বাস্তু বলছে, গাছের এই গুনাগুন ও বৈশিষ্টানুযায়ী বাগান করলে আপনার বাড়ির পরিবেশ যেমন থাকবে!

বাড়ি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা একটা আর্ট। প্রচুর পয়সা থাকলেও যেমন সুন্দর করে বাড়ি সাজানো যায় না, তেমনই পয়সার জোর কম থাকলেও যে ঘর সাজিয়ে রাখা যায় না এমনটা নয়। সব সময় বাড়ি সাজানোর জন্য পয়সার প্রয়োজন নেই। সুন্দর মন থাকাই যথেষ্ঠ। বাজার থেকে খুব সহজেই ফুলের গাছ, মাটি, টব কিনে আনুন। কিংবা বাড়িতে বাগান থাকলে সেখানেও লাগিয়ে ফেলুন বাহারি ফুল। ঘরের শোভাও বাড়বে আর নিজেরও চোখ জুড়োবে। যাঁরা ফ্ল্যাটে সেভাবে বাগান করার সুযোগ পান না, তাঁরা অনেকেই ব্যালকনিতে গাছ সাজিয়ে রাখেন, কিংবা ছাদে ফুলের গাছের যত্ন করেন।

পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। একদিকে যেমন অরণ্য রক্ষার জন্য সওয়াল চলছে, তেমনই প্রবণতা বাড়ির মধ্যেই যতটা সম্ভব সবুজ টিকিয়ে রাখার। চতুর্দিকে যখন গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, তখন আপনার ঘরের এক কোণেই গড়ে উঠুক টুকরো সবুজ। বিশ্বের বেশিরভাগ বড় শহরের জায়গা অত্যন্ত কম। ছোট-ছোট অ্যাপার্টমেন্ট-এ মাথা গুঁজে থাকতে হয় শহরবাসীকে। কিন্তু তার মধ্যেও পরিবেশের স্বার্থে অনেকেই ইনডোর-প্ল্যান্টস রাখেন। আর ঘরের কোণে গাছ রাখার আগে জেনে নিন এই গরমে কোন গাছ বাস্তুমতে আপনার বাড়িকে আরও শুদ্ধ করে তুলবে।

এ বার প্রশ্ন হল, ইনডোর গার্ডেন বা বাড়ির বাগানে পরিবেশের সত্যিই কতটা লাভ হচ্ছে? বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, পরিবেশের স্বার্থে বাগান করতে হলে, স্থানীয় গাছ ব্যবহার করুন। বিদেশ থেকে আনা, বা অনেক দূর থেকে আনা গাছ একেবারেই ব্যবহার করা উচিত নয়। প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করলেও একই ভাবে পরিবেশের ক্ষতি। সুতরাং পরিবেশের জন্য বাড়িতে বাগান করা খুবই ইতিবাচক, তবে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার।

চলুন এবার দেখে নিই কিছু গাছের গুনাগুন ও বাস্তশাস্ত্র মতে এই গাছগুলির অবস্থান গতভাবে আমাদের পরিবারের উপকারীতা।

হলুদ গোলাপ: বাস্তুমতে সেরা রং হলুদ। ব্যালকনির একপাশে হলুদ গোলাপ গাছের সঙ্গে সকালের চা আর খবরের কাগজ হাতে আপনার জীবন আরও সুন্দর হয়ে উঠুক।

মানি প্ল্যান্ট: যে কোনও পাত্রেই বসানো যেতে পারে মানিপ্ল্যান্ট। মাটির টব, ওয়াইন বোতল, বাটি এমনকি গ্লাসেও বসাতে পারেন মানিপ্ল্যান্ট। বিশেষ কোনও পরিচর্যা ছাড়াই এই গাছ আপনার জীবনে শুভ প্রভাব বিস্তার করবে।

ডোয়ার্ফ জেড: ছোট্ট এই গাছ যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনই বাস্তুমতে অত্যন্ত শুভ ফলদায়ী। এই গাছ ঘরে বা অফিস ডেস্কে রাখলে আর্থিক দিক থেকে আপনি লাভবান হবেন।

তুলসী: হিন্দুমতে তুলসী গাছের উপকারিতা যাবতীয় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। ঘরের মধ্যে অবশ্যই রাখবেন তুলসী গাছ। বাস্ত‌ুশাস্ত্র মতেও বাড়ির উঠোনে তুলসী গাছ থাকা অত্যন্ত কার্যকরী, তুলসীর গন্ধবাহী বায়ু৷ চারিদিকের পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে৷ তুলসী গাছের গন্ধযুক্ত বাতাস সকলের পক্ষেই অত্যন্ত উপকারী৷ তাই সকল বসতবাড়িতেই তুলসী গাছ রাখা উচিত৷

