মহাদেব হলাহল বিষ পান করে এই সমগ্র সৃষ্টিকে রক্ষা করেন। গত পর্বে দেখলাম এই হলাহল বিষ এবং এ বিষের প্রভাব। এখন এই হলাহল বিষ ও এর প্রভাব প্রকৃতিতে কি ধরনের প্রভাব বিস্তার হয় তা দেখি।
প্রথমতঃ ভোলানাথের স্তনপান করার কাহিনীটি সম্ভবত কোন শাক্ত উপপৌরাণিক রচনায় বর্ণিত কেননা, হিন্দু ধর্মের শাক্ত সম্প্রদায়টি ঈশ্বরকে দেবী রূপে উপাসনা করে। তাঁদের কাছে দেবী হলেন জগত্জননী, অর্থ্যাত্ তিনি সকলের মা এমনকি মহাদেব শিবেরও মা। সমুদ্রমন্থনের সময় শিব বিষপান করে সংসারকে রক্ষা করলেন বলে তিনি সকলের কাছে প্রসংশিত হলেন, কিন্তু যে দেবী ছুটে এসে তার কন্ঠ টিপে বিষকে সংক্রামিত হওয়ার থেকে রোধ করলেন তিনি কি প্রসংশিত হবেন না? তিনিও হবেন, তাই পরবর্তীতে স্তনপানের কাহিনীটি রচনার মাধ্যমে দেবীকে মহিমান্বিত করে হিন্দুধর্মে তাঁর পদমর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়েছিল।
দ্বিতীয়তঃ অপরদিকে এই কাহিনীর দ্বিতীয় বাস্তবিক ব্যখ্যাটি একটু গভীর। এটা জানতে গেলে জীববিজ্ঞান সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকতে হবে। শিবের স্তনপান আসলে ‘সরিসৃপ প্রজাতির দীর্ঘজীবিতার রহস্যে’র দিকে নির্দেশ করে। জানি, এটা শুনতে অদ্ভুত লাগবে কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ আমরা দিতে পারি ― আপনারা জানেন, ভগবান শিবকে ‘নাগেশ্বর’ও বলা হয় কারণ তিনি নাগ বা সর্প প্রজাতির দেবতা। সমুদ্রমন্থনে তাঁর গলায় আশ্রিত বাসুকি নাগকেই মন্থন-পাশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
হলাহল ছিল বাসুকিরই বিষ যা শিব পান করেছিলেন, কিন্তু পরে তার শরীরে তা সংক্রামিত হলে তিনি প্রকৃতিস্বরুপা, অমৃতবক্ষা দেবীর স্তন পান করে চিরঞ্জীবির অধিকারি হন। আসলে চিরঞ্জীবি শিব নয়, হয়েছিল সরিসৃপ প্রজাতি; শিব এখানে সেই নাগ/সর্প/সরিসৃপ প্রজাতির প্রতীকি প্রতিনিধি মাত্র। দেবীর স্তনদান প্রক্রিয়া হল প্রকৃতির নিয়মে সরিসৃপ প্রজাতির দীর্ঘজীবি হওয়া ঘটনার প্রতীকি উপস্থাপনা মাত্র। সেকারণেই হয়ত পৃথিবীর বুকে অস্তিত্বের সংগ্রামে সরিসৃপ প্রজাতি সেই ডাইনোসেরর যুগ থেকে এখনও পর্যন্ত অন্যান্য প্রাণীর মত লুপ্তপ্রায় হয়ে যায়নি বরং টিকে রয়েছে।
তৃতীয়তঃ এখন দেখে আসি মহাভারতে এই কাহিনী কিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে! মহাভারতে বিষ্ণুবাহন গরুড় এর কাহিনীটি আমরা সকলেই জানি। সেখানে বলা হয়েছে: ‘পক্ষীরাজ গরুড় যখন ইন্দ্রলোক থেকে সোমরস (অমৃত) প্রাপ্ত করে আকাশপথে ফিরে আসছেন তখন, অমৃতপাত্র থেকে কয়েক বিন্দু অমৃত, ধরায় পতিত হয়।
অমৃতের ওপর প্রলোভন রয়েছে সবারই। ধরায় বিচরণরত সর্পেরা তখন ঐ কয়েক বিন্দু অমৃত চাটতে থাকে। কিন্তু সামান্য পরিমাণ অমৃত পানে তারা অমরত্বের পরিবর্তে দীর্ঘায়ু লাভ করে কিন্তু সর্পেরা যেহেতু জিহ্বা দিয়ে বারংবার মাটি চেটেছিল সেহেতু তাদের জিহ্বায় ক্ষতের সৃষ্টি হয় যার ফলস্বরূপ পরবর্তীকালে তাদের বংশধরেরা চেরা জিভ নিয়ে জন্মায়। দীর্ঘায়ুতার উপহার ছিল তাদের শরীরের চামড়া। অর্থ্যাত্ সর্পেরা যতবার তাদের পুরোন খোলস ত্যাগ করবে ততবারই তারা নব্যতার অনুভূতি পেয়ে থাকবে…’
অর্থ্যাত্ আমরা উপরোক্ত পৌরাণিক কাহিনী গুলোতে একটি ঘটনার মধ্যেই মিল লক্ষ্য করছি যেটা হল ‘সর্পপ্রজাতির দীর্ঘায়ু লাভ’। তাই এখন যখন আপনারা শিবের নিজের স্ত্রীর স্তনপান করার ঘটনাটির বাস্তবিক কারণগুলি জেনে গিয়েছেন, আশাকরি ভবিষ্যতে এই ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে হিন্দু ধর্মের শত নিন্দা হলেও, আপনি ব্যথিত হবেন না কারণ সত্যিটা আপনি জানেন আর সত্য জেনে লজ্জিত হওয়া, মূর্খামির পরিচয়। সত্যিটা যেমনই হোক তাকে স্বীকার করতে হয়।
শিবের হলাহল পানের এই দৃষ্টান্ত থেকে আমরা বেশ কয়েকটি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
১. সমস্ত কর্মের মাধ্যমে ভগবানকে প্রসন্ন করা
২. আমাদের প্রাণ, অর্থ, বুদ্ধি, বাকশক্তি প্রভৃতির সাহায্যে সর্বদা পরোপকারের চেষ্টা করা।
৩. হলাহল পান করার পূর্বে শিব তাঁর স্ত্রী ভবানীর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। এখান থেকে শিক্ষনীয় যে, আদর্শ গৃহস্থের কর্তব্য কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পত্নীর সঙ্গে আলোচনা করা। এই কারণে পত্মীকে বলা হয় অর্ধাঙ্গিনী।
তথ্যসূত্রঃ
- উইকিপিডিয়া
- এই সময়
- কৃষ্ণলীলা
- ফেসবুক (কৃষ্ণ কথা)