নবরাত্রি নবদূর্গার তৃতীয়রূপ দেবী চন্দ্রঘন্টা

পিণ্ডজপ্রবরারূঢ়া চণ্ডকোপাস্ত্রকৈর্যুতা।
প্রসাদং তনুতে মহ্যং চন্দ্রঘণ্টেতি বিশ্রুতা।।

দেবী চন্দ্রঘণ্টা দেবী পার্বতীর তৃতীয় রূপ। নবদুর্গার তৃতীয় রূপ চন্দ্রঘণ্টা। নবরাত্রি উৎসবের তৃতীয় দিনে তাঁর পূজা করা হয়। তিনি হিমালয় কন্যা শিবের স্ত্রী। দেবীর মস্তকে ঘণ্টার আকারবিশিষ্ট একটি অর্ধ্বচন্দ্র শোভা পায়, তাই দেবীর নাম ‘চন্দ্রঘণ্টা’। অবশ্য তিনি ‘চণ্ডঘণ্টা’ বা ‘চিত্রঘণ্টা’ নামেও পরিচিতা।

দেবী চন্দ্রঘণ্টা সিংহবাহিনী (কাশীর মন্দিরে অবশ্য তিনি ব্যাঘ্রবাহিনী), দশভুজা, দশপ্রহরণধারিনী। তাঁর গায়ের রং সোনার মতো উজ্জ্বল; পরনে লাল শাড়ি, গায়ে নানাবিধ অলংকার।

মহিষাসুর বধের আগে দেবতাদের সম্মিলিত জ্যোতি থেকে যখন দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটল, তখন দেবতারা তাঁকে সজ্জিত করলেন নিজ নিজ অস্ত্রে। ইন্দ্র সেই সময় তাঁর বাহন ঐরাবত হস্তীর গলা থেকে ঘণ্টাটি খুলে নিয়ে তা থেকে আর একটি ঘণ্টা সৃষ্টি করে দিলেন দেবীকে। যুদ্ধকালে দেবী যখন এই ঘণ্টা বাজালেন, তখন অসুরসৈন্যগণ হয়ে পড়ল নিস্তেজ। চণ্ডী-র স্তবে আছে:

হিনস্তি দৈত্যতেজাংসি স্বনেনাপূর্য যা জগৎ।
সা ঘণ্টা পাতু নো দেবি পাপেভ্যোঽনঃ সুতানিব।। (১১।২৭)

অনুবাদ- হে দেবী, তোমার যে ঘণ্টার শব্দে দৈত্যেরা নিস্তেজ হয়ে পড়ে, সেই ঘণ্টার শব্দে, মা যেমন করে ছোটো ছেলেদের রক্ষা করেন, তেমনি আমাদের পাপ থেকে রক্ষা করুন।

প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে- রম্ভাসুরের ছেলে মহিষাসুর যখর প্রচণ্ড বিক্রমে দেবতাদের হারিয়ে দিয়ে স্বর্গরাজ্য দখল করেছিল, তখন দেবতারা একত্রিত হয়ে তাঁদের নেতা ব্রহ্ম-বিষ্ণু-মহেশ্বরের শরণাপন্ন হলেন।

তখন ত্রিদেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তাঁদের শরীর থেকে তেজ বাইরে এসে এক জায়গায় পুঞ্জীভূত হতে লাগলো। ক্রমে অনান্য দেবতারাও উত্সাহিত হয়ে নিজের নিজের শরীর থেকে তেজরাশি বাইরে এনে ঐ তেজকে সমৃদ্ধ করলেন।

ফলে দেবতাদের দেহসঞ্জাত তেজ থেকে সৃষ্টি হলো এক অতুলনীয়া দেবীমূর্তির। ইনিই আদিশক্তি। সকল দেবতাদের অন্তরের শক্তিরূপেই তিনি তাদের ভেতরে ছিলেন। তাঁরই শক্তিতে এইসব দেবতারা শক্তিমান ছিলেন।

আজ বিপদাপন্ন হয়ে সেই শক্তিকে বাইরে এনে তাকে দেওয়া হল ঐশী শক্তির দেবীমূর্তি। নানা দেবতার শক্তিতে শক্তিমতী সেই দেবীকে দেখে আহ্লদিত দেবতারা তাঁদের নিজের নিজের অস্ত্রাদি থেকে নূতন অস্ত্র সৃষ্টি করে দেবীর করকমলে সেগুলি ধরিয়ে দিলেন।