জুঁই ফুলগাছঃ বাড়িতে জুঁইফুল গাছ রাখা শুভ বলে দাবি অনেক বাস্তুশাস্ত্রবিদের। এই ফুল ভগবান বিষ্ণুর প্রিয় ফুল, আবার শিবেরও পছন্দের ফুল। তাই বাড়িতে এই ফুলগাছ রাখলে, তা ইতিবাচক ভাবনা জাগ্রত হয় বাড়ির সদস্যদের মধ্যে। এছাড়াও জুঁইয়ের স্নিগ্ধ গন্ধ সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। মনেও স্বস্তি দেয়। বাড়ি সাজানোর পক্ষেও এই ফুল শুভ।

সাদা লিলিঃ সাদা লিলি গাছটি বহু বাড়ির বাগান সাজিয়ে তোলে। এই গাছও বাড়িতে রাখতে তা ইতিবাচক ফল দেয়। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাজের উদ্যম বাড়িয়ে তোলে। ঘরের মধ্যে এই গাছ রাখলে তা ঘরের বাতাসকে আরও শুদ্ধ করে তোলে। ঘরময় একটা ফ্রেশনেস থাকে।

ক্যাকটাসঃ বিশেষ কিছু ধরনের ক্যাকটাসে ফুল ধরতে দেখা যায়। অনেকেই সেই শৌখিন গাছনকে ঘরে রাখেন। কিন্তু ক্যাকটাসকে ঘরে রাখা একেবারে উচিত নয়। বাস্তুশাস্ত্র বলছে এতে ঘরের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিঘ্নিত হয়। এর কাঁটা ও রুক্ষতা আপনার জীবনকেও বিদ্ধ করতে পারে।

চম্পা-চামেলিঃ এইসব ফুলের গাছ অনেক বাড়িতেই থাকে। গাছগুলি বাড়ির বাগানে রাখুন, কোনও ভাবেই ঘরের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা করবেন না এই গাছগুলি। বিজ্ঞানসম্মত কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে এসব ফুলের গন্ধে পোকামাকড় যেমন ঘরে বেশি আসে তেমনই অ্যালার্জির সমস্যাও বাড়ে। তাই এই পরামর্শ দিচ্ছেন বাস্তুশাস্ত্রবিদরা।

চাইনিজ বটঃ ছোট বাঁশ গাছ ছোট বাঁশগাছ অনকেই বাড়িতে সাজান। তবে এই গাছ সাজানোর একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। একটি কাঁচের পাত্রে ঠিক ৩ ইঞ্চি জল নিয়ে, তাতে রঙবেরঙের পাথর সাজিয়ে রাখতে হবে। তাহলেই সেই ছোট্ট বাঁশ গাছ বাড়িতে সৌভাগ্য বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।

পোকামাকড় দূড় করার জন্য যেসব গাছ লাগাবেনঃ শীতকাল হোক কিংবা গরমকাল অথবা বর্ষাকাল, পোকামাকড়ের কারণে আমাদের সবাইকেই বেশ ভুগতে হয়। মশার কারণে জ্বর, এছাড়া বিভিন্ন পোকামাকড়ের কারণে আমাদের বিভিন্ন রোগ দেখা যায়। অনেক চেষ্টা করেও বাড়ি থেকে কিছুতেই পোকামাকড়ের উপদ্রব কমাতে পারছেন না? তাহলে জেনে নিন, বাড়িতে কোন কোন গাছ পুঁতলে পোকামাকড় আপনার ধারেকাছেও ঘেঁষবে না।

গাঁদা ফুল: শীতকাল আসলে প্রায় প্রত্যেকেই বাড়িতে গাঁদা ফুলের গাছ পুঁতে থাকি। গাঁদা ফুল দিয়ে ঘর সাজাই। পুজোর কাজেও এই ফুল ব্যবহার করি। কিন্তু আপনার যদি মনে হয় যে, গাঁদা ফুল শুধুমাত্র সৌন্দর্যের কারণেই ব্যবহার করা হয়, তাহলে ভুল ভাবছেন। গাঁদা ফুল গাছের উপকারিতা অনেক। এই গাছে এমন কিছু উপাদান থাকে, যার ফলে এই গাছের কাছে মশা এবং অন্যান্য পোকামাকড় আসতে পারে না। তাহলে বাড়ি থেকে মশা এবং অন্যান্য পোকামাকড় দূর করতে অবশ্যই গাঁদা গাছ বসান।

