শ্রী শ্রী গিরি গোবর্ধন পূজা, অন্নকূট মহোৎসব ও এর ব্যাখ্যা

বৈদিক পঞ্জিকা অনুযায়ী, একটি চান্দ্র দিনকে তিথি বলে। চাঁদ ও সূর্যের মধ্যে ১২ ডিগ্রি দ্রাঘিমাকোণ বৃদ্ধির সময়কে একটি তিথির সময়কাল ধরা হয়। তিথির সূচনার সময় দিন অনুযায়ী বদল হয় এবং তিথির মোট সময়কাল অনেকক্ষণ ধরে ব্যাপ্ত থাকে। প্রতিপদ বা প্রথমা হল পক্ষের প্রথম তিথি। শুক্লপক্ষের প্রতিপদ শুক্লা প্রতিপদ এবং কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ কৃষ্ণা প্রতিপদ নামে পরিচিত। কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে উত্তর গোবর্ধন পূজা ও অন্নকূট উৎসব হয়। অন্ন+কূট শব্দের অর্থ অন্নকূট অর্থাৎ অন্নের পাহাড়।

যা আসল পুরাণ শ্রীমদ্ভগবতে বিধৃত লীলাদির প্রভূত রস আস্বাদন করেছেন বৈষ্ণব আচার্যগণ। লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভৌম লীলায় অনেক চমকপ্রদ লীলা প্রদর্শন করেন। শ্রীল জীব গোস্বামী তার গোপাল চম্পু গ্রন্থে নন্দ মহারাজের বক্তব্য হচ্ছে, ‘বৈশ্য গোপ জাতি। কৃষি এবং গো-পালন আমাদের জীবিকা। গো-পালনের জন্য আমাদের ঘাসের প্রয়োজন। চাষের জন্য বৃষ্টি চাই।

শিশু কৃষ্ণ ও গিরিরাজ গোবর্ধনঃ

শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে যে, দৃঢ বিশ্বাসের সঙ্গে কৃষ্ণভক্ত জানেন যে, ভক্তিসহকারে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা হলে আর কোন কিছুই করণীয় থাকে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্তকে কোন রকম বৈদিক শাস্ত্র নির্দেশ অনুসারে কোন আচার-অনুষ্ঠান করতে হয় না। অথবা কোন দেব-দেবীর পূজা করতে হয় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত হওয়ার ফলে তিনি সব রকমের বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছেন এবং তাঁর সমস্ত দেব-দেবীর পূজা করা হয়ে গেছে। বৈদিক শাস্ত্রনির্দেশ অনুসারে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান করে অথবা দেব-দেবীর পূজা করে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিলাভ হয় না, কিন্তু কেউ যখন সম্পূর্ণভাবে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যুক্ত হন, তখন সমস্ত বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান আপনা থেকেই সম্পাদিত হয়ে যায়।

এ কথার আলোকে শরতের ঠিক মাঝামাঝি কার্তিক মাস, এ সময় ব্রজবাসীরা এক বিশেষ অনুষ্ঠানের অয়োজন করে। যা গোবর্দ্ধন পূজা ও অন্নকূট মহোৎসব নামে খ্যাত। আজ গোবর্দ্ধন পূজা অন্নকুট মহোৎসব। অন্নকূট প্রধানত বৈষ্ণবদের উৎসব হলেও অনেক শাক্ত পরিবারে ও মন্দিরে এর চল আছে। শ্রীমদ্ভগবত গীতার দশম স্কন্ধের নবম ও দশম অধ্যায়ে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত বশ্যতা স্বীকার স্বরূপ দাস বন্ধন লীলা বর্ণিত হয়েছে। এ পুজোর পিছনে রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনি।

বৃন্দাবনবাসীরা ৫৬ রকম পদের ভোগ দিয়ে বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রের পুজো করত। বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠান-পরায়ণ ব্রাহ্মণপত্নীদের কৃপা করার পর, কৃষ্ণ ও বলরাম একদিন দেখলেন যে, গোপেরা দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তুষ্টিবিধানের জন্য সেই রকমই এক যজ্ঞের আয়োজন করছেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের এই ধরনের সমস্ত কার্যকলাপ বন্ধ করতে আদেশ দিলেন, কেননা তিনি বৃন্দাবনে প্রকটকালে অত্যন্ত দৃঢতার সঙ্গে তাঁর প্রতি অনন্য ভক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। গোপেরা যে ইন্দ্রযজ্ঞের আয়োজন করেছিল, তা শ্রীকৃষ্ণ তা জানতে পেরেছিলেন, কেননা তিনি হচ্ছেন সর্বদ্রষ্টা। কিন্তু সৌজন্যতার বশে তিনি শ্রদ্ধা সহকারে এবং বিনম্রভাবে মহারাজ নন্দ এবং অন্যান্য বয়স্ক গোপদের জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন যে, কিসের আয়োজন করা হচ্ছে।

শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পিতাকে জিজ্ঞসা করেন, “হে পিতঃ, এটা কোন্ যজ্ঞের আয়োজন করা হচ্ছে? এই যজ্ঞের ফলে কি হয় এবং কার উদ্দেশ্যে এই যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে ? কিভাবে এই যজ্ঞ করা হবে ? আপনি কি দয়া করে তা আমাকে বলবেন ? তা জানতে আমি অত্যন্ত উৎসুক, তাই দয়া করে এই যজ্ঞের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমাকে বলুন।” কৃষ্ণ তাঁকে এইভাবে জিজ্ঞাসা করলে তাঁর পিতা নন্দ মহারাজ চুপ করে রইলেন, কেননা তিনি মনে করলেন যে, তাঁর শিশুপুত্রটি এই যজ্ঞ অনুষ্ঠানের জটিলতা বুঝতে পারেব না। কৃষ্ণ তখন নাছোড়বান্দার মতো তাঁকে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন,” হে পিতঃ, যাঁরা উদারচেতা এবং সৎ প্রকৃতির মানুষ, তাঁরা কোন কিছুই গোপন করেন না। তাঁরা সকলের প্রতিই উদারভাবাপন্ন। আর যাঁরা ততটা উদার নন, তাঁরা ও আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবের কাছে কোন কিছু গোপন করেন না, যদিও শত্রুভাবাপন্ন মানুষদের কাছে তাঁরা কোন কিছু গোপন রাখতে পারেন। তাই আমার কাছে কিছু গোপন করা আপনার উচিত নয়। সমস্ত মানুষই তাদের কর্ম অনুসারে ফল ভোগ করছে। তাদের কেউ তাদের কৃতকর্ম এবং তার ফল সম্বন্ধে অবগত, আর কেউ তাদের কর্মের উদ্দেশ্য অথবা ফল সম্বন্ধে কিছু না জেনেই কর্ম করে যাচ্ছে। যে মানুষ পূর্ন জ্ঞান সহকারে কর্ম করেন, তিনি পূর্ণ ফল প্রাপ্ত হন; কিন্তু যাঁরা না জেনে কর্ম করছেন, তাঁরা পূর্ণ ফল ভোগ করতে পারেন না। তাই দয়া করে আমাকে বলুন আপনারা যে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে চলেছেন তার উদ্দেশ্য কি ? তা কি বৈদিক নির্দেশ অনুসারে সম্পদিত হচ্ছে। না কি, এটা কেবল একটা জনপ্রিয় উৎসব ? দয়া করে আমাকে সবিস্তারে এই যজ্ঞ সম্বন্ধে বলুন” কৃষ্ণ এইভাবে প্রশ্ন করতে থাকেলে

নন্দ মহারাজ উত্তর দিলেন, ” কৃষ্ণ , এই যে অনুষ্ঠান করা হচ্ছে , তা একটা প্রচলিত প্রথা। যেহেতু মেঘেরা হচ্ছে ইন্দ্রের প্রতিনিধি, তাই ইন্দ্রের কৃপার ফলেই বৃষ্টি হয় আর আমাদের জীবন ধারণের জন্য জল এত প্রয়োজনীয় যে বৃষ্টির নিয়ন্তা ইন্দ্রের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা কর্তব্য। তাই আমরা দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য এই যজ্ঞের আয়োজন করেছি, কেননা তিনি কৃপা করে আমাদের যথেষ্ট বৃষ্টিদান করেন, যার ফলে আমরা ফসল উৎপাদান করতে সক্ষম হই। আমাদের জীবনে জল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়; জল ছাড়া আমরা কৃষিকার্য করতে পারি না অথবা শস্য উৎপাদন করতে পারি না। যদি বৃষ্টি না হয় তা হলে আমরা জীবনধারণ করতে পারি না তাই যথাযথভাবে ধর্ম-অনুষ্ঠান করা জন্য, অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করার জন্য এবং অবশেষে মোক্ষলাভের জন্য জল অপরিহার্য। তাই চিরাচরিত প্রথায় এই যে অনুষ্ঠান চলে আসেছে তা বন্ধ করা উচিত নয়; আমরা যদি কাম, লোভ বা ভয়ের বশবর্তী হয়ে তা বন্ধ করে দিই, তা হলে তা ভাল দেখাবে না।

