ভাদ্র মাসের কৃষ্ণাষ্টমী শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি। এদিন তিনি পৃথিবীর ভার মোচনের জন্য অবতাররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি পূর্ণাবতার, স্বয়ং ভগবান— কৃষ্ণস্তু স্বয়ং ভগবান্। পৃথিবীকে ভারমুক্ত করার জন্য এর আগেও তিনি একাধিকবার এসেছিলেন। এ সম্পর্কে গীতায় তাঁর ‘যদা যদা হি … সম্ভবামি যুগে যুগে’ উক্তিটি সবারই জানা। কৃষ্ণরূপে জন্ম নিয়ে তিনি শিশু অবস্থায় শিশুঘাতিনী পূতনাকে বধ করেন। একে একে বকাসুর, অঘাসুর এবং আরো অনেক অসুরকে বধ করেন। কৈশোরে বধ করেন মথুরার অত্যাচারী রাজা, তাঁর মাতুল কংসকে, যে নিজের পিতা উগ্রসেনকে বন্দি করে সিংহাসন দখল করেছিল।
যৌবনে তিনি মধ্যম পাণ্ডব ভীমকে দিয়ে বধ করান অত্যাচারী মগধরাজ জরাসন্ধকে। এর পর তিনি নিজে বধ করেন দুর্বৃত্ত চেদিরাজ শিশুপালকে, যে সম্পর্কে ছিল তাঁরই পিশতুত ভাই। এভাবে তিনি একে একে ভারমুক্ত করে পৃথিবীকে সজ্জনের বাসোপযোগী করে তুলছিলেন। কিন্তু এমন সময় সবচেয়ে বড় ভাররূপে আবির্ভূত হয় কুরুরাজ দুর্যোধন, তাঁরই আত্মীয়— পিশতুত ভাই যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুনের জ্যাঠতুত ভাই। তিনি তাকে অনেক বুঝিয়েছেন, আত্মশুদ্ধির অনেক সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু ‘চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী’, ‘অঙ্গারঃ শতধৌতেন মালিন্যং ন মুঞ্চতি’। তাই ভারতযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্রে কৌরব ও পাণ্ডবরা মুখোমুখি।
অর্জুন সারথি শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, রথটা উভয় সেনাদলের মাঝখানে নিয়ে যেতে। কারণ তিনি দেখতে চান অপরপক্ষে যুদ্ধের জন্য কারা উপস্থিত হয়েছেন। তিনি দেখলেন— ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখ একান্ত আপনজনেরা উপস্থিত। যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে অর্জুনকে এঁদের হত্যা করতে হবে। তাঁর বুক কেঁপে উঠল। তিনি তীরধনু ফেলে রথের ওপর বসে পড়লেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বললেন যুদ্ধ করবেন না। স্বজনদের হত্যা করে রাজ্যলাভে তাঁর প্রয়োজন নেই। এর চেয়ে ভিক্ষা করে কিংবা বনের ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণও অনেক ভালো। তখন ভগবান গর্জে উঠলেন, ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বয্যুপপদ্যতে। ক্ষুদ্রং হূদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ’— হে অর্জুন! এরূপ পৌরুষহীনতা তোমাতে শোভা পায় না; তুমি ক্ষত্রিয়, তাই হূদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াও, যুদ্ধ করো।
এর পর ভগবান অর্জুনকে আরো তীব্র আঘাত করলেন। তিনি বললেন, ‘স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি। ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়ো ন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে’— হে অর্জুন! তুমি যদি তোমার নিজের ধর্মের কথাও চিন্তা করো, তাহলেও তোমার কম্পিত হওয়া উচিত নয়, কারণ ধর্মযুদ্ধ ছাড়া ক্ষত্রিয়ের অন্য কোনো শ্রেষ্ঠ কাজ নেই।
