যে কারণে শ্রাবণ মাস “নীলকন্ঠ” মহাদেবের মাস বা ভালোবাসার মাস! পর্ব – ১

জড় জগতের তিনটি অবস্থা সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়। ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু হলেন পালনকর্তা, আর শম্ভু বা দেবাদিদেব মহাদেব হলেন সংহার কর্তা। সমগ্র জড় জগৎ জড় প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সত্ত্ব গুণের অধীশ্বর হলেন বিষ্ণু। রজ গুণের অধীশ্বর হলেন ব্রহ্মা এবং তম গুণের অধীশ্বর হলেন শিব বা শম্ভু।

‘শিব’ শব্দটির অর্থ হলো ‘মঙ্গলময়’। তা সত্ত্বেও শ্রীমদ্ভাগবতের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি ভগবান শিবের নির্মল স্বর্ণাভ দেহ ভষ্মের দ্বারা আচ্ছাদিত। তার জটাজুট শ্মশানের ধূলির প্রভাবে ধূম্র বর্ণ। তিনি সন্ধ্যাকালে ভূতগণ পরিবেষ্টিত হয়ে তাঁর তার বাহন বৃষভের পিঠে চড়ে ভ্রমণ করেন। অথচ ব্রহ্মার মতো মহাপুরুষেরা তাঁর শ্রীপাদপদ্মে নিবেদিত পুষ্প মস্তকে ধারণ করেন।

‘হলাহল’, বিষ ও ক্ষির সাগর মন্থন

স্বর্গের রাজা দেবরাজ ইন্দ্র তার হস্তীবাহন ঐরাবতে চড়ে দুর্বাসা মুনির নিকট উপস্থিত হলে তার নির্দেশে বনদেবী একটি অপরূপ মাল্য নির্মাণ করেন ও তার প্রতি উৎসর্গ করেন৷ ইন্দ্র ঐ মাল্য উপহার গ্রহণ করেন এবং নিজেকে অনহংবাদী দেবতা রূপে প্রমাণিত করার জন্য মালাটি ঐরাবতের শুঁড়ে রাখেন৷ ঐরাবত জানতো যে ইন্দ্র নিজের অহংকার সংবরণ করতে পারেন না ফলে বাহনটি ঐ বরণমালা ছুড়ে মাটিতে ফেলে দেয়৷ এই ঘটনায় মুনি ক্রোধান্বিত হন, কারণ মালাটিতে বনশ্রীর বাস ছিলো, শুধু তাই নয় সেটি দেবতার প্রতি মুনির একমাত্র প্রসাদ নিবেদন ছিলো৷ দুর্বাসা মুনি ইন্দ্র সহ সমস্ত দেবতাদের অভিশম্পাত দেন যে তারা তাদের সমস্ত বল, ভাগ্য ও শক্তির সহিত প্রিজন নিয়োগবিধুর থাকবে৷

এই খবর শুনে অসুরকুল দেবতাদের সহজে পরাস্ত করতে যুদ্ধের আহ্বান দেন৷ ফলে যুদ্ধ শেষে অসুরেরা দেবতাদের সাথে যুদ্ধে জয় লাভ করেন এবং অসুররাজ মহাবলী সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিজ হস্তোগত করেন৷ দেবতাগণ বিষ্ণুর সাহায্যপ্রার্থী হন৷ তিনি দেবতাগণকে নির্দেশ দেন তারা যেন অসুরগণের সাথে কুটনৈতিকভাবে সম্বন্ধ্য স্থাপন করে৷ দেবগণ অসুরকুলের সাথে আঁতাত করে আলাপ আলোচনায় বসে এবং নিজেদের মধ্যে ঠিক করেন যে তারা সমুদ্রমন্থনের মাধ্যমে অমৃৃতের খোঁজ আনবেন এবং তা তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবেন৷ যদিও বিষ্ণু দেবতাদের আশ্বস্ত করেন যে তিনি ষড়যন্ত্র করে এমন ব্যবস্থা করবেন যেন ঐ অমৃৃত শুধুমাত্র দেবতারাই আস্বাদিত করতে পারেন৷

ক্ষীরসাগরে সমুদ্রমন্থনের প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিলো৷ এক্ষেত্রে মন্দর পর্বত মন্থনদণ্ড হিসাবে এবং শিবের স্কন্ধসঙ্গী নাগরাজ বাসুকী মন্থনরজ্জু হিসাবে ব্যবহৃৎ হয়েছিলো৷