“সেই কথা শুনে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পিতা এবং বৃন্দাবনের সমস্ত গোপদের এমন কতকগুলো কথা বললেন, যাতে দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি বললেন, এই যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার কোনো প্রয়োজন নেই। ইন্দ্রের প্রীতি সাধনের জন্য এই যজ্ঞ না করার তিনি দুটি কারণ দেখালেন। প্রথম কারণ, যা ভগবদ্গীতাতেও বলা হয়েছে, পার্থিব উন্নতি সাধনের জন্য কোন দেব-দেবীর পূজা করার প্রয়োজন নেই, দেব-দেবীদের পূজা করে যে ফল হয়, তা ক্ষণস্থায়ী, এবং অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল এই ধরনের ক্ষণস্থায়ী ফল লাভে উৎসাহী দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত অনিত্য ফল এই সমস্ত দেব-দেবীদের পূজা করে লাভ হয়, তা পরমেশ্বর ভগবানের আদেশ অনুসারেই তারা মঞ্জুর করে থাকেন। ভগবদগীতায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘ময়ৈব বিহিতান্ হি তান্’- দেবতাদের কাছ থেকে যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা লাভ হয়ে থাকে, তা প্রকৃতপক্ষে পরমেশ্বর ভগবানই প্রদান করেন। পরমেশ্বর ভগবানের আদেশ ছাড়া কেউই কোন কিছু দিতে পারেন না। কিন্তু মাঝে মাঝে জড়া প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেবতারা নিজেদের সর্বেসর্বা বলে মনে করে গর্বান্বিত হয়ে পড়েন এবং পরমেশ্বর ভগবানের পরম ঈশ্বরত্বের কথা ভুলে যান। শ্রীমদ্ভাগবতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এখনে শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছা করে ইন্দ্রের ক্রোধ উৎপাদন করেতে চেয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ এই জগতে অবতরণ করেন অসুরের বিনাশ করবার জন্য এবং ভক্তদের পরিত্রাণ করবার জন্য। দেবরাজ ইন্দ্র অবশ্যই অসুর ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভক্ত, কিন্তু তিনি গর্বান্বিত হয়ে পড়েছিলেন বলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে একটু শিক্ষা দেওয়ার আয়োজন করেছিলেন। তিনি প্রথমে বৃন্দাবনের গোপেদের আয়োজিত ইন্দ্রপূজা বন্ধ করে তাঁকে খুব রাগিয়ে দিয়েছিলেন।

মনে মনে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে কৃষ্ণ গোপেদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন তিনি কর্মমীমাংসা সমর্থনকারী একজন নাস্তিক । এই ধরনের দার্শনিকেরা পরমেশ্বর ভগবানের পরম আধিপত্য স্বীকার করেন না। তারা যুক্তি প্রদান করেন যে, কেউ যখন ভালভাবে কর্ম করে তখন অবশ্যই তারা তার ফল লাভ করে। তাদের মত হচ্ছে যে, যদি ভগবান বলে কেউ থেকে থাকেন, যিনি মানুষের কর্ম অনুসারে ফল প্রদান করেন, তা হলে তাঁকে পূজা করার কোন কারণ নেই। কেননা মানুষ যদি কর্ম না করে তা হলে তিনি কোন শুভ ফল প্রদান করতে পারেন না। তারা বলেন, মানুষের কতর্ব্য হচ্ছে দেবতা অথবা ভগবানের পূজা না করে নিষ্ঠা সহকারে কর্তব্যকর্ম করা এবং তা হলে তার শুভ ফল অবশ্যই লাভ হবে। শ্রীকৃষ্ণ এই কর্মমীমাংসা দর্শনের তত্ত্ব অনুসারে তাঁর পিতার সংগে কথা বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, ” হে পিতঃ, আপনার কৃষিকার্যের সাফল্যের জন্য কোন দেবদেবতার পূজা করার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। প্রতিটি জীবই তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে জন্মগ্রহণ করে এবং বর্তমান কর্মের ফল নিয়ে এই দেহ ত্যাগ করে। প্রতিটি জীবই তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন শরীর প্রাপ্ত হয় এবং এই জন্মের কর্ম অনুসারে তার পরবর্তী জন্ম লাভ করে। বিভিন্ন ধরনের জাগতিক সুখ এবং দুঃখ , স্বাচ্ছন্দ্য এবং দুর্দশা, পূর্ব জীবনের অথবা বর্তমান জীবনের বিভিন্ন রকমের কর্মের ফল। ”