লক্ষণীয় যে, ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি, ভগবান এখানে তা বোঝাননি। তিনি ধর্ম বলতে বুঝিয়েছেন যার যার পেশাকে। তাঁর মতে নিজ নিজ পেশাগত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করাই ধর্ম। সে-মতে অধ্যাপকের ধর্ম অধ্যাপনা, ছাত্রের ধর্ম অধ্যয়ন, কৃষকের ধর্ম কৃষিকাজ ইত্যাদি। এই ধর্ম পালনে যে ব্যর্থ হয়, তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। আগুনের ধর্ম উষ্ণতা। উষ্ণতা হারালে আগুন আর আগুন থাকে না। জলের ধর্ম তরলতা। তারল্য হারালে জল আর জল থাকে না। তেমনি ক্ষত্রিয়ের ক্ষাত্রধর্ম হারালে সে আর ক্ষত্রিয় থাকে না। অর্থাৎ, পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা বিপর্যয় ডেকে আনে।
এ প্রসঙ্গে ভগবান আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ। স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ’— নিজের ধর্ম যেমনই হোক তা পরের ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ; স্বধর্মে নিধনও ভালো, কিন্তু পরধর্ম ভয়াবহ। এর অর্থ— আমার যে পেশা, আমার বিজ্ঞতা সেখানেই; সেটা ছেড়ে অন্যের পেশায় হাত লাগালে দুটোই বিপর্যস্ত হবে। এটাই অধর্ম। শ্রীকৃষ্ণের এ উপদেশ কেবল অর্জুনের ক্ষেত্রেই নয়, সর্বকালের সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য— ধর্ম-বর্ণ-জাতি-শ্রেণী নির্বিশেষে। পারত্রিক জীবনের কথা বাদই দিলাম, জাগতিক জীবনেই এ উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনীয়।
ভগবান অর্জুনকে আরো বলেছেন, এ যুদ্ধ তুমি কেবল তোমার জন্য করছ না, করছ বৃহতের জন্য। ক্ষুদ্রতা বা ব্যষ্টির স্বার্থপরতার স্পর্শ না থাকলে কোনো কাজ দুষ্ট হয় না। সমষ্টির স্বার্থে তখন তা মহত্ত্ব লাভ করে। এর জন্য ত্যাগ প্রয়োজন। ত্যাগই ভোগের দরজা খুলে দেয়। সে ভোগ আনন্দের, সকলের। একলার ভোগ পরিণামে কষ্টদায়ক। কাজেই তুমি ওঠো, জাগো, যুদ্ধ করো, এ পৃথিবীকে সুন্দর করো, আনন্দময় করে তোলো, ‘তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ’।
ভগবানের এসব উপদেশ হূদয়ঙ্গম করে অর্জুনের মোহ কেটে যায়। সব রকমের দৌর্বল্য পরিহার করে তিনি যুদ্ধে ব্রতী হন। দুর্যোধনাদি দুষ্কৃতিকারীরা বিনাশপ্রাপ্ত হয়। পৃথিবী ভারমুক্ত হয়। ব্যষ্টি নয়, সমষ্টি অখণ্ড আনন্দ লাভ করে। ভগবান কার্য সমাপনান্তে স্বস্থানে গমন করেন।
‘ভক্তের ভগবান’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। এর একটি অর্থ হতে পারে— ভক্ত যেভাবে কামনা করে, ভগবান সেভাবেই তার কাছে ধরা দেন। ভগবান তখন ঘরের একজন হয়ে যান। ভক্তে আর ভগবানে কোনো অন্তর থাকে না। এরূপ ঘনিষ্ঠতায় ভালোবাসা জন্মে। ভালোবাসা পরস্পরকে প্রিয়তম করে। শ্রীকৃষ্ণ ভক্তদের কাছে তেমনই একজন। তাইতো মা যশোদার কাছে তিনি কানাই, গোপবালকদের কাছে তিনি গোপাল, গোপ-গোপীদের কাছে তিনি বল্লভ, সুদামার কাছে তিনি বয়স্য এবং অর্জুনের কাছে তিনি সখা। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্’— যে আমাকে যেভাবে পেতে চায়, আমি সেভাবেই তার বাসনা পূরণ করি। এজন্যই তাঁর প্রতি সবার ভক্তির চেয়ে ভালোবাসা অধিক। তাই রাম সবার ভক্তির ধন, আর শ্রীকৃষ্ণ ভালোবাসার ধন।
