তাল নবমীর ব্রতকথা

talnobomi

ভাদ্র মাসের ‘তালপাকা’ গরমে তাল নিয়ে লেখাটা খুব আনন্দদায়ক নয়। ব্যাপারটা একটু বেতালই বটে! আবার এই ভাদ্রের গরমেই পাকা তাল খেতে হয়। কী এক অদ্ভুত বৈপরীত্য! জীবন যখন বৈপরীত্যের ঘেরাটোপে বন্দী তখন তালের বেতাল গল্প কতটাই–বা গায়ে লাগে? তালগাছকে কল্পদ্রুমও বলা হয়। এই কল্পদ্রুমকে শব্দে বাঁধতে গেলে শব্দ অকিঞ্চিৎকর হবে, সেটাই স্বাভাবিক।

গাছ থেকে শুরু করা যাক। ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে।’—আকাশে উঁকি মারা তালগাছ প্রায় ৬০ ফুটের মতো উঁচু হতে পারে। আর সে কারণেই বহুদূর থেকেও সে গাছ দেখে বলা যায় ‘ওই দেখা যায় তালগাছ, ওই আমাদের গাঁ’। সব তালগাছেই যে তাল হবে, তা নয়। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি, ‘পুরুষ’ গাছে তাল ধরে না—সে গাছ থেকে শুধুই রস পাওয়া যায়। তাল হয় ‘মাতরি’ (‘মাতৃ’র অপভ্রংশ) বা নারী গাছে।

কাঁচা ও পাকা—দুই অবস্থায়ই তাল সুস্বাদু খাবার। শুধু মাঝখানের সময়টাতে তালের স্বাদ তিতা। কচি তাল কচি ডাবের মতোই সুস্বাদু। জ্যৈষ্ঠের খরতাপে এই কচি তালশাঁস তৃষ্ণা নিবারণ তো করেই, সঙ্গে তালের শাঁসে থাকা জলীয় অংশ শরীরের পানিশূন্যতা দূর করে দেহ রাখে ক্লান্তিহীন। ডাবের পানির মতোই এটি প্রাকৃতিকভাবে আমাদের শরীরে শক্তি জোগায়।

পুষ্টিবিদেরা বলেন, প্রতি ১০০ গ্রাম তালশাঁসে রয়েছে ৮৭ কিলো ক্যালরি, ৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, জলীয় অংশ ৮৭.৬ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ১০.৯ গ্রাম, খাদ্য আঁশ ১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৩০ মিলিগ্রাম, লোহা ১ মিলিগ্রাম। এ ছাড়া আছে আমিষ, চর্বি, থায়ামিন, রিবোফাভিন, নিয়াসিন, ভিটামিন সি। দেখা যাচ্ছে, বেশ পুষ্টিকর খাবার এই তালশাঁস।

আষাঢ় ও শ্রাবণ—এ দুই মাস তাল খাওয়ার চল নেই। এ সময় তাল বড় হতে থাকে। এই বড় হতে থাকার সময় এর স্বাদ তিতা হয়। বর্ষা শেষ হয়ে শরতের প্রথমে তাল পাকতে শুরু করে ভাদ্রের প্রচণ্ড গরমে। মূল তাল খাওয়া শুরু এ সময়েই। পাকা তাল গাছ থেকে খসে পড়ে। আমকুড়ানির মতো ‘তালকাড়ানি’ সুখও এক ব্যাপার। শরতের লিলুয়া বাতাসে পাকা তাল ধুপধাপ খসে পড়লে কাড়াকাড়ি করে তার দখল নেওয়া শৈশবের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই বটে।

পাকা তালের রস বা কাইয়ের সঙ্গে চালের গুঁড়া আর গমের আটা মিশিয়ে বানানো হয় তালের বড়া, চালের গুঁড়া মিশিয়ে বানানো হয় পিঠা, দুধের সঙ্গে তালের রস মিশিয়ে বানানো হয় তালক্ষীর। এ ছাড়া কোথাও কোথাও খাওয়া হয় তালের রুমালি রুটি, ময়দা-আটার সঙ্গে মেখে পরোটা, তালের সরু চাকলি মানে তাওয়ার ওপর রেখে বানানো হলদে সাদা রঙের ফিনফিনে দোসা-ক্ষীরে ডুবিয়েই যা খাওয়ার নিয়ম।

এ ছাড়া এই আধুনিক সময়ে রন্ধন পটীয়সীরা তৈরি করে থাকেন কলাপাতায় তালপিঠা, তালের স্পঞ্জ কেক, কেক গ্লেইজ। চিন্তার কোনো কারণ নেই, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় এসবের রন্ধনপ্রণালি ঘুরে বেড়ায় আকছার। পছন্দমতো একটি বেছে নিয়ে রেঁধে ফেলতে পারেন।

সম্ভবত সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় তালের ফুলুরি। অমৃত লাল বসু বলেছেন, ‘তাল ফুলুরির তত্ত্বে করিয়া জমক/ ধার্য হল লোক মাঝে লাগাবে চমক।’ আটার সঙ্গে তালরস বা কাই মিশিয়ে ডুবো তেলে ভেজে নিলেই হয়ে যায় তালফুলুরি। নোনতা নাকি মিষ্টি, সে স্বাদের ব্যাপারটা নির্ভর করবে ‘খানেওয়ালা’দের ওপর—নোনতা খেলে লবণ আর মিষ্টি খেলে গুড়। সাধারণত মানুষ তালফুলুরি মিষ্টিই খায়।