মহারাজ নন্দ এবং অন্যান্য গোপবৃদ্ধরা যুক্তি দেখালেন যে, আমরা বৈশ্য গোপ জাতি। কৃষি এবং গো-পালন আমাদের জীবিকা। গো-পালনের জন্য আমাদের ঘাসের প্রয়োজন। চাষের জন্য বৃষ্টি চাই। দেবতাদের সন্তুষ্ট না করে কেবলমাত্র কর্ম করা মাধ্যমে শুভ-ফল লাভ করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে সেই কথাটি ঠিকই যেমন, অনেক সময় দেখা যায় যে, খুব ভাল ডাক্তারের দ্বারা চিকিৎসা করা সত্ত্বেও এবং খুব ভাল ওষুধ খাওয়ানো সত্ব্বেও রোগীর মৃত্যু হয়। এর থেকে বোঝা যায় যো, খুব ভাল ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করানো এবং ভাল ওষুধ খাওয়ানোটাই রোগমুক্ত হওয়ার কারণ নয়; পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবানের ইচ্ছাই হচ্ছে মূল কারন । তেমনই, সন্তানের প্রতি মা-বাবার যত্ন নেওয়াটাই সন্তানের সুখ-স্বচ্ছন্দ্যের কারণ নয়। অনেক সময় দেখা গেছে যে, পিতা-মাতাদের যথেষ্ট তত্ত্বাবধান সত্ত্বে ও সন্তানেরা বিপথগামী হয়ে গেছে অথবা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। তাই জড় কারণগুলিই ফললাভের পক্ষে যথেষ্ট নয়। পরমেশ্বর ভগবানের অনুমোদন না থাকলে কোন কিছুই সফল হয় না। মহারাজ নন্দ তাই সেই নীতি সমর্থন করে বললেন যে, কৃষিকার্যে সুফল লাভ করতে হলে অবশ্যই বৃষ্টির নিয়ন্ত্রণকারী দেবতা ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করতে হবে। এই যুক্তি খন্ডন করে শ্রীকৃষ্ণ বললেন যে, দেবতারা মানুষকে তার কর্ম অনুসারে ফল দান করে থাকেন। কেউ যদি যথাযথভাবে তার কতর্ব্যকর্ম না করে, তা হলে দেবতারা তাকে কোন রকম সুফল দান করতে পারেন না; তাই দেবতারা মানুষের কতর্ব্যকর্মের অধীন। যে কোন মানুষকে তাদের ইচ্ছমতো ফলদান করতে দেবতারা পারেন না।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ” হি পিতঃ, ইন্দ্রদেবতার পূজা করার কোন প্রয়োজন নেই। প্রত্যেককেই তার কর্ম অনুসারে ফল লাভ করতে হয়। আমরা দেখতে পাই যে, প্রকৃতপক্ষে সকলেই তাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে কর্মে লিপ্ত হয়; এবং সেই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে মানুষই হোক্ বা দেবতাই হোক্, প্রত্যেকে যথাযথ ফল ভোগ করে থাকেন। প্রতিটি জীবই উচ্চতর বা নিম্মতর দেহ প্রাপ্ত হয় এবং তাদের বিভিন্ন কর্ম অনুসারে, শত্রু, মিত্র বা নিরপেক্ষ ভাব অর্জন করে। তাই খুব সাবধানতার সঙ্গে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া উচিত এবং বিভিন্ন দেব-দেবীদের পূজা করে চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করা উচিত নয়। যথাযথভাবে কর্তব্যকর্ম সম্পদন করা হলে দেব-দেবীরা আপনা থেকেই সন্তুষ্ট হবেন। তাই তাঁদের আলাদা করে পূজা করার কোন প্রয়োজন নেই। তাই, আমাদের কর্তব্য হচ্ছে খুব ভালভাবে আমাদের কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করা। প্রকৃতপক্ষে, যথাযথভাবে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন না করে কেউই সুখী হতে পারে না, তাই যে যথাযথভাবে তা কতর্ব্য করে না, তাকে অসতী স্ত্রীলোকের সঙ্গে তূলনা করা হয়। ব্রাহ্মনদের কর্তব্যকর্ম হচ্ছে বেদ পাঠ করা, ক্ষত্রিয়ের কর্তব্যকর্ম হচ্ছে প্রজাপালন করা, বৈশ্যের কতর্ব্যকর্ম হচ্ছে কৃষি, গোরক্ষা, বাণিজ্য, এবঙ শুদ্রের কর্তব্যকর্ম হচ্ছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের সেবা করা। আমরা বৈশ্য, তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে কৃষিকার্য করা অথবা সেই কৃষিজাত দ্রব্য নিয়ে বাণিজ্য করা, গোরক্ষা কর, এবং টাকা ধার দেওয়া ।”

কৃষ্ণ বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত বলে নিজের পরিচয় দিলেন, কেননা নন্দ মহারাজ গো-পালন করতেন এবং কৃষ্ণ তাঁদের পরিচর্যা করতেন। বৈশ্যদের জন্য তিনি চার রকমের বৃত্তি প্রদর্শন করলেন যথা, কৃষি, বাণিজ্য, গোরক্ষা এবং টাকা ধার দেওয়া। যদি ও বৈশ্যরা এর যে কোন ও একটি বৃত্তি গ্রহণ করেত পারেন, কিন্তু ব্রজবাসীরা গোরক্ষা কার্যেই যুক্ত ছিলেন।

