কৃষ্ণ তাঁর পিতাকে আরো বোঝালেন, “এইজড় জগৎ সত্ত্ব, রজ এবং তম, প্রকৃতির এই তিনটি গুণের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই তিনটি গুণ হচ্ছে সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের কারন। রজোগুণের প্রভাবে মেঘ উৎপন্ন হয় ; তাই বৃষ্টির কারণ হচ্ছে রজোগুণ।
এই বৃষ্টি হওয়ার ফলে মানুষ তার কৃষিকার্যে সাফল্য লাভ করে। সমুদ্রের মাঝেও বৃষ্টি হয়। সেখানে কেউ ইন্দ্র পূজা করেন না। তা হলে এই ব্যাপারে ইন্দ্রের কি করণীয় আছে ? আপনি যদি ইন্দ্রের সন্তুষ্টি বিধান নাও করেন, তা হলে তিনি কি করতে পারেন ?
আমরা ইন্দ্রের কাছ থেকে বিশেষ ফল পাচ্ছি না। তিনি যদি বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করতেন, তা হলে সমুদ্রের বুকে কেন বৃষ্টি হয় যেখানে জলের কোন প্রয়োজন নেই । সমুদ্রে এবং জমিতে সব জায়গাতেই বৃষ্টি হচ্ছে; তা ইন্দ্রকে পূজা করার উপর নির্ভর করে না।
আমাদের অন্য কোন শহর বা গ্রামে বা বিদেশে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। শহরে অনেক রাজকীয় প্রাসাদ আছে, কিন্তু আমরা এই বৃন্দাবনের বনে বাস করেই সুখী। গোবর্ধন পর্বত এবং বৃন্দাবনের বনের সংগে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।
আমাদের জীবিকা যে গো-পালন, গাভী বর্ধনের জন্য আমরা গোবর্ধনের কাছে ঋণী। ইন্দ্রের কাছে নয়। চলো আমরা গোবর্ধনের পূজা করি। তাই আমি আপনাদের অনুরোধ করব, আপনারা এমন এক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করুন যাতে স্থানীয় ব্রাহ্মণেরা এবং গোবর্ধন পর্বত সন্তুষ্ট হন। ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে করণীয় আর আমাদের কিছুই নেই।
শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে নন্দ মহারাজ বললেন, “কৃষ্ণ, তুমি যখন বলছ তখন আমি নিশ্চয়ই স্থানীয় ব্রাহ্মণ এবং গোবর্ধন পর্বতের উদ্দেশ্য আলাদা একটা যজ্ঞের আয়োজন করব। কিন্তু এখন আমরা ইন্দ্রযজ্ঞ সম্পাদন করি”
কৃষ্ণ বললেন, “হে পিতঃ, দেরি করার আর প্রয়োজন নেই। গোবর্ধন পর্বত এবং স্থানীয় ব্রাহ্মনদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে অনেক সময় লাগবে। তাই ইন্দ্রযজ্ঞের জন্য যে আয়োজন করা হয়েছে তা দিয়ে এখনই গোবর্ধন পর্বত এবং স্থানীয় ব্রাহ্মনদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যজ্ঞ করলে ভাল হবে।
মহারাজ নন্দ অবশেষে রাজী হলেন। গোপেরা তখন কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন কিভাবে তিনি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে চান, এবং কৃষ্ণ তাঁদের বললেন, “যজ্ঞের জন্য সংগৃহীত সমস্ত শস্য এবং ঘি দিয়ে খুব ভাল ভাল নানা রকমের খাবার তৈরি করা হোক।
পুষ্পান্ন, ডাল, হালুয়া, পকোরা, পুরী, মিষ্টান্ন, রসগোল্লা, সন্দেশ, লাড্ডু, ইত্যাদি তৈরি করা হোক, এবং সমস্ত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করা হোক্ । যাঁরা বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে এবং অগ্নিতে আহুতি প্রদানে সুদক্ষ। সেই সমস্ত ব্রাহ্মণদের নানা করম শস্য দান করা হোক।
গাভীদের খুব সুন্দর সজ্জায় ভূষিত করা হোক। এবং তাদের খুব ভাল করে খাওয়ানো হোক। তার পর ব্রাহ্মণদের অর্থদান করা হোক্। সমাজের নিম্মস্তরের চন্ডাল আদি মানুষদের , যাদের সাধারণ লোক অস্পৃশ্য বলে মনে করে, তাদের ও প্রচুর পরিমাণে প্রসাদ দেওয়া হোক্। গাভীদের তৃণ প্রদান করে গোবর্ধন পর্বতের পূজা উপহার প্রদান করা হোক্। এই পূজা হলে আমি অত্যন্ত তৃপ্ত হব।
এখানে শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত বৈশ্য সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ভিত্তি বর্ণনা করেছেন। মাবন-সমাজের প্রতিটি সম্প্রদায়ে এবং গাভী, কুকুর, ছাগল ইত্যাদি পশু সম্প্রদায়ে ও সকলেরই একটা বিশেষ স্থান রয়েছে। সকলেরই কতর্ব্য হচ্ছে যৌথ ভাবে সমস্ত সমাজের মঙ্গলসাধনের জন্য কাজ করা।
এই কথা কেবল সচেতন প্রাণীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়; বন পর্বত আদি অচেতন পদার্থকেও বিবেচনা করে। ফসল উৎপাদন করে গো-পালন করে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করে, বাণিজ্য করে, এবং ঋণদান করে সমাজের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করার দায়িত্বভার বিশেষ করে বৈশ্য সম্প্রদায়ের উপর অর্পিত হয়েছে।
এর থেকে আমরা এটাও বুঝতে পারি যে, কুকুর, বেড়াল ইত্যাদি পশুদের যদিও খুব একটা প্রয়োজনীয়তা নেই, তবুও তাদের অবহেলা করা উচিত নয়। তাদের রক্ষা করাও মানুষের কতর্ব্য। তবে অবশ্য কুকুর, বেড়াল রক্ষা করার থেকে গাভীদের রক্ষা করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ; এবং এখানে আমরা আরেকটা ইঙ্গিত দেখতে পাই যে, চন্ডাল বা সমাজের যারা অস্পৃশ্য, তাদের ও অবহেলা করা উচিত নয়।
সকলেরই যথাযথ প্রয়োজনীয়তা আছে, তবে কেউ সরাসরিভাবে মানব-সমাজের উন্নতিসাধনের জন্য যুক্ত, আর কেউ পরোক্ষভাবে যুক্ত। কিন্তু সমাজ যখন কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ওঠে ,তখন সকলেই সুখ-স্বচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বসবাস করতে পারে।
সোর্সঃ ইন্টারনেট এর বিভিন্ন মাধ্যম