শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব
পরিচিতি পর্ব
ঊনবিংশ শতকের এক প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি যোগসাধক,দার্শনিক ও ধর্মগুরু। তার প্রচারিত ধর্মীয় চিন্তাধারায় রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন তার প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ।তারা উভয়েই বঙ্গীয় নবজাগরণের এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর হিন্দু নবজাগরণের অন্যতম পুরোধাব্যক্তিত্ব। তার শিষ্যসমাজে, এমনকি তার আধুনিক ভক্তসমাজেও তিনি ঈশ্বরের অবতাররূপে পূজিত হন।
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমায় অবস্থিত কামারপুকুর গ্রামে ১৮৩৬ সালে এক দরিদ্র ধর্মনিষ্ঠ রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্ম হয়। তিনি পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মা চন্দ্রমণি দেবীর চতুর্থ ও শেষ সন্তান। কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মের পূর্বে তাঁর পিতামাতার সম্মুখে বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। সন্তানসম্ভবা চন্দ্রমণি দেবী দেখেছিলেন শিবলিঙ্গ থেকে নির্গত একটি জ্যোতি তাঁর গর্ভে প্রবেশ করছে। তাঁর জন্মের অব্যবহিত পূর্বে গয়ায় তীর্থভ্রমণে গিয়ে ক্ষুদিরাম গদাধর বিষ্ণুকে স্বপ্নে দর্শন করেন। সেই কারণে তিনি নবজাতকের নাম রাখেন গদাধর।
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে পৌরোহিত্য গ্রহণের পর বঙ্গীয় তথা ভারতীয় শক্তিবাদের প্রভাবে তিনি কালীর আরাধনা শুরু করেন।[২] তার প্রথম গুরু তন্ত্র ও বৈষ্ণবীয় ভক্তিতত্ত্বজ্ঞা এক সাধিকা। পরবর্তীকালে অদ্বৈত বেদান্ত মতে সাধনা করে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন রামকৃষ্ণ। অন্যান্য ধর্মীয় মতে, বিশেষত ইসলাম ও খ্রিস্টীয় মতে সাধনা তাকে “যত মত, তত পথ” উপলব্ধির জগতে উন্নীত করে।[২] পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক গ্রামীণ উপভাষায় ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে প্রদত্ত তার ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণ জনমানসে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে অশিক্ষিত হলেও রামকৃষ্ণ বাঙালি বিদ্বজ্জন সমাজ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সম্ভ্রম অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৭০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের নিকট তিনি হয়ে ওঠেন হিন্দু পুনর্জাগরণের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তৎসঙ্গে সংগঠিত করেন একদল অনুগামী, যাঁরা ১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর সন্ন্যাস গ্রহণ করে তার কাজ চালিয়ে যান। এঁদেরই নেতা ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
শৈশব
শৈশবে গদাই নামে পরিচিত গদাধর তাঁর গ্রামবাসীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। অঙ্কন ও মাটির প্রতিমা নির্মাণে তাঁর ছিল সহজাত দক্ষতা। যদিও প্রথাগত শিক্ষায় তাঁর আদৌ মনযোগ ছিল না। সেযুগে ব্রাহ্মণসমাজে প্রচলিত সংস্কৃত শিক্ষাকে তিনি “চালকলা-বাঁধা বিদ্যা” (অর্থাৎ পুরোহিতের জীবিকা-উপার্জনী শিক্ষা) বলে উপহাস করেন এবং তা গ্রহণে অস্বীকার করেন। তবে পাঠশালার শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তার ঔদাসিন্য থাকলেও নতুন কিছু শিখতে তার আগ্রহের অন্ত ছিল না।গানবাজনা, কথকতা ও ধর্মীয় উপাখ্যান অবলম্বনে যাত্রাভিনয়ে তিনি অনায়াসে পারদর্শিতা অর্জন করেন। তীর্থযাত্রী, সন্ন্যাসী এবং গ্রাম্য পুরাণকথকদের কথকতা শুনে অতি অল্প বয়সেই পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতে বুৎপত্তি অর্জন করেন গদাধর।মাতৃভাষা বাংলায় তার অক্ষরজ্ঞান ছিলঃ কিন্তু সংস্কৃত অনুধাবনে সক্ষম হলেও সেই ভাষা তিনি বলতে পারতেন না।পুরীর পথে কামারপুকুরে বিশ্রামরত সন্ন্যাসীদের সেবাযত্ন করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধর্মীয় বিতর্ক মন দিয়ে শুনতেন গদাধর।
শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই তার মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাবতন্ময়তা দেখা দিত। একবার ধানক্ষেতের পথে চলতে চলতে আকাশে কালো মেঘের পটে সাদা বলাকার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তিনি বাহ্যজ্ঞানরহিত হন। পরবর্তীকালে তার সেই অবস্থাকে তিনি ব্যাখ্যা করেন এক অনির্বচনীয় আনন্দের অভিজ্ঞতারূপে।বাল্যকালে আরও কয়েকবার তার অনুরূপ ভাবতন্ময়তা দেখা দিয়েছিল – একবার দেবী বিশালাক্ষীর পূজার সময়, আরেকবার শিবরাত্রি উপলক্ষে যাত্রায় শিবের চরিত্রাভিনয়কালে। দশ-বারো বছর বয়স থেকে এই ভাবতন্ময়তা তার নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় ।
১৮৪৩ সালে পিতৃবিয়োগের পর পরিবারের ভার গ্রহণ করেন তার অগ্রজ রামকুমার। এই ঘটনা গদাধরের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ধর্মীয় জীবনযাপনের ইচ্ছা তার মনে দৃঢ় হয়। পিতার অভাব তাকে মায়ের খুব কাছে নিয়ে আসে; ঘরের কাজ ও গৃহদেবতার পূজাপাঠে তিনি অধিকতর সময় ব্যয় করতে থাকেন; আত্মমগ্ন হয়ে থাকেন ধর্মীয় মহাকাব্য পাঠে।
গদাধর যখন কিশোর, তখন তার পরিবারের আর্থিক সংকট দেখা দেয়। রামকুমার কলকাতায় একটি সংস্কৃত টোল খোলেন ও পুরোহিতের বৃত্তি গ্রহণ করেন। ১৮৫২ সালে দাদাকে পৌরোহিত্যে সহায়তা করার মানসে গদাধর কলকাতায় পদার্পণ করেন।
সূত্রঃ wikipedia