কৃষ্ণ তাঁর পিতাকে আরো বোঝালেন, “এইজড় জগৎ সত্ত্ব, রজ এবং তম, প্রকৃতির এই তিনটি গুণের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই তিনটি গুণ হচ্ছে সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের কারন। রজোগুণের প্রভাবে মেঘ উৎপন্ন হয় ; তাই বৃষ্টির কারণ হচ্ছে রজোগুণ। এই বৃষ্টি হওয়ার ফলে মানুষ তার কৃষিকার্যে সাফল্য লাভ করে। সমুদ্রের মাঝেও বৃষ্টি হয়। সেখানে কেউ ইন্দ্র পূজা করেন না। তা হলে এই ব্যাপারে ইন্দ্রের কি করণীয় আছে ? আপনি যদি ইন্দ্রের সন্তুষ্টি বিধান নাও করেন, তা হলে তিনি কি করতে পারেন ? আমরা ইন্দ্রের কাছ থেকে বিশেষ ফল পাচ্ছি না। তিনি যদি বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করতেন, তা হলে সমুদ্রের বুকে কেন বৃষ্টি হয় যেখানে জলের কোন প্রয়োজন নেই । সমুদ্রে এবং জমিতে সব জায়গাতেই বৃষ্টি হচ্ছে; তা ইন্দ্রকে পূজা করার উপর নির্ভর করে না। আমাদের অন্য কোন শহর বা গ্রামে বা বিদেশে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। শহরে অনেক রাজকীয় প্রাসাদ আছে, কিন্তু আমরা এই বৃন্দাবনের বনে বাস করেই সুখী। গোবর্ধন পর্বত এবং বৃন্দাবনের বনের সংগে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের জীবিকা যে গো-পালন, গাভী বর্ধনের জন্য আমরা গোবর্ধনের কাছে ঋণী। ইন্দ্রের কাছে নয়। চলো আমরা গোবর্ধনের পূজা করি। তাই আমি আপনাদের অনুরোধ করব, আপনারা এমন এক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করুন যাতে স্থানীয় ব্রাহ্মণেরা এবং গোবর্ধন পর্বত সন্তুষ্ট হন। ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে করণীয় আর আমাদের কিছুই নেই।

শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে নন্দ মহারাজ বললেন, “কৃষ্ণ, তুমি যখন বলছ তখন আমি নিশ্চয়ই স্থানীয় ব্রাহ্মণ এবং গোবর্ধন পর্বতের উদ্দেশ্য আলাদা একটা যজ্ঞের আয়োজন করব। কিন্তু এখন আমরা ইন্দ্রযজ্ঞ সম্পাদন করি”কৃষ্ণ বললেন, ” হে পিতঃ, দেরি করার আর প্রয়োজন নেই। গোবর্ধন পর্বত এবং স্থানীয় ব্রাহ্মনদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে অনেক সময় লাগবে। তাই ইন্দ্রযজ্ঞের জন্য যে আয়োজন করা হয়েছে তা দিয়ে এখনই গোবর্ধন পর্বত এবং স্থানীয় ব্রাহ্মনদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যজ্ঞ করলে ভাল হবে।”

মহারাজ নন্দ অবশেষে রাজী হলেন। গোপেরা তখন কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন কিভাবে তিনি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে চান, এবং কৃষ্ণ তাঁদের বললেন, ” যজ্ঞের জন্য সংগৃহীত সমস্ত শস্য এবং ঘি দিয়ে খুব ভাল ভাল নানা রকমের খাবার তৈরি করা হোক। পুষ্পান্ন, ডাল, হালুয়া, পকোরা, পুরী, মিষ্টান্ন, রসগোল্লা, সন্দেশ, লাড্ডু, ইত্যাদি তৈরি করা হোক, এবং সমস্ত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করা হোক্ । যাঁরা বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে এবং অগ্নিতে আহুতি প্রদানে সুদক্ষ। সেই সমস্ত ব্রাহ্মণদের নানা করম শস্য দান করা হোক। গাভীদের খুব সুন্দর সজ্জায় ভূষিত করা হোক। এবং তাদের খুব ভাল করে খাওয়ানো হোক। তার পর ব্রাহ্মণদের অর্থদান করা হোক্। সমাজের নিম্মস্তরের চন্ডাল আদি মানুষদের , যাদের সাধারণ লোক অস্পৃশ্য বলে মনে করে, তাদের ও প্রচুর পরিমাণে প্রসাদ দেওয়া হোক্। গাভীদের তৃণ প্রদান করে গোবর্ধন পর্বতের পূজা উপহার প্রদান করা হোক্। এই পূজা হলে আমি অত্যন্ত তৃপ্ত হব।”

এখানে শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত বৈশ্য সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ভিত্তি বর্ণনা করেছেন। মাবন-সমাজের প্রতিটি সম্প্রদায়ে এবং গাভী, কুকুর, ছাগল ইত্যাদি পশু সম্প্রদায়ে ও সকলেরই একটা বিশেষ স্থান রয়েছে। সকলেরই কতর্ব্য হচ্ছে যৌথ ভাবে সমস্ত সমাজের মঙ্গলসাধনের জন্য কাজ করা। এই কথা কেবল সচেতন প্রাণীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়; বন পর্বত আদি অচেতন পদার্থকেও বিবেচনা করে। ফসল উৎপাদন করে গো-পালন করে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করে, বাণিজ্য করে, এবং ঋণদান করে সমাজের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করার দায়িত্বভার বিশেষ করে বৈশ্য সম্প্রদায়ের উপর অর্পিত হয়েছে।

