১ম অধ্যায় (অর্জুন বিষাদ যোগ)

ধৃতরাষ্ট্র উবাচ

ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয় ॥১॥
অনুবাদ : ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করলেন- হে সঞ্জয় ! ধর্মক্ষেত্রে যুদ্ধ করার মানসে সমবেত হয়ে আমার পুত্র এবং পান্ডুর পুত্রেরা তারপর কি করল ?

সঞ্জয় উবাচ

দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্যোধনস্তদা ।
আচার্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ॥২॥
অনুবাদ : সঞ্জয় বললেন- হে রাজন্ ! পাণ্ডবদের সৈন্যসজ্জা দর্শন করে রাজা দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে বললেন-

পশ্যৈতাং পাণ্ডুপুত্রাণামাচার্য মহতীং চমূম্ ।
ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা ॥৩॥
অনুবাদ : হে আচার্য ! পাণ্ডবদের মহান সৈন্যবল দর্শন করুন, যা আপনার অত্যন্ত বুদ্ধিমান শিষ্য দ্রুপদের পুত্র অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যূহের আকারে রচনা করেছেন।

অত্র শূরা মহেষ্বাসা ভীমার্জুনসমা যুধি ।
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ ॥৪॥
অনুবাদ : সেই সমস্ত সেনাদের মধ্যে অনেকে ভীম ও অর্জুনের মতো বীর ধনুর্ধারী রয়েছেন এবং যুযুধান, বিরাট ও দ্রুপদের মতো মহাযোদ্ধা রয়েছেন।

ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশিরাজশ্চ বীর্যবান্ ।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ ॥৫॥
অনুবাদ : সেখানে ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, কাশিরাজ, পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ ও শৈব্যের মতো অত্যন্ত বলবান যোদ্ধারাও রয়েছেন।

যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্যবান্ ।
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব এব মহারথাঃ ॥৬॥
অনুবাদ : সেখানে রয়েছেন অত্যন্ত বলবান যুধামন্যু, প্রবল পরাক্রমশালী উত্তমৌজা, সুভদ্রার পুত্র এবং দ্রৌপদীর পুত্রগণ। এই সব যোদ্ধারা সকলেই এক-একজন মহারথী।

অস্মাকন্ত্ত বিশিষ্টা যে তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম ।
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে ॥৭॥
অনুবাদ : হে দ্বিজোত্তম ! আমাদের পক্ষে যে সমস্ত বিশিষ্ট সেনাপতি সামরিক শক্তি পরিচালনার জন্য রয়েছেন, আপনার অবগতির জন্য আমি তাঁদের সম্বন্ধে বলছি।

ভবান্ ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ ।
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তিস্তথৈব চ ॥৮॥
অনুবাদ : সেখানে রয়েছেন আপনার মতোই ব্যক্তিত্বশালী-ভীষ্ম, কর্ণ, কৃপা, অশ্বত্থামা , বিকর্ণ ও সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা, যাঁরা সর্বদা সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে থাকেন।

অন্যে চ বহবঃ শূরাঃ মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ।
নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ সর্বে যুদ্ধবিশারদাঃ ॥৯॥
অনুবাদ : এ ছাড়া আরও বহু সেনানায়ক রয়েছেন, যাঁরা আমার জন্য তাঁদের জীবন ত্যাগ করতে প্রস্তুত । তাঁরা সকলেই নানা প্রকার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং তাঁরা সকলেই সামরিক বিজ্ঞানে বিশারদ।

অপর্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্ ।
পর্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্ ॥১০॥
অনুবাদ : আমাদের সৈন্যবল অপরিমিত এবং আমরা পিতামহ ভীষ্মের দ্বারা পূর্ণরূপে সুরক্ষিত, কিন্তু ভীমের দ্বারা সতর্কভাবে সুরক্ষিত পাণ্ডবদের শক্তি সীমিত।

অয়নেষু চ সর্বেষু যথাভাগমবস্থিতাঃ ।
ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্ত্ত ভবন্তঃ সর্ব এব হি ॥১১॥
অনুবাদ : এখন আপনারা সকলে সেনাব্যূহের প্রবেশপথে নিজ নিজ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থিত হয়ে পিতামহ ভীষ্মকে সর্বতোভাবে সাহায্য প্রদান করুন।