জন্মাষ্টমী, নন্দোৎসব এবং ভাদ্র মাসের শুক্লা নবমীতে ‘তালনবমী’ ব্রত—হিন্দু সম্প্রদায়ের এই তিন পরবের মূল উপাদান তাল ও তাল দিয়ে তৈরি খাবার। তালের ভেষজ গুণ প্রচুর। বলা হয়ে থাকে, পাকা তাল ঘুম, মূত্র, রক্ত, কফ, শুক্র ও পিত্তবর্ধক।

ঘটি না ডুবলেও বাঙালি পুকুরের নাম রাখে ‘তালপুকুর’। বাঙালির যাপিত জীবনে তালগাছ কেন পুকুরপাড়ে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা থাক আর না থাক, স্বাদে-গন্ধে বেতাল করে তোলা এই ভাদ্র মাস হোক তালময়।

এতক্ষণ তো তাল সম্পর্কে জানলাম এবার দেখে নিই তালনবমীর ব্রতকথা সম্পর্কেঃ

ভাদ্র মাসের শুক্লা নবমী তিথিকে ‘তালনবমী’ বলা হয়। এ দিনের পূর্বে রাধাষ্টমী ও এর ১৫ দিন পূর্বে জন্মাষ্টমী পালন করা হয়ে থাকে। তাই জন্মাষ্টমীর ও রাধাষ্টমীর পরে এই তালনবমী তিথি পালন করা হয়ে থাকে। এই দিন থেকে ঘরে ঘরে দশোহরা বা দূর্গাপূজার প্রস্তুতি শুরু হয় প্রতিটা ঘরে ঘরে। এই ব্রত সাধারণত পূর্ব ভারতে পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু পূর্ব ভারত ছাড়াও ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানেও এই তালনবমীব্রত অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়।

ব্রতের নিয়মঃ সারাদিন উপোস থেকে সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার পর এই উপোস ভঙ্গ করতে হয়।

ব্রতের ফলাফলঃ যে নারী এই তাল নবমীব্রত পালন করে থাকে সেই নারী জন্মজন্মান্তরে সধবা থাকেন, সৌভাগ্যবতী হন এবং মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পূষ্ট হন।

এই ব্রত নববর্ষ আচরণ করে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। তালের সাথে প্রতিবছর নয়রকম ফল দেবতাকে নিবেদন করতে হয়। নৈবদ্য হিসেবে ফলমূলের সাথে তালের লুচি, পিঠা, ফুলুড়ি ইত্যাদি নিবেদন করতে হয়। মূলত লক্ষ্মী নারায়ণের পূজা ও তালফলটি নারায়ণকে দানকরে তবেই খাওয়ার রীতি। তালের পিঠা, তালক্ষীর ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।

ভগবান শ্রী কৃষ্ণের স্ত্রীদের মধ্যে অন্যতম দুই স্ত্রী হলেন সত্যভামা ও রুক্ষ্মীনী। শ্রী কৃষ্ণের কাছে কে বেশি প্রিয় এ নিয়ে তাদের মধ্যে অন্তর্দন্ধ লেগেই থাকতো। সত্যভামা ছিলেন দুর্ভাগ্যবতী আর রুক্ষ্মীনী ছিলেন সৌভাগ্যবতী। একদিন সতভামা কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর এই দুর্ভাগ্যের কারণ কি? প্রত্যুত্তরে নারায়ণ বললেন এ দুর্ভাগ্যের জন্য তুমি নিজেই দায়ী। তুমি তোমার নিজের দোষেই কষ্ট পাচ্ছ।

এরপর সত্যভামা মনের দুঃখে তপোবনে আপস্তম্ব মুনির আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হলেন। মুনিকে সব খুলে বললেন। সব বলার পর মুনি সত্যভামার ঘটনা শুনে খুব ব্যথিত হলেন। তারপর সত্যভামার দুঃখ দূর করার নিমিত্তে সত্যভামা কে এই কাহিনীটা বললেন।

ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে ভক্তিসহকারে লক্ষ্মী নারায়ণের পূজা করবে। মৃত্তিকার উপর মন্ডপ প্রস্তুত করবে। তারউপরে ঘট বসাবে। ঘটের উপরে চন্দন, ফুল ও নৈবদ্য দ্বারা পূজা করবে। লক্ষ্মী নারায়ণ কে পৃষ্ঠক নিবেদন করবে। প্রথমে নারায়ণ পরে লক্ষ্মীর পূজা করবে। এই ব্রতে নয় রকম ফল দিতে হয়। তারমধ্যে তাল প্রধান এবং অবশ্যই দিতে হবে। প্রথমে স্বামীকে খেতে দিয়ে তারপর ব্রাহ্মণকে পৃষ্ঠক ভোজন করাতে হবে। স্বামীর খাওয়ার পর স্ত্রী পৃষ্ঠক আহার করবে। এই প্রকারে নয় বছর এই ব্রত পালন করতে হয়।

তারপর সত্যভামা বন থেকে বাড়িতে ফিরে এলেন। এবং মুনির পরামর্শ মত ব্রত শুরু করলেন। ব্রত যখন ৯ বছর সমাপ্ত হল তখন স্বয়ং নারায়ণ এসে সেখানে উপস্থিত হলেন। এবং সত্যভামা কে বরদান দিলেন, “তালনবমী ব্রতের ফলে তোমার সব দুর্ভাগ্য দূর হল। খুব তাড়াতাড়ি তুমি সৌভাগ্যশালীনি হবে।”

এরপর থেকেই তালনবমী ব্রত পালন করে থাকে আমাদের নারীগণ।

সূত্রঃ প্রথমআলো, ইউটিউব

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.