এর থেকে আমরা এটাও বুঝতে পারি যে, কুকুর, বেড়াল ইত্যাদি পশুদের যদিও খুব একটা প্রয়োজনীয়তা নেই, তবুও তাদের অবহেলা করা উচিত নয়। তাদের রক্ষা করাও মানুষের কতর্ব্য। তবে অবশ্য কুকুর, বেড়াল রক্ষা করার থেকে গাভীদের রক্ষা করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ; এবং এখানে আমরা আরেকটা ইঙ্গিত দেখতে পাই যে, চন্ডাল বা সমাজের যারা অস্পৃশ্য, তাদের ও অবহেলা করা উচিত নয়। সকলেরই যথাযথ প্রয়োজনীয়তা আছে, তবে কেউ সরাসরিভাবে মানব-সমাজের উন্নতিসাধনের জন্য যুক্ত, আর কেউ পরোক্ষভাবে যুক্ত। কিন্তু সমাজ যখন কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ওঠে ,তখন সকলেই সুখ-স্বচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বসবাস করতে পারে।

আমাদের কৃষ্ণভাবনাময় সমাজে গোবর্ধন পূজার অনুষ্ঠান করা হয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নির্দেশ দিয়ে গেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ যেমন আরাধ্য তেমন তাঁর ধাম বৃন্দাবন এবং গোবর্ধন পর্বত ও আরাধ্য। এই উক্তির সত্যতা প্রতিপন্ন করে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, গোবর্ধন পূজা তাঁকে পূজা করারই মতো। সেই দিন থেকে এখনো অন্নকুট নামক এই গোবর্ধন পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বৃন্দাবনে এবং বৃন্দবানের বাইরে মন্দিরগুলিতে এই উপলক্ষ্যে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত করা হয় এবং গিরিরাজ গোবর্ধনকে উৎসর্গ করার পর তা জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। মাঝে মাঝে এই প্রসাদ ছুঁডে দেওয়া হয় এবং উপস্থিত ভক্তরা মাটি থেকে কুডিয়ে সেই প্রসাদ উপভোগ করেন। এর থেকে বোঝা যায় যে, শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদিত প্রসাদ কখনো দুষিত বা কলুষিত হয় না, এমন কি মাটিতে ছুঁডে দিলে ও নয়। তাই মানুষ মাটি থেকে তা কুড়িয়ে নিয়ে গভীর তৃপ্তি সহকারে তা সেবন করেন।

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই বৃন্দাবনের গোপেদের উপদেশ দিলেন ইন্দ্রযজ্ঞ বন্ধ করে গোর্বধন পূজা শুরু করতে। নন্দ মহারাজের নেতৃত্বে সরলচিত্ত গোপেরা কৃষ্ণের এই প্রস্তাব মেনে নিলেন এবং তাঁরা গিরি গোবর্ধন পূজা করলেন এবং তাঁকে প্রদক্ষিণ করলেন। গোবর্ধন পূজার সময়ে বৃন্দাবনবাসীরা এখনো খুব সুন্দরভাবে সজ্জিত হয়ে গোবর্ধন পর্বতের সামনে সমবেত হয়ে গিরিরাজের পূজা করেন এবং তারপর গাভীসহ তাঁকে প্রদক্ষিণ করেন। শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে নন্দ মহারাজ এবং গোপেরা বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করে এনেছিলেন এবং বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে এবং নানা রকমের ভোগ নিবেদন করে গোবর্ধন পূজা করেছিলেন। সেই পূজার ভোগের উপাচার অন্নের পাহাড়ের রূপ ধারণ করে। অন্নের পাহাড়টি গোবর্দ্ধনকে নিবেদন করা হয়। উপস্থিত সবাই দেখলো এক দিকে সাত বছর বয়সী ছোট কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে, অপরদিকে এক বিশাল শ্রীকৃষ্ণ অন্ন ভোজন করছেন। সমস্ত ব্রজবাসীরা তখন সমবেত হয়ে তাদের গাভীদের নানা অলঙ্কারে ভূষিত করে তৃণ দান করেছিলেন। তারপর গাভীদের সামনে রেখে তাঁরা গোবর্ধন পর্বত পরিক্রমা করেছিলেন। ব্রজগোপিকারা মূল্যবান রত্ন অলঙ্কারে ভূষিতা হয়ে গরুর গাড়িতে বসে শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করেছিলেন। সমবেত ব্রাহ্মণেরা গোবর্ধন পূজা করে সমস্ত ব্রজবাসীদের আর্শীর্বাদ করেছিলেন। সমস্ত অনুষ্ঠান যথাযথভাবে সম্পন্ন হলে, শ্রীকৃষ্ণ এক বিরাট দিব্য রূপ ধারণ করে বৃন্দাবনের অধিবাসীদের কাছে ঘোষণা করলেন যে, তিনিই হচ্ছেন গোবর্ধন পর্বত, যাতে তাঁর ভক্তদের চিত্তে কোন সংশয় না থাকে যে, গোবর্ধন পর্বত এবং তিনি অভিন্ন। তারপর কৃষ্ণ সমস্ত নৈবেদ্য ভোজন করতে লাগলেন। কৃষ্ণ ও গোবর্ধন পর্বতের অভিজ্ঞতা ভক্তরা শ্রদ্ধা সহকারে এখনো মেনে আসছেন। আজো কৃষ্ণভক্তরা গোবর্ধন শিলাকে অভিন্ন কৃষ্ণজ্ঞানে মন্দিরে পূজা করে আসছেন। ভক্তরা তাই গোবর্ধন পর্বত থেকে ক্ষুদ্র শিলা নিয়ে এসে তাঁদের গৃহে পূজা করেন, কেননা এই পূজা শ্রীকৃষ্ণের শ্রীবিগ্রহের পূজারই মতো। যে রূপ পরিগ্রহ করে শ্রীকৃষ্ণ নৈবেদ্য ভোজন করছিলেন, সেই রূপ ছিল ভিন্ন, এবং কৃষ্ণ নিজে অন্য সমস্ত ব্রজবাসীদের সংগে সেই বিগ্রহকে এবং গোবর্ধন পর্বতকে প্রণাম করতে লাগলেন। তাঁর সেই বিরাট রূপকে এবং গোবর্ধন পর্বতকে প্রণাম জানিয়ে কৃষ্ণ ঘোষণা করলেন, ” দেখ, গোবর্ধন পর্বত কেমন এই বিরাট রূপ ধারণ করেছেন এবং সমস্ত নৈবেদ্য গ্রহণ করে আমাদের কৃপা করছেন ” সেই সভায় কৃষ্ণ আরো ঘোষণা করলেন, ” যে এই গোবর্ধন পূজার অবহেলা করবে, যা আমি নিজে অনুষ্ঠান করছি, সে কখনো সুখী হবে না। এই গোবর্ধন পর্বতে অনেক বিষধর সর্প আছে এবং যারা এই গোবর্ধন পূজার অবহেলা করবে তারা সেই সর্প দংশনে প্রাণত্যাগ করবে। তাদের গাভী এবং তাদের নিজেদের সৌভাগ্যের জন্য গোবর্ধন পর্বতের সন্নিকটস্থ সমস্ত বৃন্দাবনবাসীরা যেন অবশ্যই এই গোবর্ধন পূজা করে, যা আমি প্রচলন করলাম।”