বেসিল পাতা: খাবারে স্বাদ বাড়াতে আমরা বেসিল পাতা ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু শুধুমাত্র খাবারের স্বাদ বাড়ানোই নয়, মশা-মাছি দূর করতেও সাহায্য করে এই গাছ।

পুদিনা পাতা: খাবারে নিশ্চয় কখনও কখনও পুদিনা পাতা ব্যবহার করে থাকেন? কিন্তু খাবারের বাইরেও এর আরও অনেক গুণাগুণ রয়েছে। পুদিনা পাতার গন্ধ মশা দূর করতে সাহায্য করে।

ল্যাভেন্ডার: ঘরের দুর্গন্ধ দূর করতে বা ঘুমোনোর আদর্শ পরিবেশ আনতে ল্যাভেন্ডার কাজ দেয়। ল্যাভেন্ডারেরও নিজস্ব একটা সুগন্ধ আছে। এই গন্ধের কারণেই অনেকে ঘরে রাখেন ল্যাভেন্ডার। মানুষের পছন্দ হলেও পোকামাকড় বা ইঁদুর এই গাছের গন্ধ পছন্দ করে না। ঘরের যে কোনও জায়গায় একগোছা ল্যাভেন্ডার রেখে দিলেই মশা-মাছি আসবে না। বাড়ির বাগানে লাগাতে পারেন এই গাছ।

লেমনগ্রাস: মশা তাড়াতে এই গাছ খুব কার্যকরী। আর বাগানে একবার লাগিয়ে দিলে খুব একটা যত্নেরও প্রয়োজন পড়ে না। রোদ পড়ে আর জল জমে না এমন জায়গায় গাছ লাগান। এর পাতার রস ঘরে ছড়িয়ে দিলে দূর হয় পোকামাকড়। তাছাড়া, রান্নাতেও ব্যবহার করা যায়।

রোজ়মেরি: বেসিল ও মিন্টের মতো রোজ়মেরিও রান্নাঘরের খুব চেনা একটি উপকরণ। এই গাছ ঘরের ভিতরে টবে বা বাইরে বাগানে লাগানো যায়। বিশেষ যত্নের দরকার হয় না। পোকামাকড় তাড়াতে রোজ়মেরির পাতা শুকিয়ে ঘরে রাখতে পারেন। এর থেকে তেলও বের করে নিতে পারেন। নাহলে, রোজ়মেরি স্প্রে বানিয়ে ছড়াতে পারেন সারা বাড়িতে। কোনও ক্ষতি ছাড়াই বাড়ি থেকে দূর হবে মাকড়সা বা ইঁদুর।

অন্যান্য: বেসিল, রোজ়মেরি বা মিন্ট ছাড়াও বিশেষ গন্ধযুক্ত কিছু গাছ আছে, যা পোকামাকড় তাড়াতে কাজ দেয়। তেজপাতা, মৌরি, পার্সলে ও ওরেগানো তারমধ্যে অন্যতম। এইসব গাছের গন্ধও পোকামাকড়রা সহ্য করতে পারে না। তাই, কোনও জায়গায় এই গাছগুলি থাকলে পোকামাকড় সেখান থেকে দূরত্ব বজায় রাখে।

বাড়ির কোথায় কী গাছ বসাবেন জেনে নিনঃ পরিশুদ্ধ বায়ু আমাদের প্রাণ৷ এই বায়ু পাওয়া যায় গাছপালা থেকে পরিবেশ দূষণের প্রকোপ থেকে জীবজগতকে রক্ষা করার জন্য ও নানাবিধ কারণে সর্বস্তরে বৃক্ষরোপণের উপযোগিতার কথা আরও ব্যাপক ভাবে প্রচার হওয়া প্রয়োজন বলে আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়৷ আবার বাস্ত‌ুশাস্ত্র অনুসারেও বসত বাড়িতে গাছ লাগানো, ফুল-ফলের বাগান করা অত্যন্ত শুভ। বস্তুত আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই গাছপালার লালন-পালন ও যত্ন নেওয়া বিশেষ জরুরী। বিশুদ্ধ বায়ু আমাদের প্রাণ, আর এই বায়ু পাওয়া যায় গাছপালা থেকে। প্রকৃতপক্ষে গাছপালা দূষণের হাত থেকে সমগ্র জীব-জগতকে রক্ষা করে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গাছপালা আমাদের জীবনের পরম সঙ্গী। তাই বসতবাড়িতে কী ভাব করবেন সৌভাগ্যের বাগান-

গৃহসীমার বাইরের যেসব গাছ আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে শুভ ফল প্রদান করে সেগুলো কোথায় এবং কোনদিক করে লাগানো উচিৎ চলুন দেখে নিই বাস্তুশাস্ত্র মত কি বলছে!