বিভিন্ন গ্রন্থের একাধিক সংস্করণে এরকম অনুমান করা হয় যে, বিষ্ণু আন্দাজ করতে পেরেছিলেন দীর্ঘকালীন টানাটানিতে মন্থনরজ্জু হিসাবে ব্যবহৃত বাসুকী নাগ বিষোদ্গার করতে পারে৷ আবার দেবতারা প্রাথমিকভাবে বাসুকীনাগের মুখের দিকটিই ধরেছিলো আর অসুরগণ ধরেছিলো লেজের অংশ৷ এই নিয়ে অসুররা বেশ অসন্তুষ্টও ছিলো কারণ কোনো জন্তুরই মাথার দিক থেকে লেজের দিক অধিক অপবিত্র থাকে৷ এসময়ে মহাবিশ্বের অধিপতি হিসাবে অসুররাই বাসুকীনাগের মাথার দিকটি ধরে সমুদ্রমন্থন করতে চেয়েছিলো৷ বিষ্ণু তাদের চাহিদা ও নিজের আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে দেবতাদের এ বিষয়ে সম্পর্কে জ্ঞাত না করিয়ে তাদেরকেই লেজের দিকটি ধরতে অনুরোধ করেন৷ এক্ষেত্রে বিষ্ণুর প্রতি-মনস্তত্ত্ব জয়ী হয়৷

অসুররা বাসুকীনাগের মাথার দিক ধরে থাকার দাবী জানায় আবার দেবতারাও শ্রীবিষ্ণুর পরামর্শে তার লেজের দিক ধরেই সমুদ্রমন্থন করা শুরু করে৷ সমুদ্রের মাঝে মন্দর পর্বতটি স্থান পেলে প্রতিটি মন্থন ঘুর্ণনের সাথে একটু একটু করে এটি সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া শুরু করে৷ তখন এই সমস্যার নিষ্পত্তি করতে বিষ্ণু কূর্ম অবতারের রূপ ধারণ করেন এবং মন্দর পর্বতকে জলে নিমজ্জিত হওয়া থেকে উদ্ধার করতে নিজের বিশাল খোলক দিয়ে মন্দর পর্বতকে নীচ থেকে ধরে রাখেন৷ অসুররা এর ফলে বাসুকী নাগের মুখ থেকে বের হওয়া বিষে সিক্ত হতে থাকে৷ দেবতারা এবং অসুররা পর্যায়ক্রমে মন্থনরজ্জু বাসুকীনাগকে নিজেরদের দিকে টানতে থাকলে মধ্যবর্তী মন্দর পর্বতও একবার বামে একবার ডানে ঘুরতে থাকলে সমুদ্র মন্থিত হওয়া শুরু হয়৷

সমুদ্র মন্থনের ফলে মথিত সমুদ্র তথা ক্ষীরসাগর থেকে একাধিক দ্রব্যাদি উত্থিত হয়েছিলো তাদের মধ্যে একটি ছিলো মারণ বিষ, যা হলাহল বা কালকূট নামে পরিচিত৷ যার প্রভাবে সমস্ত ব্রহ্মান্ডের বায়ু বিষাক্ত হয়ে গেল। আবার অন্যান্য একাধিক সংস্করণে বর্ণিত রয়েছে যে হলাহল সমুদ্রমন্থনে নয় বরং মন্থন রজ্জু হিসাবে ব্যবহৃৎ নাগরাজ বাসুকীনাগই অত্যধিক ঘুর্ণন ও দেবাসুরে অবিরত টানাটানির কারণে ঐ বিষোদ্গার করে৷ ফলে দেবতা এবং অসুররা বেশ আতঙ্কিত হয়েছিলেন কারণ অমৃত প্রাপ্তির পূর্বেই এরকম মারণ বিষ সমস্ত সৃষ্টিকে বিনাশ করার ক্ষমতা রাখে৷ দেবগণ তখন ভগবান শিবের দ্বারস্থ হন এবং আত্মরক্ষার নিবেদন জানান৷ শিব তখন ত্রিভূবন রক্ষার্থে ঐ বিষ পান করলে তিনি কণ্ঠে অগ্নিসম জ্বলন অনুভব করেন৷

আবার অন্যকিছু আঞ্চলিক সংস্করণ অনুসারে শিব ঐ হলাহল পান করলে তার সমস্ত শরীরজুড়ে অসহ্য যন্ত্রনা করা শুরু হয়৷ স্বামী শিবের এরূপ দশা তার স্ত্রী পার্বতীর পক্ষে দেখা সম্ভব ছিলো না৷ ফলে তিনি তৎক্ষণাৎ শিবের কণ্ঠে আঙ্গুল রাখেন এবং পান করা বিষ শিবের কণ্ঠ থেকে গ্রাসনালীতে নামতে বাধা সৃষ্টি করেন এবং নিজ মায়াবলে তা ঐ স্থলেই শাশ্বতভাবে আটক করেন৷ ফলস্বরূপ তার কণ্ঠ নীল হয়ে ওঠে এবং এজন্য তিনি “নীলকণ্ঠ” নাম পান৷ দেবতা, মানব, দানব সবাই ভগবান শিবের জয় জয়কার করল এবং ব্রহ্মা বিষ্ণু মহাদেবকে নীলকন্ঠ নামে ভূষিত করলেন।