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন বৃন্দাবনের গোপেদের উপদেশ দিলেন ইন্দ্রযজ্ঞ বন্ধ করে গোর্বধন পূজা শুরু করতে তখন স্বর্গের রাজা দেবতা ইন্দ্র রেগে গেলেন। এবং বৃন্দাবনের উপরে মুষলধারে বর্ষণ করেন। তখন সবাই শ্রীকৃষ্ণ কে দোষারোপ করা শুরু করলেন। কেন যে এই ছোট বয়সের এক ছেলের কথা তাঁরা শুনলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্রের ক্ষোভের সম্মুখীন হলেন!!! শ্রীকৃষ্ণের বয়স ছিল ন্যুনধিক তিন বছর চার মাস। প্রবল বর্ষণের ফলে সম্পূর্ণ বৃন্দাবন পানির নিচে তলিয়ে যায়। তখন শ্রী কৃষ্ণ গিরিরাজ গোবর্ধন কে প্রণাম করে সহায়তা চাইলেন। এবং বৃন্দাবনবাসীদের ওই বিপদ থেকে রক্ষার জন্য কৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বতকে বৃন্দাবনের উপরে ছাতার মতো করে ধরে থাকেন।

তখন ইন্দ্র ও শ্রী কৃষ্ণের মধ্যে যুদ্ধারম্ভ হল। যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট দেবরাজ ইন্দ্র পরাজিত হন। অহংকারী ইন্দ্ররাজ লজ্জিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ পদে আত্মনিবেদন করলেন। তার পর থেকে কৃষ্ণের নির্দেশে বৃন্দাবনবাসী কার্তিক মাসে অমাবস্যার পরদিন ‘গিরি গোবর্ধন’-এর পুজো আরম্ভ করে। সেই পুজোই অন্নকূট উৎসব।

কলকাতার অনেক মন্দির ও পরিবারে অন্নকূট উৎসব হয়। সেগুলির মধ্যে সব থেকে বড় উৎসব হয় বাগবাজারের মদনমোহন মন্দিরে। বাগবাজার-কুমোরটুলি এলাকার মদনমোহনতলা অঞ্চলে মদনমোহন ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা গোকুলচন্দ্র মিত্র। ১৭৬১তে গোকুলচন্দ্র তাঁর এক বিঘারও বেশি জায়গা নিয়ে তৈরি বাড়ির দোতলায় কুলদেবতা ‘মদনমোহন’-এর জন্য ‘দরবার কক্ষ’ (মন্দির) তৈরি করলেন। একতলায় তৈরি হল ঠাকুরদালান ও নাটমন্দির। কার্তিক মাসের শুক্লা-প্রতিপদ তিথিতে নাটমন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় অন্নকূট উৎসব। প্রায় ৪০০ কিলোগ্রাম চালের ভাত-সহ ১৫৭ রকম পদ তৈরি হয়। পুজো শেষে ভক্তদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয় ওই অন্নভোগ।

