অম্বুবাচী একটি ধর্মীয় আচার হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের আমাদের প্রাচীন কৃষি পদ্ধতিও। আষাঢ় মাসের শুরুতে পৃথিবী যখন বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে ওঠে তখন তাকে ঋতুমতী বলে মনে করা হয়। আমরা জানি, মেয়েরা রজঃস্বলা হলেই সন্তান ধারণ করতে পারেন। বসুমতীকেও সেই রূপেই কল্পনা করা হয়। এই সময়ে তাঁকে তিন দিন বিশ্রাম দেওয়া হয়।
চাষিরা ওই তিন দিন কোনও কৃষিকাজ করেন না। অম্বুবাচীর তিন দিন ধরিত্রীর ঋতুকাল ধরে নিয়ে চাষে বিরত থাকেন। তাঁরা মনে করেন, এই তিন দিন বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে ধরিত্রী চাষের উপযোগী হয়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে উর্বরতাকেন্দ্রিক ভাবনায় নারী এবং ধরিত্রী যেন সমার্থক হয়ে ওঠে। অম্বুবাচীর আগের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী প্রবৃত্তি’। তিন দিনের পরের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী নিবৃত্তি’। এর পরেই চাষিরা আবার চাষাবাদ শুরু করতে পারেন।
অম্বুবাচীর সময় হিন্দু ধর্মীয় লোকেরা শক্তি পূজার স্থানগুলোতে আয়োজন করা উৎসবকে অম্বুবাচী মেলা বলা হয়। ভারতের অসম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের কামাখ্যা দেবীর মন্দিরে প্রতি বৎসর অম্বুবাচী মেলার আয়োজন করা হয়। আম্বুবাচী আরম্ভের প্রথম দিন থেকে কামাখ্যা দেবীর দ্বার বন্ধ রাখা হয় ফলে আম্বুবাচীর সময় দেবী দর্শন নিষিদ্ধ থাকে।
অসমের নীলাচল পর্বতে অবস্থিত একান্ন সতীপীঠের অন্যতম মহাশক্তিপীঠ কামাখ্যাধাম এই অম্বুবাচীর সময়ে এক চিত্তাকর্ষক রূপ ধারণ করে। দূরদূরান্ত হতে অসংখ্য তন্ত্রসাধক, অঘোরী, কাপালিক, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যোগী ও সাধকেরা এইস্থানে এসে ভিড় করেন। সতীর মহামুদ্রা বা যোনীমুদ্রার স্পর্শে এই স্থল ধন্য।
মন্দির অভ্যন্তরে রয়েছে শিলাময়ী মাতৃযোনী, একটি ক্ষীণ জলধারা প্রবাহিত হয়ে সর্বক্ষণ শিলাবিগ্রহটিকে সিক্ত করে চলেছে। তাই অম্বুবাচীর আরম্ভলগ্নে শ্রীমন্দিরের দ্বার তিনদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। অম্বুবাচীর অন্তে পুনরায় দ্বার উন্মুক্ত হলে ভক্তেরা দেবীদর্শনে সমর্থ হন।
অম্বুবাচীর সময় অসমের কামাক্ষ্যা মন্দিরে বিশেষ উৎসব পালন করা হয়। সতীপিঠের অন্যতম কামাক্ষ্যা মায়ের মন্দির তন্ত্র সাধনার অন্যতম পীঠ। এই স্থানে দেবী সতীর গর্ভ এবং যোনি পড়েছিল। অম্বুবাচীর এই তিন দিন এই মন্দিরে বিশেষ উৎসব পালন করা হয়। আষাঢ় মাসে আদ্যা নক্ষত্রের প্রথম পাদে এ অম্বুবাচী শেষ হয়। তাই চতুর্থ দিনে দেবীর মন্দির সর্বসাধারণের দর্শনের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
চতুর্থ দিন দেবীর স্নান ও পূজা সম্পূর্ণ হওয়ার পর কামাখ্যা মাতার দর্শন করার অনুমতি দেওয়া হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের থেকে আসা লক্ষ লক্ষ ভক্তেরা (বর্তমান দিনে বিদেশ থেকে আসে) কামাখ্যা মন্দিরের চতুর্দিকে বসে কীর্ত্তন করেন। মন্দিরের বাহিরে প্রদীপ ও ধূপকাঠী জ্বালিয়ে দেবীকে প্রনাম করেন। অম্বুবাচী নিবৃত্তির দিন পান্ডারা ভক্তদের রক্তবস্ত্র উপহার দেন।
দেবী পীঠের এই রক্তবস্ত্র ধারণ করিলে মনোকামনা পূর্ণ হয় বলে ভক্তেরা বিশ্বাস করেন। এই রক্তবস্ত্র পুরুষেরা ডানহাত বা গলায় ও মহিলারা এই বস্ত্র বাওহাত বা গলায় পরিধান করেন। রক্তবস্ত্র পরিধান করে শ্মশান বা মৃতের ঘরে যাওয়া নিষিদ্ধ। কামাখ্যা ধামের অম্বুবাচী মেলা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সম্প্রীতি রক্ষার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
মহাভারত , ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ , নীল তন্ত্র, রুদ্রযামল , শিবচরিত, শাক্তানন্দ-তরঙ্গিণী এবং মহাপীঠ নিরূপণ ও মঙ্গলকাব্যের সূত্র ধরে বলা যায় , সতীর ৫১ খন্ডের একটি খণ্ড এই কামাক্ষা ধামে পতিত হয়েছিল সেটি হলো সতীর অঙ্গের “যোনি” খণ্ড , তাই এই পীঠস্থান কে শ্রেষ্ঠ পীঠ বলা হয়ে থাকে এবং এর জন্যে কামেশ্বরীও বলা হয়ে থাকে।
তাই অম্বুবাচীতে কামাক্ষা ধামে যোনী শিলা হতে এখনো পর্যন্ত অদ্ভুত ধরনের লাল জলের ধারা বইতে দেখা যায় এবং ওই জল ব্রহ্মপুত্র নদে বয়ে যেতে দেখা যায় । ফলে তখন ব্রহ্মপুত্রের জলও লাল হয়ে যায়। তাই এই সময় পৃথিবীর সমস্ত জলরাশি অপবিত্র থাকে। আর এই অম্বুবাচী তিথি পর্যন্ত সর্বত্রই ঝিরিঝিরি বা কখনও মুষলধারে বৃষ্টি হয়। ঠিক যেমনটা হয় রজস্রাবের সময়ে।
ষোড়শ শতাব্দীতে কুখ্যাত কালাপাহাড় এই মন্দির ধ্বংস করলে সপ্তম শতাব্দীতে কোচরাজবংশের দু’ভাই নরনারায়ণ ও শিলারায় (চিলা রায়) মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মহামায়া কামাখ্যা কুপিত হলে দেবীর অভিশাপে তারা মন্দির ও নীলপর্বত থেকে বিতাড়িত হন। এই রোমহর্ষকর ঘটনাটি অসমবাসী মাত্রেরই জানা।
তন্ত্রের জন্মভূমি অসমদেশের প্রধান সম্পদ এই শক্তিতীর্থ কামাখ্যাপীঠ প্রাচীনকাল থেকেই নানা অলৌকিক কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। পূর্বে অম্বুবাচীর প্রবৃত্তিকালে মন্দিরের দরজা যে নিজে থেকে বিকট শব্দ করে বন্ধ হয়ে যেত এবং অম্বুবাচী ছাড়ার পর আবার স্বয়ংই খুলে যেত।