তস্য সঞ্জনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ ।
সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান্ ॥১২॥
অনুবাদ : তখন কুরুবংশের বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম দুর্যোধনের হর্ষ উৎপাদনের জন্য সিংহের গর্জনের মতো অতি উচ্চনাদে তাঁর শঙ্খ বাজালেন।

ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ ।
সহসৈবাভ্যহন্যন্ত স শব্দস্তুমুলোভবৎ ॥১৩॥
অনুবাদ : তারপর শঙ্খ, ভেরী, পণব, আনক, ঢাক ও গোমুখ শিঙাসমূহ হঠাৎ একত্রে ধ্বনিত হয়ে এক তুমুল শব্দের সৃষ্টি হল।

ততঃ শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ ।
মাধবঃ পান্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদধ্মতুঃ ॥১৪॥
অনুবাদ : অন্য দিকে, শ্বেত অশ্বযুক্ত এক দিব্য রথে স্থিত শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন উভয়ে তাঁদের দিব্য শঙ্খ বাজালেন।

পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ ॥
পৌন্ড্রং দধ্মৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্মা বৃকোদরঃ ॥১৫॥
অনুবাদ : তখন, শ্রীকৃষ্ণ পাঞ্চজন্য নামক তাঁর শঙ্খ বাজালেন, অর্জুন বাজালেন, তাঁর দেবদত্ত নামক শঙ্খ এবং বিপুল ভোজনপ্রিয় ও ভীমকর্মা ভীমসেন বাজালেন পৌণ্ড্র নামক তাঁর ভয়ংকর শঙ্খ।

অনন্তবিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ ।
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষমণিপুষ্পকৌ ॥১৬॥
অনুবাদ : কুন্তীপুত্র মহারাজ যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় নামক শঙ্খ বাজালেন এবং নকুল ও সহদেব বাজালেন সুঘোষ ও মণিপুষ্পক নামক শঙ্খ।

কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখণ্ডী চ মহারথঃ ।
ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ ॥১৭॥

দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্বশঃ পৃথিবীপতে ।
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দধ্মুঃ পৃথক্ পৃথক্ ॥১৮॥
অনুবাদ (১৭-১৮) : হে মহারাজ ! তখন মহান ধনুর্ধর কাশীরাজ, প্রবল যোদ্ধা শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, অপরাজিত সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, সুভদ্রার মহা বলবান পুত্র এবং অন্য সকলে তাঁদের নিজ নিজ পৃথক শঙ্খ বাজালেন।

স ঘোষো ধার্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ, ।
নভশ্চ পৃথিবীং চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়ন্ ॥১৯॥
অনুবাদ : শঙ্খ-নিনাদের সেই প্রচণ্ড শব্দ আকাশ ও পৃথিবী প্রতিধ্বনিত করে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হৃদয় বিদারিত করতে লাগল।

অথ ব্যবস্তিতান্ দৃষ্ট্বা ধার্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ ।
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পান্ডবঃ ।
হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে ॥২০॥
অনুবাদ : সেই সময় পান্ডু পুত্র অর্জুন হনুমান চিহ্নিত পতাকা শোভিত রথে অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁর ধনুক তুলে নিয়ে শ্বর নিক্ষেপ করতে প্রস্তুত হলেন। হে মহারাজ ! ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সমর সজ্জায় বিন্যস্ত দেখে অর্জুন তখন শ্রীকৃষ্ণকে এই কথাগুলি বললেন-

অর্জুন উবাচ

সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যুত ।
যাবদেতান্নিরীক্ষেহহং যোদ্ধুকামানবস্থিতান্ ॥২১॥

কৈর্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে ॥২২॥
অনুবাদ (২১-২২) : অর্জুন বললেন- হে অচ্যুত ! তুমি উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে আমার রথ স্থাপন কর, যাতে আমি দেখতে পারি যুদ্ধ করার অভিলাষী হয়ে কারা এখানে এসেছে এবং এই মহা সংগ্রামে আমাকে কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে।