সোনারপুর খড়িগাছি অঞ্চলের ঊনপঞ্চাশ বছরের প্রাচীন কালী শিবগুরু মঠেও অনুষ্ঠিত হয় অন্নকূট উৎসব। উৎসবের দিন পিতলের পরাতে প্রায় আড়াই মণ চালের ভাত দেওয়া হয় ভোগ হিসেবে। চুড়ো করে সাজানো ভাতের গায়ে সব্জি দিয়ে কালীর মুখ আঁকা হয়। সঙ্গে থাকে ১৫৫ রকম নিরামিষ পদ। প্রায় পঁচিশ বছর আগে শ্যামপুকুরের বলরাম ঘোষ স্ট্রিটের বাড়িতে অন্নপূর্ণা মূর্তি ও শ্রীধর (শালগ্রাম শিলা) স্থাপন করেন ভূপতি ভট্টাচার্য। অন্নকূট উৎসবে ১১৫ রকম রান্না করা পদ ও ১২০ রকম মিষ্টান্ন দেওয়া হয়। এখানে মোচা, থোড়, কুমড়ো ইত্যাদি সব্জি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পদের পাশাপাশি ভোগ হিসেবে ফুচকা, আইসক্রিম, কোল্ড-ড্রিংকসও দেওয়া হয়। ভট্টাচার্যবাড়ির অন্নকূটে জাতিভেদ মানা হয় না, যে কোনও বর্ণের মানুষ এসে রান্না করতে পারেন। রানি রাসমণির কন্যা জগদম্বাদেবী ১৮৭৫-এ ব্যারাকপুর তালপুকুরের অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ওই মন্দিরে অন্নকূট উৎসব হয় অন্নপূর্ণাপুজোর দিনে। ওই দিন সকালে মূল পুজো, কুমারীপুজো ও হোমের পরে হয় অন্নকূট। একুশ কিলোগ্রাম চালের ভাত-সহ ৫১ রকম পদ দেওয়া হয় ভোগ হিসেবে।

ত্রেতাযুগের গিরিগোবর্ধনঃ

শ্রীকৃষ্ণের গিরি গোবর্ধন কে এক আঙ্গুলীতে তুলে নেওয়ার আরো একটি কারণ পাওয়া যায় পৌরাণিক কাহিনিতে। ত্রেতা যুগে মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ সহ ১৪ বছরের বনবাসে গেলেন। তখন দুষ্টু রাবণ সীতাকে অপহরণ করে লংকাতে নিয়ে যায়। অপহৃত হওয়ার পর হনুমান যখন সীতার খোঁজ নিয়ে আসলেন তারপর সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাম; লক্ষ্মণ, হনুমান ও অন্যান্য অনেক বানর সেনা নিয়ে লংকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। সমুদ্র অতিক্রম করার জন্য বিশ্বকর্মা পূত্র নল সমুদ্রের উপরে পাথর দিয়ে সেতু নির্মান করতেছিলেন। তখন পাথর কম পড়বে মনে করে হনুমান অনেক পাহাড় কে একত্রিত করে এই রামসেতু তৈরীতে ভূমিকা রাখেন।

এরপর যখন রামসেতু তৈরী করার জন্য এরকম ভাবে গোবর্ধন পর্বত কে হনুমান উত্তোলিত করতেছিলেন তখন গোবর্ধন পর্বত একটা শর্ত দিয়েছিলেন; “যেন তাঁকে ভগবানের সেবা সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সুযোগ দেয়া হয়।” হনুমান তখন হঠাৎ করে খোঁজ পেলেন যে রামসেতু তৈরী করা হয়েগেছে। তখন হনুমান গোবর্ধন পর্বত কে বর্তমান স্থানে স্থাপিত করে দেন। পথিমধ্যে হনুমান গোবর্ধন পর্বত কে নামিয়ে রাখায় গোবর্ধন পর্বত ভগবান রামচন্দ্রের সন্তুষ্টি অর্জনের সুযোগ না পাওয়ায় হনুমান কে দোষারোপ করতে শুরু করেন। তখন হনুমান গোবর্ধন পর্বত এর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে তাঁকে যেন ভগবান সেই সুযোগ করে দেন এর ব্যবস্থা তিনি করবেন। তখন হনুমান ভগবান রামচন্দ্রকে পুরো ঘটনা টা খুলে বললেন। রামচন্দ্র তখন হনুমান কে আশ্বস্থ করলেন যে তিনি হন্নুমানের কথা বাস্তবায়ন করবেন। এবং দ্বাপর যুগে যখন জন্মনিবেন তখন গোবর্ধন পর্বত সেই শর্ত পূরণ করবেন। দ্বাপর যুগে ভগবান রামকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করার পর গিরিগোবর্ধন কে এক আংগুলীতে তুলে ধররেন। এবং গিরিগোবর্ধনের ইচ্ছাটাও পূরণ হলো।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.