তুলসী মূলত কে?এই ভূমন্ডলে কীভাবে হলো তুলসীর আবির্ভাব?

মন্দির প্রাঙ্গণে ও সনাতন ধর্মাবল্মীদের গৃহাঙ্গনে পবিত্র তুলসী বৃক্ষ রাখা হয় এবং তার পূজা-অর্চনা করা হয়। সাধারণ বিচারে তুলসী(Tulsi/Holy/Basi) একটি  Lamiaceae পরিবারের অন্তর্গত এক সুগন্ধি ও ঔষধি উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum sanctum ( sanctum অর্থ পবিত্র স্থান) যা প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে পবিত্র বৃক্ষরূপে পূজিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।

তুলসীদেবী বা বৃন্দা,কৃষ্ণের প্রিয়া রাধীকার সহচরী ছিলেন। গোলোক বৃন্দাবনে (চিন্ময়জগতে) গোপিকা বৃন্দাদেবীরূপে তুলসী রাধাকৃষ্ণের নিত্য সেবিকা এবং তাদের বিচিত্র দিব্য লীলা সম্পাদনের মূল পরিচালিকা। শীমতি বৃন্দাদেবী ছিলেন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পন্ডিতা। তিনি সমস্ত দেবীগণের মধ্যে পবিত্ররূপা এবং সমুদয় বিশ্বের মধ্যে তাঁর তুলনা নেই বলে তিনি তুলসী নামে কীর্তিতা (ব্র.বৈ.পু. প্রকৃতিখন্ড, ২২.২৪, ৪২)।তাকে ভক্তিদেবী বা ভক্তিজননী বলেও সম্বোধন করা হয়ে থাকে তার প্রবল কৃষ্ণভক্তির জন্য। বৃন্দাদেবীর আজ্ঞাতেই বৃন্দাবনে পত্র, পুষ্প, ফল, ভ্রমর, মৃগ, ময়ূর, শুক-শারী ইত্যাদি পশুপাখিরাও পরম চিরবসন্ত রমণীয় শোভা ধারণ করে। সৃষ্টির শুরুতে স্বায়ম্ভূব মন্বন্তরের প্রথম পাদে তিনি কেদার রাজার কন্যারূপে বৃন্দাদেবী নামে যজ্ঞকুন্ড থেকে আবির্ভূত হন। তিনি যে বনে তপস্যা করেছিলেন তাই এই  জগতে বৃন্দাবন নামে প্রসিদ্ধ হয়। 

 

রাধাকৃষ্ণের নিত্যপ্রিয়া ও সেবিকা  বৃন্দাদেবী তথা তুলসী জগতের কল্যাণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন যুগে ও মন্বন্তরে ভিন্ন ভিন্নভাবে ভিন্ন ভিন্ন রূপে এ মর্তে আবির্ভূত হন। 

 

তুলসীর আবির্ভাব সম্পর্কে পুরাণে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। 

একই তুলসীদেবী কখনো ধর্মধ্বজ কন্যা, চন্দ্রভানু কন্যা, আবার কখনো কেদাররাজের কন্যারূপে ,কখনো বা আবার জলদ্ধরের পত্নী, শঙ্খচূড়ের পত্নী, ধর্মদেবের পত্নীরুপে, আবির্ভূত হয়েছেন। এই প্রত্যেক কন্যাই এক বৃন্দাদেবী এবং প্রত্যেক জন্মেই তিনি কৃষ্ণভক্তিপরায়ণা ছিলেন।  

 

 

 

 ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লেখ আছে যে,

গোলকে (স্বর্গে) একদিন তুলসীকে কৃষ্ণের সঙ্গে ক্রীড়ারত অবস্থায় দেখে রাধিকা তুলসীকে অভিশাপ দেন যে, “তুমি মানবীরূপে জন্মগ্রহণ করবে”। এই ঘটনায় কৃষ্ণ অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে তুলসীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, মানবীরূপে জন্মগ্রহণ করলেও তপস্যা দ্বারা আমার একাংশ প্রাপ্ত হতে পারবে। রাধিকার শাপে তুলসী মর্তের এক রাজা ধর্ম ধর্ব্বজের ও মাতা মাধবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তুলসী নামে অধিষ্টিত হন।