পরবর্তীতে মহাদেবের দেহে বিষক্রিয়া শুরু হলে তিনি ছোট শিশুর রূপ নিলেন এবং ক্রন্দন করতে শুরু করলেন। বলে রাখা ভাল এগুলো সবই মহাকাল সদাশিবের লীলা। এরপর ভগবান শিবের কান্না দেখে মা পার্বতি নতুন রুপে অবতীর্ণ হলেন এবং ছোট শিশুরুপী মহাদেব কে স্তনপান করালেন। নিজের বুকের দুধ পান করিয়ে তাঁর প্রাণরক্ষা করেন পার্বতী। এতে ভগবান শিবের বিষক্রিয়া কমল এবং তিনি পুনরায় সদাশিব রুপে ফিরে এলেন।

shiva gonga

হলাহল বিষের তাপমাত্রার প্রভাব প্রশমিত করার জন্য দেবতারা শিবের জন্যগঙ্গা অভিষেক করেন। আর এই গঙ্গা অভিষেকের মাধ্যমে দেবতারা শিবকে প্রসন্ন করেছিলেন । শিবের সেই গঙ্গা অভিষেকে শুধুমাত্র সাপেরা এগিয়ে এসেছিল এই ঐশ্বরিক কারণ সমর্পনের জন্য । তারা নিজেরাও বিষের কিছু অংশ পান করে ও তাদের বিষ দাঁতে কিছু বিষ গ্রহণ করে । সে জন্যই সেদিন থেকেই কিছু সাপ বেশি বিষাক্ত হয়ে ওঠে। সমুদ্র মন্থনের সময় যে গঙ্গা অভিষেক করা হয়েছিল, শিবের উপাসকদের দ্বারা শিবলিঙ্গে দুধ ঢালার কারণ হচ্ছে -শিবের প্রতি ভক্তদের ভক্তি প্রতিভাস করার জন্য। শিবের পূজায় শিবলিঙ্গে দুধ ঢালা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কারণ অভিষেক ছাড়া শিবের পূজা অসস্পূর্ণ । অভিষেকের সময় এই দুধ ঢালা খুবই পবিত্র । কারণ অভিষেকের দ্বারাই শিবের প্রতি ভক্তদের গভীর অনুরক্তি প্রকাশিত হয়।

shiva-ovishek

সেই কারণে মহাদেবকে শ্রাবণ মাসে দুধ অথবা জল ঢেলে পুজো করেন ভক্তরা। বিশেষ করে শ্রাবণ মাসের সোমবারগুলিতে উপবাস রেখে শিবলিঙ্গের মাথায় দুধ অথবা জল ঢালার প্রথা রয়েছে। এতে পূণ্য লাভ হয় বলে বিশ্বাস। এ ছাড়াও শ্রাবণ মাসে বেশি করে ভজন, কীর্তন শুনলে তা আধ্যাত্মিক ভাবে মানুষের আত্মাকে শোধন করে বলে মনে করা হয়। শ্রাবণ মাসকে উত্সাবের মাস হিসেবেও মনে করা হয়। রাখিবন্ধন, নাগ পঞ্চমী, ওনাম, কাজোরি পূর্ণিমার মতো একাধিক উত্সকব পালন করা হয় শ্রাবণ মাসে।

শুধু তাই নয়, শিব-পার্বতীর গভীর প্রেমকে মাথায় রেখে শ্রাবণ মাসকে ভালোবাসার মাস হিসেবেও মনে করা হয় হিন্দু ধর্মে। শুধু নর-নারীর মধ্যে নয়, বেশিরভাগ পশুপাখির এটাই মিলনের সময়। সে কারণে শ্রাবণ মাসে ন্যাশনাল পার্কগুলি বন্ধ রাখা হয়। যাতে দর্শকরা পশু-পাখিদের এই সময় বিরক্ত না করতে পারে। এ ছাড়াও শ্রাবণ মাসে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। তাই বেশি তৈলাক্ত, মশলাদার খাবার এই সময় বর্জন করা উচিত। শ্রাবণ মাসে নিরামিষ খাওয়া সম্ভব হলে সবচেয়ে ভালো।

আগামী পর্বে এসংক্রান্ত প্রাকৃতিক বা প্রকৃতিতে এই হলাহল বিষ সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করব।

তথ্যসূত্রঃ

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.