শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পিতাকে জিজ্ঞসা করেন, “হে পিতঃ, এটা কোন্ যজ্ঞের আয়োজন করা হচ্ছে? এই যজ্ঞের ফলে কি হয় এবং কার উদ্দেশ্যে এই যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে ? কিভাবে এই যজ্ঞ করা হবে ? আপনি কি দয়া করে তা আমাকে বলবেন ?
তা জানতে আমি অত্যন্ত উৎসুক, তাই দয়া করে এই যজ্ঞের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমাকে বলুন।” কৃষ্ণ তাঁকে এইভাবে জিজ্ঞাসা করলে তাঁর পিতা নন্দ মহারাজ চুপ করে রইলেন, কেননা তিনি মনে করলেন যে, তাঁর শিশুপুত্রটি এই যজ্ঞ অনুষ্ঠানের জটিলতা বুঝতে পারেব না।
কৃষ্ণ তখন নাছোড়বান্দার মতো তাঁকে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, “হে পিতঃ, যাঁরা উদারচেতা এবং সৎ প্রকৃতির মানুষ, তাঁরা কোন কিছুই গোপন করেন না। তাঁরা সকলের প্রতিই উদারভাবাপন্ন।
আর যাঁরা ততটা উদার নন, তাঁরা ও আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবের কাছে কোন কিছু গোপন করেন না, যদিও শত্রুভাবাপন্ন মানুষদের কাছে তাঁরা কোন কিছু গোপন রাখতে পারেন। তাই আমার কাছে কিছু গোপন করা আপনার উচিত নয়।
সমস্ত মানুষই তাদের কর্ম অনুসারে ফল ভোগ করছে। তাদের কেউ তাদের কৃতকর্ম এবং তার ফল সম্বন্ধে অবগত, আর কেউ তাদের কর্মের উদ্দেশ্য অথবা ফল সম্বন্ধে কিছু না জেনেই কর্ম করে যাচ্ছে।
যে মানুষ পূর্ন জ্ঞান সহকারে কর্ম করেন, তিনি পূর্ণ ফল প্রাপ্ত হন; কিন্তু যাঁরা না জেনে কর্ম করছেন, তাঁরা পূর্ণ ফল ভোগ করতে পারেন না। তাই দয়া করে আমাকে বলুন আপনারা যে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে চলেছেন তার উদ্দেশ্য কি ?
তা কি বৈদিক নির্দেশ অনুসারে সম্পদিত হচ্ছে। না কি, এটা কেবল একটা জনপ্রিয় উৎসব ? দয়া করে আমাকে সবিস্তারে এই যজ্ঞ সম্বন্ধে বলুন” কৃষ্ণ এইভাবে প্রশ্ন করতে থাকলে নন্দ মহারাজ উত্তর দিলেন, “কৃষ্ণ , এই যে অনুষ্ঠান করা হচ্ছে , তা একটা প্রচলিত প্রথা। যেহেতু মেঘেরা হচ্ছে ইন্দ্রের প্রতিনিধি, তাই ইন্দ্রের কৃপার ফলেই বৃষ্টি হয় আর আমাদের জীবন ধারণের জন্য জল এত প্রয়োজনীয় যে বৃষ্টির নিয়ন্তা ইন্দ্রের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা কর্তব্য।
তাই আমরা দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য এই যজ্ঞের আয়োজন করেছি, কেননা তিনি কৃপা করে আমাদের যথেষ্ট বৃষ্টিদান করেন, যার ফলে আমরা ফসল উৎপাদান করতে সক্ষম হই।
আমাদের জীবনে জল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়; জল ছাড়া আমরা কৃষিকার্য করতে পারি না অথবা শস্য উৎপাদন করতে পারি না। যদি বৃষ্টি না হয় তা হলে আমরা জীবনধারণ করতে পারি না তাই যথাযথভাবে ধর্ম-অনুষ্ঠান করা জন্য, অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করার জন্য এবং অবশেষে মোক্ষলাভের জন্য জল অপরিহার্য।
তাই চিরাচরিত প্রথায় এই যে অনুষ্ঠান চলে আসেছে তা বন্ধ করা উচিত নয়; আমরা যদি কাম, লোভ বা ভয়ের বশবর্তী হয়ে তা বন্ধ করে দিই, তা হলে তা ভাল দেখাবে না।”
সেই কথা শুনে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পিতা এবং বৃন্দাবনের সমস্ত গোপদের এমন কতকগুলো কথা বললেন, যাতে দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি বললেন, এই যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার কোনো প্রয়োজন নেই।
ইন্দ্রের প্রীতি সাধনের জন্য এই যজ্ঞ না করার তিনি দুটি কারণ দেখালেন। প্রথম কারণ, যা ভগবদ্গীতাতেও বলা হয়েছে, পার্থিব উন্নতি সাধনের জন্য কোন দেব-দেবীর পূজা করার প্রয়োজন নেই, দেব-দেবীদের পূজা করে যে ফল হয়, তা ক্ষণস্থায়ী, এবং অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল এই ধরনের ক্ষণস্থায়ী ফল লাভে উৎসাহী দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত অনিত্য ফল এই সমস্ত দেব-দেবীদের পূজা করে লাভ হয়, তা পরমেশ্বর ভগবানের আদেশ অনুসারেই তারা মঞ্জুর করে থাকেন।
ভগবদগীতায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “ময়ৈব বিহিতান্ হি তান্“- দেবতাদের কাছ থেকে যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা লাভ হয়ে থাকে, তা প্রকৃতপক্ষে পরমেশ্বর ভগবানই প্রদান করেন। পরমেশ্বর ভগবানের আদেশ ছাড়া কেউই কোন কিছু দিতে পারেন না।
কিন্তু মাঝে মাঝে জড়া প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেবতারা নিজেদের সর্বেসর্বা বলে মনে করে গর্বান্বিত হয়ে পড়েন এবং পরমেশ্বর ভগবানের পরম ঈশ্বরত্বের কথা ভুলে যান। শ্রীমদ্ভাগবতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এখনে শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছা করে ইন্দ্রের ক্রোধ উৎপাদন করেতে চেয়েছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ এই জগতে অবতরণ করেন অসুরের বিনাশ করবার জন্য এবং ভক্তদের পরিত্রাণ করবার জন্য। দেবরাজ ইন্দ্র অবশ্যই অসুর ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভক্ত, কিন্তু তিনি গর্বান্বিত হয়ে পড়েছিলেন বলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে একটু শিক্ষা দেওয়ার আয়োজন করেছিলেন। তিনি প্রথমে বৃন্দাবনের গোপেদের আয়োজিত ইন্দ্রপূজা বন্ধ করে তাঁকে খুব রাগিয়ে দিয়েছিলেন।
সোর্সঃ ইন্টারনেট এর বিভিন্ন মাধ্যম