শয়ন একাদশীর মন্ত্র, তাৎপর্য, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য

সূর্য্যের মিথুন রাশিস্থ বৈষ্ণবীয় ‘বামন’, বৈদিক “শুচি” ও বাংলা নাম অনুসারে “আষাঢ়” মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিকে ‘শয়ন’ একাদশী তিথি বলা হয়। অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে গেলে আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিকে “শয়ন একাদশী বা হরি শয়নী একাদশী” তিথি বলা হয়। এই একাদশী ‘মহৈকাদশী বা মহা একাদশী’, ‘প্রথমৈকাদশী বা প্রথমা একাদশী’, ‘পদ্ম একাদশী’, ‘দেবপোধি একাদশী’, ‘আষাঢ়ী একাদশী’, ‘আষাঢ়ী’ নামেও পরিচিত। এই একাদশী বাংলা ক্যালেন্ডারে‘আষাঢ় – শ্রাবণ’ মাসে পালন করা হয়। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে এটি জুন – জুলাই মাসের সাথে মিলে যায়।

আভিধানিক সূত্রে “শী” শব্দ থেকে “শয়ন, শয়নী” ইত্যাদি শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। “শী” এর অর্থ হ’ল (১) সুপ্তি (২) সংশয় (৩) স্বপ্ন ইত্যাদি ৫টি শব্দ। আর ‘শয়নী” {শী ধাতু + অন্‌ (ল্যুট্‌ )-ভা/স্ত্রীং-/ঈপ্‌} শব্দের অর্থ হ’ল (১) শয্যাগত (২) সখী (৩) রণক্ষেত্রে পতন (৪) শোওয়া, শোয়া (৫) তন্দ্রাচ্ছন্ন ইত্যাদি প্রায় ১৫টি শব্দ।।

বিশেষ অর্থে বলা হয়—যে একাদশী দেবী তার একনিষ্ঠ ভক্তের মনের তমোবিকার (মিথ্যা, স্বপ্ন, অলস, নিদ্রা) দূর করে ঐভক্তকে মুক্তি প্রদান করেন, তিনিই হলেন “শ্রীশ্ৰীশয়নী একাদশী দেবী”। এই দিন হতেই চতুর্মাস্য নামক চার মাসব্যাপী ব্রতের সূচনা হয়। এই একাদশীর আদিষ্ট দেবতার নাম “পদ্মলোচন”।

মতান্তরে বলা হয়—এই একাদশী তিথি থেকে কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশী পৰ্য্যন্ত ভগবান শ্রীহরি ক্ষীরসমুদ্রে শেষ নাগের রচিত শয্যায় আরোহন করেন। এইজন্য এই একাদশী তিথিকে “শ্ৰীশ্ৰীশয়নী একাদশী” বলা হয়। যার অন্য নাম হ’ল—“দেবশয়নী”, “বিষ্ণুশয়নী” এবং “শ্রীহরিশয়নী একাদশী দেবী”। তামিল অঞ্চলে এটি ‘তুলি একাদশী’ নামেও পরিচিত। এই চারমাস চাতুর্মাস্য ব্রত সমেত নানা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। চার মাস পর কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে (প্রবোধিনী একাদশী) নিদ্রা থেকে জাগ্রত হন। শয়নী একাদশী থেকে প্রবোধিনী একাদশী পর্যন্ত চার মাস সময়কাল “চতুর্মাস্য” নামে পরিচিত। এটি মূলত বর্ষাকাল। এই দিন টি দক্ষিণায়নের শুরুতেই দেবগণের রাত।

পান্ধারপুর যাত্রাঃ

এই দিনটি, চন্দ্রভাগা নদীর তীরে অবস্থিত দক্ষিণ মহারাষ্ট্রের সোলাপুর জেলার পান্ধারপুরে সমাপ্ত হয় পান্ধারপুর আষাঢ়ী একাদশী দীর্ঘ যাত্রা নামে পরিচিত। যা একটি তীর্থযাত্রীদের বিশাল যাত্রা বা ধর্মীয় শোভাযাত্রা। বিষ্ণুর স্থানীয় রূপ ‘ভিঠাল‘ দেবতার পূজার প্রধান কেন্দ্র পান্ধারপুর। মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী এ দিন পান্ধারপুরে আসেন। তাদের মধ্যে অনেকেই মহারাষ্ট্রের সাধুদের চিত্র অঙ্কিত পালকি বহন করে।