তাঁকে নানা অলংকার বস্ত্রাদিও তাঁরা দিলেন-মনের মত করে নানা দ্রব্যসম্ভারে তাঁকে সাজিয়ে তাঁর বন্দনা করে প্রার্থনা জানালেন-মা আমাদের সমূহ বিপদ। অসুর মহিষরাজের হাত থেকে তুমি আমাদের রক্ষা কর, স্বর্গরাজ্য আমাদের ফিরিয়ে দাও।

তাঁকে নানা অস্ত্র-শস্ত্রাদি যখন সব দেবতারা দিচ্ছিলেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র, “দদৌ তস্যৈ সহস্রাক্ষোঘণ্টাম ঐরাবতং গজাৎ” তাঁর বাহন ঐরাবৎ হাতির গলায় ঘণ্টা থেকে একটি ঘণ্টা নিয়ে দেবীর একটি হাতে দিলেন।

ঘণ্টা সর্ববাদ্যময়ী। যুদ্ধ উত্সবে প্রাচীনকালে, এমনকি এখনও নানা বাদ্যাদি বাজানো হয়। যাকে মিলিটারী ব্যান্ড বলে। দেবীর সেই যুদ্ধে এই ঘণ্টা সেই রকম একটি বাদ্য ও বাজনা। তবে এটি দৈবশক্তিসম্পন্ন।

এই ঘণ্টানাদ বিকট শব্দ সৃষ্টি করেছিল “হিরস্তি দৈত্য তেজাংসি স্বনেনাপূর্য্য যা জগৎ”। সেই ঘণ্টার শব্দেই দৈত্যদের প্রাণ ভয়ে খাঁচাছাড়া অবস্থা হয়েছিল। তাদের তেজ হরণ করবার জন্য দেবী সেই প্রচণ্ড শব্দের ঘণ্টাবাজিয়েছিলেন।

তাই যুদ্ধের পরে দেবতারা মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন,মা তোমার ঐ যে ঘণ্টা অসুরদের তেজ হরণ করেছিল সেই ঘণ্টার আমরাও শরণ নিচ্ছি, আমাদের পাপকে সেই ঘণ্টা যেন হরণ করে নেয়। “সা ঘণ্টা পাতু নো দেবি পাপেভ্যো নঃ সুতাম্ইব ”। এই জন্য দেবীর একটি নাম চণ্ডঘণ্টা-যিনি প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন আওয়াজ সৃষ্টিকারী ঘন্টা ধারণ করে আছেন,তিনি চণ্ডঘণ্টা।

কাশীর প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী, দেবী চণ্ডঘণ্টার পূজা করে তাঁকে প্রসন্ন করতে পারলে যমঘণ্টার (যমের বাহন মহিষের গলায় বাঁধা ঘণ্টা) ধ্বনি পূজককে আর ভয় দেখাতে পারে না। দেবীর কৃপায় মহাপাতকীও পাপ থেকে উদ্ধার পান।

কাশীতে লক্ষ্মী চৌতারার চন্দুনাউয়ের গলিতে দেবী চন্দ্রঘণ্টার মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটিও ছোটো। দেবীমূর্তিও এখানে হাতখানেক লম্বা। দেবীর পাশে রাখা থাকে একটি বড়ো ঘণ্টা। আর দেবীকে পিছন থেকে ঘিরে থাকে নবদুর্গার অন্য দেবীদের আটটি ছোটো ছোটো মূর্তি।

শারদীয়া ও বাসন্তী নবরাত্রি উৎসবের তৃতীয় দিনে এই মন্দিরে প্রচুর লোকসমাগম হয়। কথিত আছে, এই দিন সাধকের মন মণিপুর চক্রে প্রবেশ করে এবং সাধকের দিব্যদর্শন লাভ হয়।

চন্দ্রঘণ্টা পূজার ফল অনেক। তাঁর পূজায় সাধকের বাধাবিঘ্ন ও পাপ বিনষ্ট হয় এবং সকল কষ্ট বিনষ্ট হয়। চন্দ্রঘণ্টার উপাসক দেবীর বাহন সিংহের মতো পরাক্রমী হয়।

তাঁর ঘণ্টাধ্বনি সর্বদা চন্দ্রঘণ্টার ভক্তকে সর্ববিধ বিপদ থেকে রক্ষা করে। দেবীর পূজায় পূজকের মন পবিত্র হয়। তাঁর ধ্যান সকল প্রকার কল্যাণ ও সদগতি প্রদান করে।

নবরাত্রির তৃতীয় দিনে দেবী চন্দ্রঘণ্টার আরাধনা করা হয়। দেবী মায়ের অশেষ কৃপা বর্ষিত হউক তার ভক্তদের উপর।

কৃতজ্ঞতাঃ বঙ্গসাহিত্য ও দেবাশীষ কালেকশন

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.