যোগিনী একাদশী ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আষাঢ় মাসের কৃষ্ণ পক্ষের একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য যুধিষ্ঠির – শ্রীকৃষ্ণ সংবাদরূপে বর্ণিত আছে। যুধিষ্ঠির বললেন-হে বাসুদেব! আষাঢ় মাসের কৃষ্ণ পক্ষীয়া একাদশী মাহাত্ম্য কৃপা পূর্বক আমাকে বলুন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন – হে মহারাজ! সকল পাপ বিনাশিনী ও মুক্তিপ্রদ এই উত্তম ব্রতের কথা বলছি, আপনি শ্রবণ করুন।
আষাঢ় মাসের কৃষ্ণ পক্ষীয়া একাদশী ‘যোগিনী’ নামে খ্যাত। মহাপাপ নাশকারী এই তিথি ভব সাগরে পতিত মানুষের উদ্ধার লাভের একমাত্র নৌকা স্বরূপ। ব্রত পালন কারীদের পক্ষে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রত বলে প্রসিদ্ধ। এই প্রসঙ্গে আপনাকে একটি পবিত্র পৌরাণিক কাহিনী বলছি।
অলকা নগরে শিবভক্ত পরায়ণ কুবের নামে এক রাজা ছিল। তিনি প্রত্যহ শিবপূজা করতেন। তার হেমমালী নমে একজন মালী ছিল। প্রতিদিন শিব পূজার জন্য মানস সরোবর থেকে সে ফুল তুলে যক্ষরাজ কুবেরকে দিত। বিশালাক্ষী নামে হেমমালীর এক পরমা রূপবতী পত্নী ছিল। সে তার সুন্দরী পত্নীর প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ছিল।
একদিন সে তার স্ত্রীর প্রতি কামাসক্ত হয়ে রাজভবনে যাওয়ার কথাও ভুলে গেল। বেলা দুই প্রহর অতীত হল। অর্চনের সময় চলে যাচ্ছে দেখে রাজা ক্রুদ্ধ হলেন। মালীর বিলম্বের কারণ অনুসন্ধানে এক দূত প্রেরণ করলেন। দূত এসে রাজাকে বলল-‘সে গৃহে স্ত্রীর সাথে আনন্দে মত্ত।’ দূতের কথা শুনে কুবের অত্যন্ত রেগে তখনি মালীকে তার সমনে হাজির করতে আদেশ দিল।
এদিকে মালী কুবেরের পূজার সময় অতিবাহিত হয়েছে বুঝতে পেরে অত্যন্ত ভয় পেল। তাই স্নান না করেই সে রাজার কাছে উপস্থিত হল। তাকে দেখামাত্র রাজা ক্রোধবশে চোখ রাঙিয়ে বললেন-রে পাপিষ্ঠ, দুরাচার! তুই দেবপূজার পুষ্প আনতে অবজ্ঞা করেছিস তাই আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি তুই শ্বেতকুষ্ঠগ্রস্থ হয়ে যা এবং তোর প্রিয়তমা ভার্যার সাথে তোর চিরবিয়োগ সংগঠিত হোক।
ওরে নীচ, তুই এখনি এই স্থান থেকে ভ্রষ্ট হয়ে অধোগতি লাভ কর। কুবেরের এই অভিশাপে হেমমালী পত্নীর সাথে স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে দীর্ঘকাল যাবৎ কুষ্ঠরোগ ভোগ করতে লাগল। রোগের যন্ত্রণায় দিন বেদনায় বহুকষ্টে সে জীবন যাপন করতে লাগল। কিন্তু দীর্ঘদিন মহাদেবের অর্চনের ফুল সংগ্রহের সুকৃতির ফলে সে শাপগ্রস্ত হয়েও বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ শিবের বিস্মরণ হয়নি।
একদিন হেমমালী ভ্রমণ করতে করতে হিমালয়ে শ্রী মার্কন্ডেয় ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হল। কুষ্ঠরোগে পীড়িত সপত্নী হেমমালীকে দর্শন করে শ্রী মার্কেন্ডয় তাকে জিজ্ঞাসা করলেন-‘তুমি কার অভিশাপে এইরকম নিন্দনীয় কুষ্ঠরোগ গ্রস্ত হয়েছ?’
সে উত্তরদিল-‘হে মুনিবর! রাজা ধনকুবেরের! আমি ভৃত্য ছিলাম। আমার নাম হেমমালী। আমি প্রত্যহ মানস সরোবর থেকে ফুল তুলে শিব পূজার জন্য রাজাকে দিতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে একদিন স্ত্রীর মনোরঞ্জন হেতু কামাসক্ত হওয়ায় সেই ফুলদিতে বিলম্ব হয়। রাজার অভিশাপে এইরকম দুর্দশাগ্রস্থ হয়েছি।
পরোপকারই সাধুগণের স্বাভাবিক কর্ম। হে ঋষিশ্রেষ্ঠ! আমি অত্যন্ত অপরাধী। কৃপা করে আমার প্রতি প্রসন্ন হোন।’তখন দয়ার্দ্র চিত্ত মার্কন্ডেয়মুনি বললেন-হে মালী! তোমার মঙ্গলের জন্য শুভফল প্রদানকারী একব্রতের উপদেশ করছি। তুমি আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষের ‘যোগিনী’ নামক একাদশী ব্রত পালন কর। এই ব্রতের প্রভাবে তুমি অবশ্যই কুষ্ঠব্যাধি থেকে মুক্ত হবে।
শ্রী কৃষ্ণ বললেন – ঋষির উপদেশ শ্রবণ করে হেমমালী তাকে প্রণাম জানাল। পরে অত্যন্ত আনন্দে ঋষির আদেশ মতো নিষ্ঠার সঙ্গে যোগিনী একাদশী ব্রত পালনকরল। এইভাবে হেমমালী সমস্ত রোগথেকে মুক্ত হল ও পত্নীসহসুখে জীবনযাপন করতে লাগল। হে মহারাজ যুধিষ্ঠির! আমি আপনার কাছে এই ব্রত উপবাসের মহিমা কীর্তন করলাম।
এই দিনের পালনীয় কর্তব্যঃ
যাঁরা একাদশী ব্রত পালন করেন, এদিন উপবাস করেন তাঁরা। যাঁরা পুরনো পাপ থেকে মুক্তি পেতে চান, তাঁদের জন্য এই একাদশী পালন করা জরুরী, এর ফলে স্বাস্থ্যও ভাল থাকে। এদিন বিষ্ণু মন্ত্র বা বিষ্ণু সহস্রনাম জপ করতে হয়। বলা হয়, যোগিনী একাদশী পালন করলে ৮৮ জন ব্রাহ্মণভোজন করানোর পুণ্যলাভ হয়।
যে ব্যক্তি এই মহাপাপবিনাশকারী ও পুন্যফলপ্রদায়ী যোগিনী একাদশীরকথা পাঠ এবং শ্রবণ করে সে অচিরেইসর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়।
এই তিথির গুরুত্বঃ
১. বাড়িতেই এই তিথি পালন করে লাভ করুন ১০ বছরের পূণ্য লাভ হবে একবারে। এই একাদশীতে ভগবান বিষ্ণুর পাশাপাশি মহাদেবী লক্ষ্মীরও পুজো করতে পারেন।
২. এই পুজোয়, দক্ষিণমুখী শঙ্খগুলিতে জাফরান মিশ্রিত দুধ রাখুন এবং সেই দিয়েই আরাধ্যা ঈশ্বরের অভিষেক করুন। এই অভিষেক গোপালও খুব পছন্দ করেন।
৩. বাড়িতে গোপাল থাকলে এদিনে গোপালকেও মাখন ও মিশ্রি দিয়ে পুজো দিতে পারেন।
৪. বিশেষ এই একাদশী তিথিতে শিব লিঙ্গ তামার পাত্র দিয়ে জল অর্পণ করা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।
৫. সেই সঙ্গে শিব লিঙ্গে জল ঢালার সময় ওম নম: শিবায় মন্ত্র জপ করুন। এই মন্ত্র কমপক্ষে ১০৮ বার উচ্চারণ করা প্রয়োজন।
৬. পাশাপাশি শিবলিঙ্গে বিল্বপত্র এবং ধুতরা ফুল অর্পণ করুন। প্রদীপ এবং কর্পূর জ্বালিয়ে আরতি করুন।
৭. এই একাদশীর তিথিতে বজরঙ্গবলীর সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে হনুমান চালিশা পাঠ করুন।
৮. পুজোর পরে দুঃস্থদের অর্থ ও খাদ্যশস্য দান করা উচিত। এই তিথিতে সকাল বেলায় স্নান সেরে তুলসী গাছে জল অর্পণ করুন।
৯. পাশাপাশি সূর্যাস্তের সময় তুলসীর গাছে প্রদীপ জ্বালান এবং তুলসী মঞ্চ তিন বা পাঁচ বার প্রদক্ষিণ করুন।
উপবাস ও পুজো বিধি
১) যোগিনী একাদশীর উপবাস একাদশীর ব্রাহ্মমুহুর্ত যেদিন থাকে সেদিন থেকে শুরু হয় অথবা দশমীর রাত থেকে শুরু হয়।
২) দশমীর রাতে উপবাসের শুরু ফলে ব্রহ্মচর্য পালন করা উচিত। সম্ভব হলে মাটিতে ঘুমনো উচিৎ।
৩) খুব সকালে উঠে স্নান সারার পর শুদ্ধ মনে ব্রত পালন শুরু করুন।
৪) ঘট প্রতিষ্ঠা করুন এবং এতে ভগবান বিষ্ণুর পুজো করুন।
৫) প্রয়োজনে নারায়ণের প্রতিমা অর্পণ করে তাতে ফুল, ধূপ, প্রদীপ ইত্যাদি দিয়ে আরতি করুন।
৬) যোগিনী একাদশীর ব্রত কথা দিনের বেলা শুনতে হবে।
৭) ঘরে নারায়ণের মূর্তি না থাকায় অনেকে বট গাছেও পুজো করেন।
৮) রাতে জাগরণও পালন করা উচিত। এইভাবে এই ব্রত পালনের ফলে আপনার জীবনের বিভ্রান্তি দূর হবে এবং সাত্ত্বিক জীবন যাপন করতে সক্ষম হবেন।