এই কাহিনীর বিষয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরদের বলেছেন যে, এই একাদশী ব্রত মানবের মুক্তিলাভের সহায়ক।

পৌরাণিক আখ্যানটি হল-

মহারাজ যুধিষ্ঠির বললো—’হে কৃষ্ণ! আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কি ? এর মহিমাই বা কি? তা আমাকে কৃপা করে বলুন।’

শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ব্রহ্মা এই একাদশী সম্পর্কে দেবর্ষি নারদকে যা বলেছিলেন আমি সেই আশ্চর্যজনক কথা আপনাকে বলছি। শ্রীব্রহ্ম বললেন-হে নারদ। এ সংসারে একাদশীর মতো পবিত্র আর কোন বেত নেই। সকল পাপ বিনাশের জন্য এই বিষ্ণুব্রত পালন করা একান্ত আবশ্যক। যে ব্যক্তি এই প্রকার পবিত্র পাপনাশক এবং সকল অভিষ্ট প্রদাতা একাদশী ব্রত না করে তাকে নরকগামী হতে হয়।

আষাঢ়ের শুক্ল পক্ষের এই একাদশী শয়নী’ নামে বিখ্যাত। শ্রীভগবান ঋষিকেশের জন্য এই ব্রত পালন করতে হয়। এই ব্রতের সম্বন্ধে এক মঙ্গলময় পৌরাণিক কাহিনী আছে। আমি এখন তা বলছি।

বহু বছর পূর্বে সূর্যবংশে মান্ধাতা নামে একজন রাজর্ষি ছিলেন। তিনি ছিলেন সম্প্রতি এবং প্রতাপশালী চক্রবর্তী রাজা। প্রজাদেরকে তিনি নিজের সন্তানের মতো প্রতিপালন করতেন। সেই রাজ্যে কোনরকম দুঃখ, রোগ ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ, আতঙ্ক, খাদ্যাভাব অথবা কোন অন্যায় আচরণ ছিল না। এইভাবে বহুদিন অতিবাহিত হল। কিন্তু একসময় হঠাৎ দৈবদুর্বিপাকে ক্রমাগত তিনবছর সে রাজ্যে কোন বৃষ্টি হয়নি। দুর্ভিক্ষের ফলে সেখানে দেবতাদের উদ্দেশ্যে দানমন্ত্রের ‘স্বাহা’ ‘স্বধা’ ইত্যাদি শব্দও বন্ধ হয়ে গেল। এমনকি বেদপাঠও ক্রমশ বন্ধ হল।।

তখন প্রজারা রাজার কাছে এসে বলতে লাগল—মহারাজ দয়া করে আমাদের কথা শুনুন। শাস্ত্রে জলকে নার বলা হয় আর সেই জ্বলে ভগবানের অয়ন অর্থাৎ নিবাস। তাই ভগবানের এক নাম নারায়ণ।

মেঘরূপে ভগবান বিষ্ণু সর্বত্র বারিবর্ষণ করেন। সেই বৃষ্টি থেকে অন্ন এবং অন্ন খেয়ে প্রজাগণ জীবন ধারণ করেন। এখন সেই অন্নের অভাবে প্রজারা ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। অতএব হে মহারাজ আপনি এমন কোন উপায় অবলম্বন করুন যাতে আপনার রাজ্যের শান্তি এবং কল্যাণ সাধন হয়।

রাজা মান্ধাতা বললেন—তোমরা ঠিকই বলেছ। অন্ন থেকে প্রজার উদ্ভব। অন্ন থেকেই প্রজার পালন। ‘তাই অন্নের অভাবে প্রজারা বিনষ্ট হয়। আবার রাজার দোযেও রাজ্য নষ্ট হয়। আমি নিজের বুদ্ধিতে আমার নিজের কোন দোষ খুঁজে পাচ্ছি না। তবুও প্রজাদের কল্যাণের জন্য আমি আশ্রাণ চেষ্টা করব।

তারপর রাজা ব্রহ্মাকে প্রণাম করে সৈনসহ বনে গমন করলেন। সেখানে প্রধান প্রধান ঋষিদের আশ্রমে ভ্রমণ করলেন। এভাবে একদিন তিনি ব্রহ্মার পুত্র মহাতেজস্বী অঙ্গিরা ঋষির সাক্ষাৎ লাভ করলেন। তাকে দর্শনমাত্রই রাজা মহানন্দে ঋষির চরণ বন্দনা করলেন। মুনিবর তাকে আশীর্বাদ ও কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। রাজা তখন তার বনে আগমনের কারণ সবিস্তারে ঋষির কাছে জানালেন।