অত:পর তুলসী বনগমণ করে ব্রহ্মার কঠোর তপস্যায় শুরু করেন,তার কঠোর তপস্যায় ব্রহ্মা স্থির থাকতে না পেরে প্রসন্ন হন এবং  তাকে বর দিতে সম্মত হন। তুলসী বলেন তিনি নারায়ণকে স্বামীরূপে চান। ব্রক্ষ্মা বললেন এটাতো সম্ভব নয় এখন বরং তুমি কৃষ্ণের অংশ সুদামের স্ত্রী হও। পরে কৃষ্ণকে লাভ করতে পারবে। রাধিকার শাপে সুদাম দানবরূপে জন্মগ্রহণ করবে এবং তার নাম হবে শঙ্খচূড়। যথা সময়ে শঙ্খচূড়ের সঙ্গে রাজা ধর্ম ধর্ব্বজের কন্যা তুলসীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। শঙ্খচূড়ের বর ছিল যে, “তার স্ত্রীর সতীত্ব নষ্ট হলেই কেওবল তার মৃত্যু হবে নতুবা তার মৃত্যু হবেনা”।

দানবরূপী শঙ্খচূড়ের উৎপাত ও অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে ব্রহ্মার সাথে শিবের শরণাপন্ন  হন। শিব তখন সকলের সঙ্গে নারায়ণের কাছে উপস্থিত  হন। দেবতাদের দুর্দশা দেখে নারায়ণ শিবকে বললেন যে, শূল দ্বারা শিব যু্দ্ধে রত হলে আমি এর স্ত্রীর সতীত্ব নষ্ট করব তখন শঙ্খচূড়ের বিনাশ হবে।  শিব শঙ্খচূড়ের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে নারায়ণ শঙ্খচূড়ের রূপ ধারণ করে শঙ্খচূড়ের স্ত্রীর সাথে ছলনা করে 

তখন শিবের হাতে শঙ্খচূড় নিহত হয়। তার অস্থি লবণ সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত করা হলে সেই অস্থি হতে দেব পূজার জন্য নানা প্রকার শঙ্খের উৎপত্তি হয়। নারায়ণ শঙ্খচূড়ের রূপ ধারন করে তার সতীত্ব নষ্ট করেছেন জানতে হয়ে তুলসী নারায়ণকে অভিশাপ দেন যে, তুমি পাষানে পরিনত হও।যদিও পূর্বে তুলসী ভগবানকে পতিরূপে লাভ করতে চেয়েছিলেন, তবুও সেসময় তার বর্তমান পতিবিয়োগ ও নারায়ণের  এ আপাত ছলনা সইতে না পেরে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হনদ এবং তৎক্ষণাৎ দেহত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। পরে তুলসী তার ভুল বুঝতে পারেন যে, তিনি ভগবান নারায়ণের চরনে পতিত হন। তুলসীকে সান্ত্বনা দিয়ে নারায়ণ বললেন যে,তুমি দেহত্যাগের পর দিব্যদেহ ধারণপূর্বক গোলোকে শ্রীকৃষ্ণকে  পতিরূপে প্রাপ্ত হবে এবং তোমার দেহ থেকে গন্ডকী নদী উৎপন্ন হবে। আর তোমার কেশ থেকে উৎপন্ন হবে তুলসীবৃক্ষ যা হবে সকলের পুজনীয়া।

পদ্মপুরাণে তুলসী সম্বন্ধে কথিত আছে, বৃন্দা ছিলেন জলন্ধর নামে এক অসুরের স্ত্রী । জলন্ধর ইন্দ্রকে পরাজিত করে অমরাবতী দখল করল, ইন্দ্র তখন শিবের শরনাপন্ন হলেন। শিব জলন্ধরের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলে পতিপরায়ণা বৃন্দা স্বামীর প্রানরক্ষার জন্য বিষ্ণু পূজায় প্রবৃত্ত হন। কিন্তু বিষ্ণু জলন্ধরের রূপ ধারণ করে বৃন্দার সামনে আসেন। স্বামীকে অক্ষত দেহে ফিরে আসতে দেখে, বৃন্দা অসমাপ্ত বিষ্ণু পূজা ত্যাগ করে ফিরে আসেন এবং জলন্ধরের মৃত্যু হয় ( অন্য মতে বৃন্দার সতীত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে জলন্ধরের মৃত্যু হবে না জেনে বিষ্ণু জলন্ধরের রূপ ধরে বৃন্দার সতীত্ব নাশ করেন। বৃন্দা সমস্ত ব্যাপার জেনে বিষ্ণুকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হন। সতীর সাপ অমোঘ জেনে বিষ্ণু ভয় পান এবং বৃন্দাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন যে, তুমি সংযত হও তোমার ভস্মে তুলসী, ধাত্রী, পলাশ ও অশ্বত্থ এই চারিপ্রকার বৃক্ষ উৎপন্ন হবে। বৃন্দা হতেই তুলসীর জন্ম।

 

সোর্সঃউইকিপিডিয়া;  পৌরাণিক অভিধান– রচনায় সুধীর চন্দ্র সরকার।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.