দোল বা হোলি ধর্মীয় অনুষঙ্গের আড়ালে থাকা এমন এক সামাজিক অনুষ্ঠান, যার সর্বজনীন আবেদন আছে৷ দশেরা এবং দেওয়ালির মতো, অঞ্চল বৈভিন্নে দোলেরও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা৷ উত্তর ভারতে যা ‘হোলি’ নামে পরিচিত, দক্ষিণে সেটাই আবার ‘মদনদাহন’ বা ‘কামায়ন’ উৎসব৷ মধ্য ভারতে এই উৎসবকে বলে ‘হোরি’৷ আবার গোয়া-কঙ্কন অঞ্চলে একই ধরণের অনুষ্ঠান ‘শিমাগা’ নামে পরিচিত৷ ওডিশায় যাকে ‘দোলোৎসব’ বলে, বাংলায় সেটাই ‘দোলযাত্রা’৷
নামে যাই হোক না কেন, এই প্রতিটি উৎসবের চরিত্র প্রায় এক রকম৷ প্রথমে আগুন দিয়ে কোনও কুশ বা ওই রকমই কোনও দাহ্য পদার্থ নির্মিত পুতুল পোড়ানো৷ তার পর রং-আবির মেখে উচ্ছ্বাস বা উদ্দামতার প্রকাশ এবং এর মধ্যে অল্প বা পরিমিত নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠতা৷ বস্তুত, দোল বা হোলির উৎসব যতখানি না ধর্মীয় তার থেকে অনেক অনেক বেশি সামাজিক৷ নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠতা এখানে সমাজ-স্বীকৃত এবং তা খানিকটা শাস্ত্রসম্মত পথেই৷ আমাদের বঙ্গদেশে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারের ফলে রাধাকৃষ্ণের প্রেম, বসন্তের রাসলীলা ও হোলি সমার্থক হয়ে গিয়েছে৷
হোলি শব্দটা এসেছে হিন্দি ‘হোলিকা-দহন’ থেকে। এই হোলিকা ছিলেন, দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বোন। বিষ্ণুপুরাণের বর্ণনায় বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার হিসেবে পাওয়া যায় নৃসিংহ বা নরসিংহ অবতারের নাম। ব্রহ্মার কাছ থেকে বকলমে অমরত্ব লাভের পর হিরণ্যকশিপু নিজেকে একচ্ছত্র সম্রাট বলে ভাবতে শুরু করেন এবং ক্রমেই অনমনীয় হয়ে উঠতে থাকেন। এ দিকে নারদের প্রশ্রয়ে থেকে হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ বিষ্ণুভক্ত হয়ে ওঠেন। হিরণ্যকশিপুর কানে এই খবর যাওয়া মাত্র ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি এবং নিজের পুত্রকেই হত্যা করতে উদ্যোগী হন। অথচ কী আশ্চর্য, বিভিন্ন চেষ্টার পরেও অক্ষত থেকে যান প্রহ্লাদ!
অবশেষে ডাক পড়ে হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকার, আগুন যাকে স্পর্শ করতে পারে না৷ নির্ধারিত দিনে প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে লেলিহান আগুনে প্রবেশ করে হোলিকা৷ বিষ্ণুর আশীর্বাদে আগুন থেকে অক্ষত বেরিয়ে আসে প্রহ্লাদ, আর জীবন্ত দগ্ধ হয়ে যায় হোলিকা৷ পর দিন ফাল্গুন পূর্ণিমা৷ হোলিকার মৃত্যুতে খুশি মানুষের মধ্যে শুরু হয় রঙিন খুশির উৎসব ‘হোলি’৷ আগুনের গ্রাসে হোলিকার মৃত্যুর ঘটনাটিই ‘হোলিকা দহন’।
বাংলাতে উৎসবের এই অনুষঙ্গটিই হয়েছে ‘নেড়াপোড়া’ বা বুড়ির ঘর পোড়ানো| হোলিকা-বুড়ির ঘর তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় সমস্ত জঞ্জাল৷ কাগজের একটি ঘরে রূপকল্প, তার সঙ্গে যুক্ত হয় দরমা, খড়, খেজুরপাতা, কাঠকুটো বা শুকনো পাতা৷ আগুন হু হু করে জ্বলে উঠলে সকলে সমস্বরে বলে ওঠে ‘আজ আমাদের নেড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল’৷ নেড়াপোড়ার প্রসাদটিও কিন্তু অভিনব৷
রাঙা আলু বা আলু ছুড়ে ফেলা হয় আগুনে, পরে সেগুলি সংগ্রহ করে তেল-নুন দিয়ে মেখে ভাগ করে খাওয়া৷ ভারতের কিছু অংশে হোলিকা দহন উৎসবকে ‘ছোটি হোলি’ বলা হয়৷ শীতকে বিদায় জানিয়ে রঙিন বসন্তকে আবাহন করার উৎসব এটি৷ সমাজতাত্ত্বিক গবেষকদের অনেকে বলেন নেড়াপোড়ার অন্য তাৎপর্যের কথা৷ শীতের পরে গ্রামেগঞ্জে মশার উপদ্রব বাড়ত, সে জন্যই বুড়ির ঘরের সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলা হত সমস্ত আবর্জনা৷
ভারতের অনেক জায়গায়, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে হোলিকা দহন’কে ‘কাম দহন’-ও বলা হয়৷ কিন্তু হোলির সঙ্গে কাম কেন? সে আর এক কাহিনি৷ শুনলেই বোঝা যাবে এই যৌবনের ফাগুয়াতে শুধু মনই নয়, কোথাও যেন সূক্ষ্ম ভাবে মিশে রয়েছে শরীর| রঙ মাখানোর অছিলাতে নারী-পুরুষের পরস্পরকে স্পর্শ করে খানিক যৌনতার আস্বাদ নেওয়া!
কালিদাসের কুমারসম্ভব কাব্যে আছে, তারকাসুরকে বধ করার জন্য একজন মহাপরাক্রমশালী যোদ্ধার প্রয়োজন। দেবতারা স্থির করেন, দেবাদিদেব মহাদেব এবং উমার মিলনে যে সন্তান জন্ম নেবেন, তিনিই হবেন দেবসেনাপতি। কিন্তু সমস্যা হল মহাদেবকে নিয়ে। তিনি তখন বসেছেন গভীর তপস্যায়৷ উমা এলেন তাঁর কাছে কিন্তু ধ্যানমগ্ন ধূর্জটির সে দিকে কোনও হুঁশই নেই। উমা তখন শরণ নিলেন কামদেবের। আড়াল থেকে তিনি কামের তির ছুড়লেন মহাদেবের দিকে, ধ্যানভঙ্গ হল তাঁর। অকালে ধ্যানভঙ্গ হওয়ায় ক্রোধে ফেটে পড়লেন মহাদেব। চোখ খুলে সামনে মদনদেবকে দেখতে পেয়ে তাঁর তৃতীয় নয়নের আগুনে ভস্ম করে দিলেন কামদেব মদনকে। ওই ঘটনাকে স্মরণ করেই কোথাও কোথাও দোল বা হোলির আগের দিন ‘কাম-দহন’ উৎসব হয়।
সূত্রঃ eisamay.indiatimes
ছবিঃ ইন্টারনেট হতে সংগৃহিত