ঋষি অঙ্গিরা কিছু সময় ধ্যানস্থ থাকার পর বলতে লাগলেন—“হে রাজন! এটি সত্যযুগ। এই যুগে সকল লোক বেদপরায়ণ এবং ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কেউ তপস্যা করে না। এই নিয়ম থাকা সত্ত্বেও এক শুদ্র এ রাজ্যে তপস্যা করছে। তার এই অকার্যের জন্যই রাজ্যের এই দুর্দশা। তাই তাকে হত্যা করলেই সকল দোষ দূর হবে।

রাজা বললেন—হে মুনিবর! তপস্যাকারী নিরপরাধ ব্যক্তিকে আমি কিভাবে বধ করব? আমার পক্ষে সহজসাধ্য অন্য কোন উপায় থাকলে আপনি তা দয়া করে আমাকে বলুন।

তদুত্তরে মহর্ষি অঙ্গিরা বললেন—আপনি আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের শয়নী নামে প্রসিদ্ধ একাদশী ব্রত পালন করুন। এই ব্রতের প্রভাবে নিশ্চয়ই রাজ্যে বৃষ্টি হবে। এই একাদশী সর্বসিদ্ধিদাত্রী এবং সর্বউপদ্রব নাশকারিনী। হে রাজন! প্রজা ও পরিবারবর্গ সহ আপনি। এই ব্রত পালন করুন।

মুনিবরের কথা শুনে রাজা নিজের প্রাসাদে ফিরে এলেন। আষাঢ় মাস উপস্থিত হলে রাজের সকল প্রজা রাজার সাথে এই একাদশী ব্রতের অনুষ্ঠান করলেন। ব্রত প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হল। কিছুকালের মধ্যেই অন্নাভাব দুর হল। ভগবান হৃষিকেশের কৃপায় প্রজাগণ সুখী হল।

এ কারণে সুখ ও মুক্তি প্রদানকারী এই উত্তম ব্রত পালন করা সকলেরই অবশ্য কর্তব্য। ভবিষোত্তরপুরাণে যুধিষ্ঠির-শ্রীকৃষ্ণ তথ্য নারদ-ব্রহ্মা সংবাদ রূপে একাদশীর এই মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।

তপ্তকৃচ্ছ্রাতিকৃচ্ছ্রাভ্যাং যঃ ক্ষিপেচ্ছয়ণং হরেঃ ।।
স যাতি পরমং স্থানং পুনরাবৃত্তিবর্জিতম্‌

—ভবিষ্য-পুরাণ, একাদশী-১৬। ২৫৯

শয়ন একাদশীর মন্ত্র

ॐ पद्मनाभाये नमः।
ওম পদ্মনাভায় নমঃ

দেবশয়নী একাদশীর গুরুত্ব

বিশ্বাস করা হয় যে, সঠিক আচার মেনে দেবশয়নী একাদশী ব্রত করলে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মানুষের জীবন থেকে সমস্ত বাধা দূর হয় এবং অর্থনৈতিক সমস্যাও সমাপ্ত হয়। এই ব্রতর ক্ষেত্রে ভগবান বিষ্ণুর পাশাপাশি অশ্বত্থ গাছের পূজা করলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। বেদ ও পুরাণেও একাদশী ব্রতর কথা বলা আছে। একাদশী ব্রত করলে পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং প্রতিটি ইচ্ছা পূরণ হয়।

দেবশয়নী একাদশীর পর থেকে শুভ কাজ করা নিষেধ

ভগবান বিষ্ণু যখন বিশ্রামের জন্য পাতাল লোকে পৌঁছে যান, তখন থেকেই সমস্ত ধরণের মাঙ্গলিক কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। হিন্দু নিয়ম-নীতি অনুযায়ী, দেবশয়নী একাদশী থেকে শুরু করে দেব-প্রবোধিনী একাদশী পর্যন্ত সময়কালকে চতুর্মাস বলা হয়। এই সময়ে, বিবাহ, গৃহ প্রবেশ, নতুন যানবাহন বা বাড়ি কেনাকাটা এবং মুণ্ডণের মতো শুভ কাজ করা যায় না। এই চার মাস ঈশ্বরের উপাসনায় সময় ব্যয় করা উচিত।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.