পূর্ব দিকে শুভ গাছ-বট৷
পশ্চিম দিকে শুভ গাছ-অশ্বথ৷
উত্তর দিকে শুভ গাছ পাকুড়, ক্যাথ।
দক্ষিণ দিকে শুভ গাছ- ডুমুর, গোপাল৷
দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শুভ গাছ-বেদনা, ডালিম৷
দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে শুভ গাছ-তেঁতুল৷
উত্তর-পূর্ব দিকে শুভ গাছ-আমলকী৷
উত্তর-পশ্চিম দিকে শুভ গাছ-বেল৷

গৃহের বাইরে যে সকল গাছ অশুভ ফল দেয়ঃ গাছ সবসময় শুভ ফল দেয় তা কিন্তু নয়। গাছ মাঝে মাঝে আমাদের অশুভ ফল ও দিতে পারে। চলুন দেখে নিই কোন গাছ কোথায় লাগালে তা অশুভ ফল প্রদান করে-

পূর্ব দিকে অশুভ গাছ-আম, অশ্বত্থ, জাম, কলা৷
পশ্চিম দিকে অশুভ গাছ-আম, কলা, বট৷
উত্তর দিকে অশুভ গাছ-ডুমুর, কলা৷
দক্ষিণ দিকে অশুভ গাছ-আম৷
দক্ষিণ-পূর্বদিকে অশুভ গাছ-বট, শিমূল, অশ্বত্থ, পাকুড়৷
দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে অশুভ গাছ-কদম৷
উত্তর-পূর্বদিকে অশুভ গাছ-কলা৷
উত্তর-পশ্চিমদিকে অশুভ গাছ-যে কোনও কাঁটাযুক্ত গাছ৷

বসত ভিটেতে সব বড় বড় গাছ মঙ্গলজনক নাও হতে পারে৷ এই সম্পর্কে বাস্ত‌ুশাস্ত্রে কিছু বিধি নিষেধও পাওয়া যায়৷

• বসতভিটের ভেতরে বা বাগানে শ্রীবৃদ্ধিকারক গাছগুলি হল-বেল, সুপারি, নারকেল, জাম, কাঁঠাল, আম, ডালিম, কমলালেবু, লেবু, আমলকী, দেবদারু, বকুল, চাঁপা সজনে ইত্যাদি৷
• আবার যে বাড়িতে আম, জাম, সুপারি, কাঁঠাল, টগর, দারুচিনি, মল্লিকা, নারিকেল, পদ্ম ইত্যাদি গাছ থাকে, সে বাড়িতে লক্ষ্মীর শুভাগমন ঘটে৷
• অপর দিকে গৃহের পক্ষে অকল্যাণকর গাছগুলি হল- তেঁতুল, বহেরা, ধুতুরা, পলাশ ইত্যাদি৷

কোনদিকে কোন বাগান করবেন তা দেখে নেওয়া যাক-

• বাস্ত‌ু মতে বাসস্থানের সংলগ্ন জমির উত্তর-পশ্চিম দিকে বাগান করা উচিত৷
• বাগানের উত্তর-পূর্বদিকে বনৌষধি গাছ-গাছড়া লাগানো শুভকর৷
দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বড়-বড় পাতা যুক্ত গাছপালা লাগানো প্রয়োজন৷
ঘরের সীমার মধ্যে ফল ও ফুলের গাছ লাগালে তা বাড়ির সকলের পক্ষে কল্যাণকর হয়৷

শুধু বাস্ত‌ুশাস্ত্র-ই নয়, ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রেও বসত ভিটের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন বৃক্ষের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে৷ গ্রহদোষ বা বিশেষ গ্রহের অশুভ প্রভাব দূর করার জন্য প্রাচীন শাস্ত্রকারগণ বিশেষ বিশেষ গাছের পুজো করারও উপদেশ দিয়েছেন৷

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.