শ্রীকৃষ্ণ কথা প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত মূল্যবান ও বাস্তব কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ’— গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি চারটি বর্ণ সৃষ্টি করেছি। বর্ণ চারটি হলো— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রাহ্মণের গুণ ও কর্ম অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করা, ক্ষত্রিয়ের দেশ রক্ষা করা, বৈশ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজ করা এবং বাকি সব শূদ্রের কাজ। শ্রীকৃষ্ণের মতানুসারে এ গুণগুলোর যেটি যার মধ্যে থাকবে, সে সেই বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ, বর্ণ কর্ম অনুসারে, জন্ম অনুসারে নয়। আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও এরূপ পেশাগত শ্রেণীভেদ অনস্বীকার্য। একটি রাষ্ট্র বা সমাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে হলে এরূপ বর্ণবিন্যাস একান্ত আবশ্যক। এর কোনো বিকল্প নেই।
ভগবান স্বজনদের মৃত্যুতে ভীত না হওয়ার জন্য অর্জুনকে বলেছিলেন, জীবের মৃত্যু নেই। জীব অজর, অমর এবং শাশ্বত; শরীর বিনষ্ট হলেও এর বিনাশ নেই, ‘অজো নিত্যঃ শাশ্বতো য়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’ এটি ঔপনিষদিক দর্শনের কথা। কিন্তু এরও একটি প্রায়োগিক দিক আছে। দর্শনের চেয়ে তার মূল্য কম নয়। সেটি হলো আত্মদর্শন বা আত্মচেতনা লাভ। ভগবানের এ কথার অর্থ হলো— আমরা যাকে জীব বলি, উপনিষদের ভাষায় তাকে বলা হয় জীবাত্মা। এই জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক— সসীম আর অসীম।
প্রত্যেকের মধ্যেই জীবাত্মা আছে, যা পরমাত্মার অংশ। এই চেতনা লাভ হলে সে আর নিজেকে কারো চেয়ে ছোট বা ক্ষুদ্র মনে করবে না। তার মধ্যে কোনো সংকোচ বা হীনম্মন্যতা থাকবে না। সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। দৃঢ়চিত্তে আপনার অধিকার ব্যক্ত করবে। আবার একই আত্মা সবার মধ্যে বিরাজমান— এ কথা চিন্তা করে সে কাউকে আঘাতও করবে না। স্বামী বিবেকানন্দ নিজ দেশে অবহেলিত আমেরিকা প্রবাসী এক আইরিশ যুবকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে এই আত্মচেতনা লাভের কথাই বলেছিলেন। তিনি একেই বলেছিলেন ‘প্র্যাকটিকাল বেদান্ত’, যা মানুষকে ইহ জগতেই মোক্ষের সন্ধান দেয়।
ভগবান শ্রীগীতায় অর্জুনকে এসব কথা বলেছিলেন। তাই বিশাল মহাভারতের একটি অংশ হওয়া সত্ত্বেও গীতা স্বতন্ত্র দার্শনিক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। এজন্য গীতার মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে, ‘গীতা সুগীতা কর্তব্যা কিমন্যৈঃ শাস্ত্রবিস্তরৈঃ। যা স্বয়ং পদ্মনাভস্য মুখপদ্মাদ্বিনিঃসৃতা’
ড. দুলাল ভৌমিক
লেখক: অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরো পড়ুনঃ জন্মাষ্টমীর তাৎপর্য ও অবতার প্রসঙ্গ
সোর্সঃ সনাতন ধর্মতত্ত্ব