহিমায়।
ঠিক তেমনি এই গ্রহণ, হোক সেটা সূর্যগ্রহণ অথবা চন্দ্রগ্রহণ, তা নিয়ে একধরনের বিশ্বাস বা মিথ প্রচলিত রয়েছে সেই মানব জাতি সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে। আজকে ঠিক তেমন কিছু মিথ, বিশ্বাস, প্রচলিত কাহিনী, যা এই গ্রহণ নিয়ে প্রচলিত রয়েছে তা জানানোর চেষ্টা করব। মানুষ মাত্রই ভুল হতে পারে, তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সকলে।
প্রথমেই আসব হিন্দু ধর্মে এই গ্রহণ নিয়ে প্রচলিত মিথ বা বিশ্বাস নিয়ে।
হিন্দু পুরাণ মতে স্বর্গের দেবতারা এবং অসুরেরা মিলে সমুদ্র মন্থন করে অমৃতসুধা পান করে চির অমর হয়ে থাকতে চান। সেই উদ্দেশ্য তারা ঠিক করেন যে ক্ষীরসাগরকে মন্থন করা হবে।
সে জন্য মন্দর পর্বতকে মন্থন্দন্ড হিসেবে এবং দেবাদিদেব মহাদেব এর স্কন্ধসঙ্গী নাগরাজ বাসুকীকে মন্থনরজ্জু হিসেবে ব্যাবহার করা হয়। মন্থনরত ক্ষীরসাগর থেকে একসময় দৈব বৈদ্য যিনি ধন্বন্তরি নামে পরিচিত একটি অমৃৃতের পাত্র নিইয়ে সাগর থেকে আবির্ভূত হন৷
অমৃৃত প্রাপ্তির জন্য দেবতা ও অসুরদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হলো৷ অসুরদের কবল থেকে অমৃতের পাত্রটিকে রক্ষা করার জন্য পক্ষীরাজ গরুড় তৎক্ষণাৎ পাত্রটিকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অন্যত্র উড়ে চলে যায়৷
তারপর যখন দেবতারা এই অমৃত পান করতে যান বিপত্তিটা ঠিক তখন ই বাধে।একই সময় স্বরভানু মতান্তরে রাহু নামের এক অসুর এই অমৃত পান করে। কিন্তু তা আবার দেখে ফেলে সূর্যদেব এবং চন্দ্রদেব।
তারা এই কথা মোহিনীরুপধারী ভগবান শ্রী বিষ্ণুকে জানানো মাত্রই তিনি তার সুদর্শন চক্রের সাহায্যে স্বরভানুর মস্তক দেহ থেকে আলাদা করে ফেলেন। কিন্তু অমৃত তার মুখ দিয়ে গলা পর্যন্ত প্রবেশ করার ফলে তা অমর হয়ে যায়।
তার এই মস্তক কে আমরা রাহু বলে জানি এবং দেহ কে কেতু বলে জানি আমরা। যেহেতু সূর্য এবং চন্দ্রদেব এর কারনে ভগবানশ্রী বিষ্ণু রাহুর মস্তক ছিন্ন করে ফেলেন তাই সে মাঝে মাঝে সূ্র্য ও চন্দ্রকে গিলে ফেলে এবং সূ্র্য ও চন্দ্র কিছুক্ষনের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়।
আর একেই আমরা গ্রহণ বলে জেনে আসছি।যেহেতু রাহুর শুধু মস্তক আছে তাই সূর্য বা চন্দ্রকে গিলে ফেললেও তা আবার কিছুক্ষনের মধ্যেই তার কাটা মস্তক থেকে বেড়িয়ে আসে। তখন আবার আলোকিত হয়ে যায় পৃথিবী।
আবার বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের মতে গৌতম বুদ্ধ জন্ম মৃত্যু ও বুদ্ধত্ব লাভ সবই করেন একটি বিশেষ পূর্ণিমাতে। বৌদ্ধ পালিশাস্ত্র অনুসারে, রাহু সূর্য ও চন্দ্রকে গ্রাস (গ্রহণ) করলে সূর্য ও চন্দ্র বুদ্ধদেবের স্তোত্র পাঠ করে যার ফলশ্রুতিতে তারা রাহুর কবল থেকে আবার বেরিয়ে আসে। এরপর বুদ্ধদেব রাহুর মস্তক সাতটি টুকরো করে দেন।
এছাড়া বিভিন্ন দেশ ও জাতির কাছে বিভিন্ন রকম কাহিনী প্রচলিত আছে এই গ্রহণ নিয়ে।
যেমন প্রাচীন চাইনিজরা মনে করত যে আকাশে এক খারাপ ড্রাগনের বাস।সেই মাঝে মাঝে সূর্য ও চাঁদকে গিলে ফেলে এবং তখন ই গ্রহণ হয়।
ভিয়েতনামিরা মনে করত বিশাল আকৃ্তির ব্যাঙ রয়েছে আকাশে যে সূ্র্যকে গিলে ফেলার কারনে সূর্যগ্রহণ হয়ে থাকে।মায়া সভ্যতার মানুষেরা মনে করতে বিরাট সাপরুপি এক রাক্ষস সূর্য্কে গিলে ফেলে ,অন্যদিকে হাঙ্গেরীয় দের কাছে বিরাট পাখীরুপী রাক্ষস , সাইবেরীয়দের কাছে ভাল্লুকরুপী রাক্ষস এবং কোরিয়ানদের কাছে কুকুররুপী রাক্ষসের সূর্যকে গিলে খাবার কারনেই এই গ্রহণ।
ভাইকিংদের বিশ্বাসমতে, স্কোল নামের একটি নেকড়ে সূর্য চুরি করে। আর তখনই হয় সূর্যগ্রহণ। কিন্তু ওই নেকড়ে সূর্যকে বেশিক্ষণ রাখতে পারে না নিজের কাছে। কারণ গ্রহণের সময় ভাইকিংসরা নাকি প্রচুর কোলাহল করত। আর সে কোলাহলের শব্দে ভয় পেয়ে ওই নেকড়ে সূর্য ছাড়াই পালিয়ে যেত।আর এভাবেই নেকড়ের কাছ সূর্যকে উদ্ধারও করে অবশ্য ভাইকিংসরা।
বহু প্রাচীন সভ্যতাই গ্রহণকে বিবেচনা করেছে সূর্য ও চাঁদের সাথে যুদ্ধ হিসেবে। ইনুইট লোকসাহিত্যের কথাই ধরা যাক।এই বর্ণনা অনুযায়ী, চন্দ্র দেবতা অ্যানিংটন ও সূর্য দেবী ম্যালিনার মধ্যে একবার তীব্র ঝগড়া হয়। এতে ভেঙে যায় তাদের ভাই-বোনের সংসার।
ম্যালিনা রাগ করে ঘর ছেড়ে চলে যায়।তারপর থেকে অ্যানিংটন ম্যালিনার পেছনেই ছুটতে থাকে। চলে লড়াই। বেশিরভাগ সময়ই এতে ম্যালিনা জেতে। কিন্তু যখন অ্যানিংটন যেতে, তখন হয় সূর্যগ্রহণ।
ঠিক এই ধরনের যুদ্ধতত্ত্ব হাজির করা হয় আফ্রিকার বাটাম্মালিবাদের উপকথায়। টোগো ও বেনিনের অধিবাসীদের ধারণা অনুযায়ী চন্দ্র-সূর্যের যুদ্ধের কারণেই পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসে। আর বাটাম্মালিবার জনগণ এ সময় সবাই এক হয়ে যখন নিজেদের মধ্যকার হিংসা ও ঝগড়ার সমাধান করবে ঠিক তখন এই যুদ্ধ থেমে যাবে।
ঠিক এই ধারণার কারণে গ্রহণের সময়কে এই অঞ্চলের অধিবাসীরা আজো বিবেচনা করে পুনঃনির্মানের সময় হিসেবে।
প্রাচীন গ্রীসের বাসিন্দারা এই গ্রহণের ঘটনাকে অনেকটা নেতিবাচক চোখে দেখত কেননা তাদের বিশ্বাস ছিলো যখন দেবতারা রুষ্ট হন তখন ই তারা সূর্য এবং চাঁদকে আড়াল করে ফেলেন এবং তখনি এই গ্রহণ সংগঠিত হয়।
তাহলে বেপারটা দাড়াচ্ছে পুরোটাই বিশ্বাসের উপরে । আর আমাদের উচিত প্রত্যেক মানুষের বিশ্বাস কে সম্মান জানানো।
ছবিঃ ইন্টারনেট (গুগল)