‘অম্বুবাচী’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘অম্বু’ বা জল সূচনা। এ ছাড়াও বলা হয় ‘রজোযুকক্ষ্মাম্বুবাচী’। অর্থাৎ, পৃথিবীকে এই সময়ে ঋতুমতী হিসেবে কল্পনা করা হয়। অনেক জাতিরই ধর্মীয় চেতনা মজ্জাগত। সেই ধর্মীয় চেতনার উপরে ভর করে গড়ে উঠেছে নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও। তেমনই একটি আচার ‘অম্বুবাচী’।
অম্বুবাচী হিন্দুধর্মের বাৎসরিক উৎসব। অম্বুবাচীকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় আমতি/আমেতি (অসম) / অমাবতীও বলে। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আষাঢ় মাসের আষাঢ় মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত এই রীতি পালন করা হয়। অর্থাৎ আগামী ২২ জুন হতে ২৫ জুন পর্যন্ত অম্বুবাচী ব্রতটি বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ পালন করে থাকলেও অসমের কামাখ্যা মন্দিরে অম্বুবাচীকে কেন্দ্র করে বিশাল উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে।
লোকবিশ্বাস মতে আষাঢ় মাসের প্রথম ৬ দিন ৪০ দণ্ডে মৃগশিরা নক্ষত্রের শেষ ২ পাদে সূর্যের ভোগ হয়। তার পরে যে তিন দিন বিশ দণ্ড পর্যন্ত সূর্য আর্দ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদে থাকেন। আষাঢ় মাসের মৃগশিরা নক্ষত্রের তৃতীয় পাদ শেষ হলেই, অর্থাৎ চতুর্থ পাদের শুরু থেকে তিন দিন অম্বুবাচী আচার বা ব্রত পালন করা হয়। সূর্যের দক্ষিণায়নের দিন থেকে তিন দিন অর্থাৎ আষাঢ় মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত দিনগুলিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়। অম্বুবাচী হিন্দুধর্মের বাৎসরিক উৎসব।
বাংলা প্রবাদে রয়েছে ‘কিসের বার কিসের তিথি, আষাঢ়ের সাত তারিখ অম্বুবাচী।’ এদিন থেকেই হয় অম্বুবাচী শুরু। জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, সূর্য যে বারের যে সময়ে মিথুন রাশিতে গমন করেন, তার পরবর্তী সেই বারের সেই কালে অম্বুবাচী হয়। অর্থাৎ, পৃথিবী এই সময়ে ঋতুমতী হন। সূর্যের দক্ষিণায়নের দিন থেকে তিন দিন অর্থাৎ আষাঢ়ের ৭ তারিখ থেকে ১০ চার দিন গ্রাম-বাংলার মহিলারা এই অনুষ্ঠান পালন করেন।
এই সময় থেকেই বর্ষার সূচনা। অম্বুবাচী একটি ধর্মীয় আচার হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের আমাদের প্রাচীন কৃষি পদ্ধতিও। আসলে নতুন বর্ষার শুরুতে পৃথিবী জলসিক্ত হয়ে ওঠে, তখন তাকে ঋতুমতী নারীরূপে গণ্য করা হয়। পূর্ণ বয়স্কা মহিলা যেমন ঋতুকালের পরে সন্তান ধারণে সক্ষম হন, ধরিত্রী মাতাও অম্বুবাচীর পর শস্য শ্যামলা হয়ে ওঠেন। ধরিত্রী মাতা আমাদের সকলের জন্মদাত্রী। ওড়িশায় এই পার্বণকে সরাসরি ‘রজ উৎসব’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে এমন কিছু কাজ রয়েছে, যা অম্বুবাচীর সময়ে মেনে চলা উচিত।
• অম্বুবাচীর তিন দিন পর্যন্ত কোনো ধরনের মাংগলিক কার্য করা যায়না। চতুর্থ দিন থেকে মঙ্গলিক কাজে কোনো বাধা থাকেনা।
• এই সময়ে জমিতে চাষ আবাদ করতে নেই।
• এই তিন দিনে গৃহ প্রবেশ, বিবাহ ও অন্যান্য শুভ কাজ করা উচিত নয়।
• এই সময়ে অন্য কোনও বিশেষ পুজোর আয়োজন না করাই ভাল। তবে কোনও কোনও বছর এই সময়ে রথযাত্রার উৎসব পড়লে, তা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই করা যেতে পারে। কারণ রথযাত্রাকে নিত্যকর্ম হিসাবেই ধরা হয়।
• যেহেতু এই সময় শুভ কাজ করতে নেই। তাই জমি বাড়ি ক্রয় বা বিক্রয় করাও নিষেধ রয়েছে ।
• বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া যাত্রাও নিষেধ।
• এই সময়ে মঠ-মন্দিরের প্রবেশদ্বার বন্ধ থাকে।
• সমস্ত দেবীর মূর্তি, ছবি বা পট লাল কাপড়ে ঢেকে রাখুন। ভুলেও মূর্তি বা পট স্পর্শ করবেন না।
• পূজার সময় কোনও মন্ত্র পাঠ করবেন না, কেবল ধূপ-দীপ দেখিয়ে প্রণাম করুন।
• যাঁরা আদি শক্তির বিভিন্ন রূপ পুজো করেন, যেমন মা কালী, দেবী দুর্গা, দেবী জগদ্ধাত্রী, মা বিপত্তারিণী,মা শীতলা, দেবী চণ্ডীর মূর্তি বা পট পূজা করেন, তাঁরা এই সময়ে মূর্তি বা পট লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখবেন।
• যেহেতু এই কয়েকদিন মা ঋতুমতী থাকেন তাই বলা হয় এই সময় যৌন সংসর্গও অনুচিত।
• এইসময় পৃথিবীর বুকে আগুন ধরানো হয়না।
• পৃথিবীর বুকে আঘাত করা নিষেধ।
• এমনকি জামা কাপড় কাচাকাচিও এই সময় বন্ধ থাকে।
• এই সময় ভাজা বা আগুনে পোড়ানো খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ।