বিয়ে মানে দুটো মনের মিলন, দুটো পরিবারের মিলন। বাঙালি হিন্দু বিবাহের লৌকিক আচার বহুবিধ। এই প্রথাগুলি বর্ণ, শাখা, উপশাখা এবং অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়। এগুলির সঙ্গে বৈদিক প্রথাগুলির কোনও যোগ নেই।
উচ্চবর্ণীয় হিন্দু সমাজের বিবাহে প্রধানত দুইটি আচারগত বিভাগ লক্ষিত হয়। যথা, বৈদিক ও লৌকিক। লৌকিক আচারগুলি “স্ত্রী আচার” নামে পরিচিত। বৈদিক আচারগুলির মধ্যে অবশ্য পালনীয় প্রথাগুলি হল কুশণ্ডিকা, লাজহোম, সপ্তপদী গমন, পাণিগ্রহণ, ধৃতিহোম ও চতুর্থী হোম।
বৈদিক আচারগুলির সঙ্গে লৌকিক আচারগুলির কোনও সম্পর্ক নেই। লৌকিক আচারগুলি অঞ্চল, বর্ণ বা উপবর্ণভেদে এক এক প্রকার হয়। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে লৌকিক আচার তো বটেই বিবাহের মৌলিক আচারগুলির ক্ষেত্রেও সম্প্রদায়ভেদে পার্থক্য লক্ষিত হয়।
বিয়ে মানেই এক জন অপর জনকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সেই প্রতিশ্রুতিগুলিকে সারা জীবন প্রেম, নিষ্ঠা ও যত্ন সহকারে পালন করা। বিয়ে মানেই যে কেবল মাত্র দু’টি মনের মিলন তা নয়, একটি পরিবারের সঙ্গে অন্য একটি পরিবারের মিলন। বিয়েতে অনেক নিয়ম কানুন মানা হয়।
এক এক ধর্মের এক এক নিয়ম। ঠিক তেমনই হিন্দু ধর্মের বিয়েতেও নানা রকম নিয়ম রয়েছে। যেমন গায়ে হলুদ, শুভ দৃষ্টি, সিঁদুর দান, খই পোড়ানো, প্রভৃতি। বিয়ের সময় এই সব নিয়ম যেমন করতেই হবে, ঠিক সে রকম সাত পাক ঘোরাও অনিবার্য। তবে এই সমস্ত রীতি কিন্তু শুধুই ধর্মীয় কারণে নয়। এর পিছনে আরও অনেক কারণ রয়েছে।
বিবাহের প্রয়োজনীয়তা
শরীর বৃত্তীয় চাহিদা মানব জীবনের অনিবার্য একটি অংশ। ক্ষুধা লাগলে যেমন খাবার প্রয়োজন হয়, তেমনি নারী পুরুষ একটি নির্দিষ্ট বয়সে উপনীত হলে তাদের যৌন চাহিদা সৃষ্টি হয় ৷ এটা সৃষ্টিকর্তার একটি সৃষ্টি। তাই প্রতিটি ছেলে মেয়ের উপযুক্ত বয়সে বিবাহ হওয়াটাই শ্রেয়।
এছাড়াও সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মানুষকে বল শরীর বৃত্তীয় প্রাণীই নয়। মানুষের মানসিক চাহিদা ও তার জীবনে একটি গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়। তাই মানুষের বন্ধুর প্রয়োজন হয়, মানসিক ভাব আদান-প্রদানের জন্য সাথীর প্রয়োজন হয়। একজন স্বামী বা স্ত্রী এক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখেন, তা অন্য কারো দ্বারা মানুষের জীবনে সম্ভবনা।
সাত পাক কেন ঘোরা হয়
আমরা সকলেই জানি, বিয়ের সময় বর-বধূ আগুনের চারপাশে ঘোরে। সাত বার আগুনের চারপাশে ঘুরতে হয়। একে সাত পাকে বাঁধা পরা বলা হয়। এই নিয়মের বিশেষ একটি কারণ আছে। আগুনের চারপাশে সাত পাক ঘোরা হয় বিয়েতে অগ্নি দেবতাকে সাক্ষী রাখার জন্য।
অগ্নি দেবতাকে সাক্ষী রেখে সারা জীবনের জন্য কিছু অঙ্গিকার করা হয়। এই অঙ্গিকার স্বামী স্ত্রীর প্রতি ও স্ত্রী স্বামীর প্রতি খুব নিষ্ঠা সহকারে পালনের জন্য। অগ্নি দেবতাকে সাক্ষী রাখা হয়, কারণ সাত পাক ঘুরে যে অঙ্গিকারগুলি নেওয়া হয়, তার যেন কোনও অমর্যাদা না হয়। সারা জীবন যেন একে অপরের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য, সত্য, সমর্থন, দুঃখ কষ্ট সব জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যেন পালন করে যেতে পারে।
হিন্দু বিয়েতে সাত পাকের মাহাত্ম্য
কথায় বলে, বিয়ে মানে দু’টি আত্মার মিলন আর তাও আবার সাত জন্মের! আর এই সাত জন্মের প্রতিজ্ঞাকে আরও বেশি মজবুত করতেই বিয়ের সময়ে সাত পাক একসঙ্গে ঘোরার নিয়ম।
হিন্দু বিয়েতে সাত পাক ঘোরার সময়ে অনেক মন্ত্র পড়া হয়, বর-কনে পুরোহিত মহাশয়ের বলে দেওয়া মন্ত্র অনেকসময়েই না বুঝেই বলতে থাকেন। কিন্তু প্রতিটি মন্ত্রের এক একটি অর্থ রয়েছে যা বিয়ের পরের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলে দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক সাত পাকের মাহাত্ম্য !
