যুধিষ্ঠির বললেন- হে বিষ্ণো! আপনাকে আমি বন্দনা করি। আপনি ত্রিলোকের সুখদায়ক, বিশ্বেশ্বর, বিশ্বপালক ও পুরুষোত্তম। আমার একটি সংশয় আছে। অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের যে একাদশী তার নাম কি, বিধিই বা কি ও কোন দেবতা এই একাদশীতে পূজিত হন, তা আমায় বলুন।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন – হে মহারাজ! আপনি উত্তম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন, যার মাধ্যমে আপনার যশ চতুর্দিকে বিস্তৃত হবে। এখন এই একাদশীর কথা আমি বর্ণনা করছি যা শোনা মাত্রই বাজপেয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়। অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের এই একাদশী ‘মোক্ষদা’ নামে পরিচিত। সর্বপাপনাশিনী ও ব্রত সর্বশ্রেষ্ঠা এই একাদশীর দেবতা শ্রীদামোদর।
তুলসী, তুলসী মঞ্জরী, ধূপ, দীপ, ইত্যাদি উপচারে শাস্ত্রবিধি অনুসারে শ্রীদামোদরের পূজা করতে হবে। পূর্ববর্ণিত বিধি অনুসারে দশমী ও একাদশী পালন করতে হবে। এই উপবাস দিনে স্তবস্তুতি, নৃত্য-গীত আদি সহ রাত্রিজাগরণ করা কর্তব্য।
হে মহারাজ! প্রসঙ্গক্রমে একটি অলৌকিক কাহিনী আমি বলছি। মনোযোগ দিয়ে এই ইতিহাস শ্রবণ মাত্রই সর্বপাপ ক্ষয় হয়। যে পিতৃপুরুষেরা নিজ নিজ পাপে অধ:যোনি প্রাপ্ত হয়েছে, এই ব্রত পালনের পুণ্যফল বিন্দু মাত্র তাদেরকে দান করলে তারাও মুক্তিলাভের যোগ্য হন।
কোন এক সময় মনোরম চম্পক নগরে বৈখানস নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন সমস্ত বৈষ্ণব সদ্গুণে বিভূষিত। প্রজাদের তিনি পুত্রের মতো পালন করতেন। তাঁর রাজ্যে বহু বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বাস করতেন। রাজ্যের সকলেই ছিল বেশ সমৃদ্ধশালী।
একবার রাজা স্বপ্নে দেখলেন যে তার পিতা নরকে পতিত হয়েছেন। তা দেখে তিনি অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। পরদিন ব্রাহ্মণদের ডেকে বলতে লাগলেন- হে ব্রাহ্মণগণ। গতরাত্রিতে স্বপ্নে নরকযাতনায় পিতাকে কষ্ট পেতে দেখে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে।
তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন- ‘হে পুত্র, তুমি আমাকে নরকসমুদ্র থেকে উদ্ধার কর।’ তাঁর সেই অবস্থা দেখে আমার অন্তরে সুখ নেই। আমার এই বিশাল রাজ্য, স্ত্রী-পুত্র, কিছুতেই আমি শান্তি পাচ্ছি না। কি করি, কোথায় যাই কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আমার পূর্বপুরুষেরা মুক্তিলাভ করতে পারেন এমন কোন পুণ্যব্রত, তপস্যা ও যোগের কথা আমাকে উপদেশ করুন। আমি তা অনুষ্ঠান করব। আমার মতো পুত্র বর্তমান থাকা সত্ত্বেও যদি পিতামাতা পূর্বপরুষেরা যদি নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে থাকেন, তবে সে পুত্রের কি প্রয়োজন?
ব্রাহ্মণগণ বললেন- হে মহারাজ! আপনার রাজ্যের কাছেই মহর্ষি পর্বত মুনির আশ্রম রয়েছে। তিনি ত্রিকালজ্ঞ। তাঁর কাছে আপনার মুক্তির উপায় জানতে পারবেন। ব্রাহ্মণদের উপদেশ শ্রবণ করে মহাত্মা বৈখানস তাঁদের সঙ্গে নিয়ে সেই পর্বত মুনির আশ্রমে গমন করলেন। তাঁরা দুর থেকে ঋষিবরকে সষ্টাঙ্গ প্রণাম করে তার কাছে গেলেন। মুনিবর রাজার কুশলবার্তা জিজ্ঞাসা করলেন।
রাজা বললেন- হে প্রভু! আপনার কৃপায় আমার সবই কুশল। তবে আমি একদিন স্বপ্নযোগে পিতার নরকযন্ত্রণা ও কাতর আর্তনাদ্ শুনে অত্যন্ত দু:খিত ও চিন্তাগ্রস্থ হয়েছি। হে ঋষিবর। কোন পুণ্যের ফলে তিনি সেই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবেন, তার উপায় জানতেই আপনার শরণাগত হয়েছি।
রাজার কথা শুনে পর্বত মুনি কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হয়ে বললেন- হে মহারাজ! পূর্বজন্মে তোমার পিতা অত্যন্ত কামাচারী হওয়ায় তার এরকম অধোগতি লাভ হয়েছে। এখন এই পাপ থেকে মুক্তির উপায় বর্ণনা করছি। অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের মোক্ষদা একাদশী পালন করে সেই পুণ্যফল পিতাকে প্রদান কর। সেই পুণ্য প্রভাবে তোমার পিতার মুক্তি লাভ হবে।
মুনির কথা শোনার পর রাজা নিজগৃহে ফিরে এলেন। সেই পবিত্র তিথির আবির্ভাবে তিনি স্ত্রী-পুত্রাদিসহ যথাবিধি মোক্ষদা একাদশী ব্রত পালন করলেন। ব্রতের পুণ্যফল পিতার উদ্দেশ্যে প্রদাণ করলেন। ঐ পুণ্যফল দানের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল। ‘হে পুত্র তোমার মঙ্গল হোক।’ এই বলতে বলতে বৈখানস রাজার পিতা নরক থেকে মুক্ত হয়ে স্বর্গে গমন করলেন।
হে মহারাজ যুধিষ্ঠির! যে ব্যাক্তি এই মঙ্গলদায়িনী মোক্ষদা একাদশী ব্রত পালন করে, তার সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয় এবং মৃত্যুর পর মুক্তি লাভ করে। এই ব্রতের পুণ্যসংখ্যা আমিও জানি না। চিন্তমণির মতো এই ব্রতটি আমার অত্যন্ত প্রিয়। এই ব্রত কথা যিনি পাঠ করেন এবং যিনি শ্রবণ করেন, উভয়েই বাজপেয় যজ্ঞের ফল প্রাপ্ত হন।