যোৎস্যমানানবেক্ষেহহং য এতেহত্র সমাগতাঃ ।
ধার্তরাষ্ট্রস্য দুর্বুদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ ॥২৩॥
অনুবাদ : ধৃতরাষ্ট্রের দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন পুত্রকে সন্তুষ্ট করার বাসনা করে যারা এখানে যুদ্ধ করতে এসেছে, তাদের আমি দেখতে চাই৷

সঞ্জয় উবাচ

এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত ।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্ ॥২৪॥
অনুবাদ : সঞ্জয় বললেন- হে ভরত-বংশধর ! অর্জুন কতৃক এভাবে আদিষ্ট হয়ে, শ্রীকৃষ্ণ সেই অতি উত্তম রথটি চালিয়ে নিয়ে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে রাখলেন।

ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ সর্বেষাং চ মহীক্ষিতাম্ ।
উবাচ পার্থ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি ॥২৫॥
অনুবাদ : ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখ পৃথিবীর অন্য সমস্ত নৃপতিদের সামনে ভগবান হৃষীকেশ বললেন, হে পার্থ ! এখানে সমবেত সমস্ত কৌরবদের দেখ।

তত্রাপশ্যৎ স্থিতান্ পার্থঃ পিতৃনথ পিতামহান্ ।
আচার্যান্মাতুলান্ ভ্রাতৃন্ পুত্রান্ পৌত্রান্ সখীংস্তথা ।
শ্বশুরান্ সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি ॥২৬॥
অনুবাদ : তখন অর্জুন উভয় পক্ষের সেনাদলের মধ্যে পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, শ্বশুর, মিত্র ও শুভাকাংক্ষীদের উপস্থিত দেখতে পেলেন।

তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্বান্ বন্ধূনবস্থিতান্।
কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীৎ ॥২৭॥
অনুবাদ : যখন কুন্তীপুত্র অর্জুন সকল রকমের বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনদের যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থিত দেখলেন, তখন তিনি অত্যন্ত কৃপাবিষ্ট ও বিষণ্ণ হয়ে বললেন।

অর্জুন উবাচ

দৃষ্ট্বেমং স্বজনং কৃষ্ণ যুযুৎসুং সমুপস্থিতম্ ।
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখং চ পরিশুষ্যতি ॥২৮॥
অনুবাদ : অর্জুন বললেন- হে প্রিয়বর কৃষ্ণ ! আমার সমস্ত বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের এমনভাবে যুদ্ধাভিলাষী হয়ে আমার সামনে অবস্থান করতে দেখে আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ হচ্ছে এবং মুখ শুষ্ক হয়ে উঠছে।

বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে ।
গান্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিদহ্যতে ॥২৯॥
অনুবাদ : আমার সর্বশরীর কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হচ্ছে, আমার হাত থেকে গাণ্ডীব খসে পড়ছে এবং ত্বক যেন জ্বলে যাচ্ছে।

ন চ শক্নোম্যবস্থাতুং ভ্রমতীব চ মে মনঃ ।
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব ॥৩০॥
অনুবাদ : হে কেশব ! আমি এখন আর স্থির থাকতে পারছি না। আমি আত্মবিস্মৃত হচ্ছি এবং আমার চিত্ত উদ্ ভ্রান্ত হচ্ছে। হে কেশীদানবহন্তা শ্রীকৃষ্ণ ! আমি কেবল অমঙ্গলসূচক লক্ষণসমূহ দর্শন করছি।

ন চ শ্রেয়োহনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে ।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ ॥৩১॥
অনুবাদ : হে কৃষ্ণ ! যুদ্ধে আত্মীয়-স্বজনদের নিধন করা শ্রেয়স্কর দেখছি না। আমি যুদ্ধে জয়লাভ চাই না, রাজ্য এবং সুখভোগও কামনা করি না।

কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা ।
যেষামর্থে কাংক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ ॥৩২॥

ত ইমেহবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্ত্বা ধনানি চ ।
আচার্যাঃ পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ ॥৩৩॥

মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা ।
এতান্ন হন্তমিচ্ছামি ঘ্নতহপি মধুসূদন ॥৩৪॥

অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিং নু মহীকৃতে ।
নিহত্য ধার্তরাষ্ট্রান্নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দন ॥৩৫॥
অনুবাদ (৩২-৩৫) : হে গোবিন্দ ! আমাদের রাজ্যে কি প্রায়োজন, আর সুখভোগ বা জীবন ধারনেই বা কী প্রয়োজন, যখন দেখছি- যাদের জন্য রাজ্য ও ভোগসুখের কামনা, তারা সকলেই এই রণক্ষেত্রে আজ উপস্থিত? হে মধুসূদন ! যখন আচার্য, পিতৃব্য, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও আত্মীয়স্বজন, সকলেই প্রাণ ও ধনাদির আশা পরিত্যাগ করে আমার সামনে যুদ্ধে উপস্থিত হয়েছেন, তখন তাঁরা আমাকে বধ করলেও আমি তাঁদের হত্যা করতে চাইব কেন? হে সমস্ত জীবের প্রতিপলক জনার্দন ! পৃথিবীর তো কথাই নেই, এমন কি সমগ্র ত্রিভুবনের বিনিময়েও আমি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত নই। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের নিধন করে কি সন্তোষ আমরা লাভ করতে পারব?

পাপমেবাশ্রয়েদস্মান্ হত্বৈতানাততায়িনঃ ।
তস্মান্নার্হা বয়ং হন্তুং ধার্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্ ।
স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব ॥৩৬॥
অনুবাদ : এই ধরনের আততায়ীদের বধ করলে মহাপাপ আমাদের আচ্ছন্ন করবে। সুতরাং বন্ধুবান্ধব সহ ধৃতরাষ্ট্র্রের পুত্রদের সংহার করা আমাদের পক্ষে অবশ্যই উচিত হবে না। হে মাধব , লক্ষ্মীপতি শ্রীকৃষ্ণ ! আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে আমাদের কী লাভ হবে ? আর তা থেকে আমরা কেমন করে সুখী হব ?

যদ্যপেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্ ॥৩৭॥

কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্তিতুম্ ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দন ॥৩৮॥
অনুবাদ (৩৭-৩৮) : হে জনার্দন ! যদিও এরা রাজ্যলোভে অভিভূত হয়ে কুলক্ষয় জনিত দোষ ও মিত্রদ্রোহ নিমিত্ত পাপ লক্ষ্য করছে না, কিন্তু আমরা কুলক্ষয় জনিত দোষ লক্ষ্য করেও এই পাপ কর্মে কেন প্রবৃত্ত হব ?

কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ ।
ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্মোহভিভবত্যুত ॥৩৯॥
অনুবাদ : কুলক্ষয় হলে সনাতন কুলধর্ম বিনষ্ট হয় এবং তা হলে সমগ্র বংশ অধর্মে অভিভূত হয়।

অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রীয়ঃ ।
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ ॥৪০॥
অনুবাদ : হে কৃষ্ণ ! কুল অধর্মের দ্বারা অভিভূত হলে কুলবধূগণ ব্যভিচারে প্রবৃত্ত হয় এবং হে বার্ষ্ণেয় ! কুলস্ত্রীগণ অসৎ চরিত্রা হলে অবাঞ্ছিত প্রজাতি উৎপন্ন হয়।

সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ ।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ ॥৪১॥
অনুবাদ : বর্ণসঙ্কর উৎপাদন বৃদ্ধি হলে কুল ও কুলঘাতকেরা নরকগামী হয়। সেই কুলে পিণ্ডদান ও তর্পণক্রিয়া লোপ পাওয়ার ফলে তাদের পিতৃপুরুষেরাও নরকে অধঃপতিত হয়।

দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ ।
উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বতাঃ ॥৪২॥
অনুবাদ : যারা বংশের ঐতিহ্য নষ্ট করে এবং তার ফলে অবাঞ্ছিত সন্তানাদি সৃষ্টি করে, তাদের কুকর্মজনিত দোষের ফলে সর্বপ্রকার জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প এবং বংশের কল্যাণ-ধর্ম উৎসন্নে যায়। ফলে সনাতন জাতিধর্ম ও কুলধর্মও বিনষ্ট হয়।

উৎসন্ন কুলধর্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দন ।
নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম ॥৪৩॥
অনুবাদ : হে জনার্দন ! আমি পরম্পরাক্রমে শুনেছি যে, যাদের কুলধর্ম বিনষ্ট হয়েছে, তাদের নিয়ত নরকে বাস করতে হয়।

অহো বত মহৎ পাপং কর্তুং ব্যাবসিতা বয়ম্ ।
যদ্ রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ ॥৪৪॥
অনুবাদ : হায় ! কী আশ্চর্যের বিষয় যে, আমরা রাজ্যসুখের লোভে স্বজনদের হত্যা করতে উদ্যত হয়ে মহাপাপ করতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছি।

যদি মামপ্রতিকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ ।
ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ ॥৪৫॥
অনুবাদ : প্রতিরোধ রহিত ও নিরস্ত্র অবস্থায় আমাকে যদি শস্ত্রধারী ধৃতরাষ্ট্র্রের পুত্রেরা যুদ্ধে বধ করে, তা হলে আমার অধিকতর মঙ্গলই হবে।

সঞ্জয় উবাচ

এবমুক্ত্বার্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ ।
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ ॥৪৬॥
অনুবাদ : সঞ্জয় বললেন- রণক্ষেত্রে এই কথা বলে অর্জুন তাঁর ধনুর্বাণ ত্যাগ করে শোকে ভারাক্রান্ত চিত্তে রথোপরি উপবেশন করলেন।

ওং তত্সদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষত্সু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে অর্জুনবিষাদযোগো নাম প্রথমোঽধ্যায়ঃ ॥

 