প্রথম প্রতিশ্রুতি- পবিত্র অগ্নির সামনে দাঁড়িয়ে বর, কনেকে কথা দেন যে বিয়ের দিন থেকে কনের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তাঁর। অগ্নি এবং অন্যান্য দেবদেবীর আশীর্বাদে যাতে কোনওদিনই নব-দম্পতির অন্ন-বস্ত্রের অভাব না হয় সেই দায়িত্ব বর নেন। উত্তরে কনে প্রতিজ্ঞা করেন যে সংসারের সুখের জন্য খুটিনাটি বিষয়ও তিনি নজরে রাখবেন। অর্থাৎ প্রথমে বর তাঁর বউ এবং তাঁর ভাবী সন্তানদের যত্ন নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বিনিময়ে কনেও প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর স্বামী এবং তাঁর পরিবারের যত্ন নেবেন।
দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি- সাত পাকের দ্বিতীয় পাক ঘোরার সময়ে বর-কনে একে অন্যকে প্রতিজ্ঞা করেন যে তাঁরা জীবনের সব ওঠাপড়ায় একে অন্যের সঙ্গে থাকবেন। বর কনেকে বলেন যদি কখনও কোনও বিপদ আসে, তা হলে তিনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের রক্ষা করবেন। আবার উত্তর কনে বরকে কথা দেন যে, সব সময় তিনি তাঁর স্বামীকে সাহস ও শক্তি যোগাবেন। অর্থাৎ এবার বর প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর স্ত্রীকে সবরকম পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করবেন। বিনিময়ে কনেও প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি স্বামীর সবরকম যন্ত্রণায় পাশে থাকবেন।
তৃতীয় প্রতিশ্রতি- তৃতীয় পাকে বর এবং কনে একে অন্যের পার্থিব সুখের দিকে নজর দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। তবে একইসঙ্গে আবার আধ্যাত্মিক পথেও হাটবেন বলেও একে অপরকে কথা দেন। অর্থাৎ এবার বর প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর পরিবারের জন্য রোজগার করবেন এবং তাঁদের দেখভাল করবেন। একই প্রতিশ্রুতি এবার কনেও করেন।
চতুর্থ প্রতিশ্রুতি- সাত পাকের চতুর্থ পাক ঘোরার সময়ে বর কনেকে কথা দেন যে সর্বাঙ্গে তিনি তাঁর স্ত্রীয়ের সম্মান রক্ষা করবেন এবং কনে বরের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন যে সারাজীবন তিনি তাঁর স্বামীকে ভালবাসবেন, অন্য সব পুরুষরা তাঁর কাছে গৌন। অর্থাৎ স্ত্রীর কাছে তাঁর পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দেওয়া এবং একইসঙ্গে স্ত্রীর সমস্ত মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন বর। স্ত্রী তাঁর সমস্ত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করার প্রতিশ্রুতু দেন।
পঞ্চম প্রতিশ্রুতি- একে অন্যকে সব সময় ভালবাসা এবং সম্মান করার প্রতিজ্ঞা হয় সাত পাকের পঞ্চম পাকটিতে। বর-কনে একসঙ্গে দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা করেন যাতে তাঁদের সংসার আনন্দে ও সমৃদ্ধিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে, তাঁদের সন্তান/রা যেন সুস্থ থাকে। বর এবং কনে একে অপরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে ওঠার অঙ্গিকারও করেন। অর্থাৎ যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেন বর। স্বামীকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দেন স্ত্রী।
ষষ্ঠ প্রতিশ্রুতি- ষষ্ঠ পাক নেওয়ার সময়ে সারা জীবন একে অপরের প্রতি সত্য থাকবেন – এই প্রতিজ্ঞাই করেন বর এবং কনে। অর্থাৎ স্ত্রীর প্রতি সত্য থাকার প্রতিশ্রুতি দেন স্বামী। স্ত্রীও স্বামীর প্রতি সত্য থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
সপ্তম প্রতিশ্রুতি- সাত পাকের শেষ পাকটি নেওয়ার সময়ে বর বলেন, এখন থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী হলাম। এখন থেকে আমরা এক। কনেও তাতে সহমত দেন। অর্থাৎ শুধু স্বামী হিসেবেই নয়, বন্ধু হিসেবেও সারাজীবন স্ত্রীর সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন বর। বিনিময়ে স্ত্রীও স্বামীর সঙ্গে জাবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
এই প্রতিশ্রুতিগুলো পরস্পরের প্রতি বহন করতে হয় বলেই হিন্দু বিয়ের শাস্ত্রীয় নাম হলো ‘বিবাহ’, অর্থাৎ ‘বিশেষভাবে বহন করা’। তাই হিন্দু বিয়ে মানেই আজীবনের সুরক্ষা ও অবিচ্ছেদ্য সুখ-শান্তির প্রতিশ্রুতি।