শ্রীমদ্ভগবদগীতা ১ম অধ্যায় (অর্জুনবিষাদযোগ) এর সার সংক্ষেপ

৪৬টি শ্লোকবিশিষ্ট গীতার প্রথম অধ্যায়টি ‘অর্জুনবিষাদযোগ’ নামে পরিচিত। এ অধ্যায়ে অর্জুনের বিষাদ-ই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। অধ্যায়টি শুরু হয়েছে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের উক্তি দিয়ে এবং শেষ হয়েছে তার মন্ত্রী সঞ্জয়ের উক্তি দিয়ে। এ অধ্যায়ে তৃতীয় পান্ডব মহাবীর অর্জুনের উক্তির মাধ্যমে ব্যক্ত তার বিষাদই মূল সুর। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, গীতার সকল কথাই ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে বিবৃত করা হয় সঞ্জয় কর্তৃক হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে। ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন জন্মান্ধ। তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তার পুত্রগণ এবং পান্ডব পুত্রগণের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের বর্ণনা তার মন্ত্রী সঞ্জয়ের নিকট জানতে চেয়েছিলেন। ধর্মপ্রাণ সঞ্জয় ব্যাসদেবের কৃপায় দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছিলেন বিধায় তিনি প্রাসাদে থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রের সকল ঘটনা দর্শন এবং কথা শ্রবণ করতে পেরেছিলেন এবং তা ধৃতরাষ্ট্রকে অবহিত করেছিলেন। অন্ধ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের নিকট জানতে চাইলেন যে, ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে তার যুদ্ধাভিলাষী পুত্রগণ এবং পান্ডু পুত্রগণ সমবেত হয়ে কী করেছিলেন। তদুত্তরে সঞ্জয় রাজাকে জানালেন যে, তার পুত্র দুর্যোধন পান্ডবপক্ষের সৈন্যসজ্জা অবলোকন করে গুরু দ্রোণাচার্যের নিকট গিয়ে বর্ণনা করতে লাগলেন পান্ডবপক্ষে কোন্ কোন্ মহারথী যুদ্ধ করতে এসেছেন এবং তারই (দ্রোণাচার্যের) প্রিয় শিষ্য দৃষ্টদুম্ন কিভাবে পান্ডবপক্ষের সৈন্যসজ্জা পরিচালনা করছেন। অতপর তিনি তার নিজের পক্ষের মহাবীর ও মহারথীগণের সম্বন্ধেও দ্রোণাচার্যকে অবহিত করে এ মর্মে মন্তব্য করলেন যে, পান্ডবদের সৈন্য সসীম কিন্ত তাদের সৈন্য অপরিমিত। দুর্যোধনের নিকট থেকে সব অবহিত হবার পর কুরুবংশের বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্মদেব দুর্যোধনের হর্ষ উৎপাদনের জন্য সিংহের গর্জনের ন্যায় উচ্চনাদে শঙ্খধ্বনি করলেন। সেই সাথে কৌরব পক্ষের অন্যরাও তাদের নিজ নিজ শঙ্খ, সেই সাথে কৌরব পক্ষের অন্যরাও তাদের নিজ নিজ শঙ্খ, ভেরী, পনব, আনক, শিঙ্গা ধ্বনি করলে সবকিছু মিলে এক তুমুল শব্দের সৃষ্টি হলো। অপরপক্ষে শ্বেত অশ্বযুক্ত দিব্য রথে স্থিত শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনও তাদের নিজ নিজ শঙ্খধ্বনি করলে এ তুমুল শব্দ আকাশ ও পৃথিবী প্রতিধ্বনিত করে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণের হৃদয় বিদারিত করতে লাগলো। এ সময় ধনুর্ধর অর্জুন ধনুক ও শর হস্তে ধারণ করে কৌরবপক্ষের যোদ্ধাগণকে দেখার মানসে তার রথের সারথি শ্রীকৃষ্ণকে উভয় সেনাদলের মাঝখানে রথখানি স্থাপন করতে অনুরোধ করলেন। রথখানি যথাস্থানে স্থাপিত হলে অর্জুন লক্ষ্য করলেন তার সম্মুখে ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখ গুরুজনের সাথে মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, শশুর, মিত্র ও শুভাকাংখীগণ উপস্থিত রয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষে আচার্য,আত্মীয়-স্বজনদের অবলোকন করে অর্জুন বিষাদগ্রস্থ হলেন। বিষাদিত অর্জুনের সর্বশরীর কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হতে লাগলো এবং তার হস্ত থেকে গান্ডিব যেন খসে পড়ছে। যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক ও করুণ পরিণতির কথা ভেবে অস্থির অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন যে, তিনি এ যুদ্ধ করবেন না, কারণ তিনি এতে কোন মঙ্গল দেখছেন না। যু্দ্ধের চরম অমঙ্গলের কারণ হিসেবে এ মর্মে যুক্তি উপস্থাপন করলেন যে, যুদ্ধে গুরুজনকে হত্যা করে রাজ্যসুখ ভোগ করলে মহাপাপ তাদের আচ্ছন্ন করবে। তাছাড়া আত্মীয় স্বজনকে বধ করে রাজ্য লাভে কোন সুখ ও শান্তি নেই কারণ পুত্র, পৌত্র, ভ্রাতা, আত্মীয় বধ করলে কুলক্ষয় হয়, কুলক্ষয়ে কুলধর্ম বিনষ্ট হয় এবং তাহলে সমগ্র বংশ অধর্মে নিপাতিত হয়। কুল অধর্মে অভিভুত হলে কুলস্ত্রীগণ ব্যভিচারী হয়, তা থেকে বর্ণ সঙ্কর উৎপাদিত হলে কুলঘাতকেরা নরকগামী হয়। সেকুলে পিন্ডদান ও তর্পণক্রিয়া লোপ পাওয়ায় পিতৃপুরুষেরাও নরকে অধঃপতিত হয়। এসব কথা উচ্চারণ করে অর্জুন অত্যন্ত বিষন্ন মনে শ্রীকৃষ্ণ সমীপে মন্তব্য করলেন যে, তাকে নিরস্ত্র অবস্থায় শস্ত্রধারী ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ যুদ্ধে বধ করলেও তার অধিকতর মঙ্গল হবে। এভাবে অর্জুন রণক্ষেত্রে ধনুর্বান ত্যাগ করতঃ শোকভারাক্রান্ত চিত্তে রথোপরি উপবেশন করলেন। যুদ্ধের করুণ ভয়াবহ পরিণতির ভাবনা অর্জুনের ভেতর যে বিহবলতা, বিষন্নতা ও হৃদয়-দৌর্বল্য সৃষ্টি করেছিল তাই প্রকটিত হয়ে উঠেছে প্রথম অধ্যায় ‘অর্জুন বিষাদযোগে’। জয় শ্রীকৃষ্ণ ।।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.