১৫ শ অধ্যায় (পুরুষোত্তমযোগ)

শ্রীভগবানুবাচ
ঊর্ধ্বমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুঃরব্যয়ম্ ।
ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যস্তং বেদ স বেদবিৎ ॥১॥
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- ঊর্ধমূল ও অধঃশাখা-বিশিষ্ট একটি অব্যয় অশ্বত্থ বৃক্ষের কথা বলা হয়েছে৷ বৈদিক মন্ত্রসমূহ সেই বৃক্ষের পত্রস্বরুপ। যিনি সেই বৃক্ষটিকে জানেন, তিনিই বেদজ্ঞ ।

অধশ্চোর্ধ্বং প্রসৃতাস্তস্য শাখা
গুণপ্রবৃদ্ধা বিষয়প্রবালাঃ ।
অধশ্চ মূলান্যনুসন্ততানি
কর্মানুবন্ধীনি মনুষ্যলোকে ॥২॥
অনুবাদঃ এই বৃক্ষের শাখাসমূহ জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা পুষ্ট হয়ে অধোদেশে ও ঊর্ধ্বদেশে বিস্তৃ্ত। ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহই এই শাখাগণের পল্লব। এই বৃক্ষের মূলগুলি অধোদেশে প্রসারিত এবং সেগুলি মনুষ্যলোকে সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ।

ন রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে
নান্তো ন চাদির্ন চ সংপ্রতিষ্ঠা ।
অশ্বত্থমেনং সুবিরূঢ়মূলম্
অসঙ্গশস্ত্রেণ দৃঢ়েন ছিত্ত্বা ॥৩॥

ততঃ পদং তৎপরিমার্গিতব্যং
যস্মিন্ গতা ন নিবর্তন্তি ভুয়ঃ ।
তমেব চাদ্যং পুরুষং প্রপদ্যে
যতঃ প্রবৃত্তিঃ প্রসৃতা পুরাণী ॥৪॥

অনুবাদ (৩-৪) : এই বৃক্ষের স্বরূপ এই জগতে উপলব্ধ হয় না। এর আদি, অন্ত ও স্থিতি যে কোথায় তা কেউই বুঝতে পারে না। তীব্র বৈরাগ্যরূপ অস্ত্রের দ্বারা দৃঢ়মূল এই বৃক্ষকে ছেদন করে সত্য বস্তুর অন্বেষণ করা কর্তব্য, যেখানে গমন করলে, পুনরায় ফিরে আসতে হয় না। স্মরণাতীত কাল হতে যাঁর থেকে সমস্ত কিছু প্রবর্তন ও বিস্তৃত হয়েছে, সেই আদি পুরুষের প্রতি শরণাগত হও।

নির্মানমোহা জিতসঙ্গদোষা
অধ্যাত্মনিত্যা বিনিবৃত্তকামাঃ ।
দ্বন্দ্বৈর্বিমুক্তাঃ সুখদুঃখসংজ্ঞৈ-
র্গচ্ছন্ত্যমূঢ়াঃ পদমব্যয়ং তৎ ॥৫॥
অনুবাদঃ যাঁরা অভিমান ও মোহশূন্য, সঙ্গদোষ রহিত, নিত্য-অনিত্য বিচার-পরায়ণ, কামনা-বাসনা বর্জিত, সুখ-দুঃখ আদি দ্বন্দ্বসমূহ থেকে মুক্ত এবং মোহমুক্ত, তাঁরাই সেই অব্যয় পদ লাভ করেন ।

ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ ।
যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম ॥৬॥
অনুবাদঃসূর্য, চন্দ্র, অগ্নি বা বিদ্যুৎ আমার সেই পরম ধামকে আলোকিত করতে পারে না। সেখানে গেলে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না।

মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ ।
মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি ॥৭॥
অনুবাদঃ এই জড় জগতে বদ্ধ জীবসমূহ আমার সনাতন বিভিন্নাংশ। জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে তারা মন সহ ছয়টি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রকৃতিরূপ ক্ষেত্রে কঠোর সংগ্র্রাম করছে।

শরীরং যদবাপ্নোতি যচ্চাপ্যুৎক্রামতীশ্বরঃ ।
গৃহীত্বৈতানি সংযাতি বায়ুর্গন্ধানিবাশয়াৎ ॥৮॥
অনুবাদঃ বায়ু যেমন ফুলের গন্ধ নিয়ে অন্যত্র গমন করে, তেমনই এই জড় জগতে দেহের ঈশ্বর জীব এক শরীর থেকে অন্য শরীরে তার জীবনের বিভিন্ন ধারণাগুলি নিয়ে যায়।

শ্রোত্রং চক্ষুঃ স্পর্শনং চ রসনং ঘ্রাণমেব চ ।
অধিষ্ঠায় মনশ্চায়ং বিষয়ানুপসেবতে ॥৯॥
অনুবাদঃএই জীব চক্ষু, কর্ণ, ত্বক, জিহ্বা, নাসিকা ও মনকে আশ্রয় করে ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ উপভোগ করে।

উৎক্রামন্তং স্থিতং বাপি ভুঞ্জানং বা গুণান্বিতম্।
বিমুঢ়া নানুপশ্যন্তি পশ্যন্তি জ্ঞানচক্ষুষঃ ॥১০॥
অনুবাদঃ মুঢ় লোকেরা দেখতে পায় না কিভাবে জীব দেহ ত্যাগ করে অথবা প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিভাবে তার পরবর্তী শরীর সে উপভোগ করে। কিন্তু জ্ঞান-চক্ষুবিশিষ্ঠ ব্যক্তিগণ সমস্ত বিষয় দেখতে পান।

যতন্তো যোগিনশ্চৈনং পশ্যন্ত্যাত্মন্যবস্থিতম্।
যতন্তোহ্প্যকৃতাত্মানো নৈনং পশ্যন্ত্যচেতসঃ ॥১১॥
অনুবাদঃ আত্মজ্ঞানে অধিষ্ঠিত যত্নশীল যোগীগণ, এই তত্ত্ব দর্শন করতে পারেন ৷ কিন্তু আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান রহিত অবিবেকীগণ যত্নপরায়্ণ হয়েও এই তত্ত্ব অবগত হয় না।

যদাদিত্যগতং তেজো জগদ্ ভাসয়েতেহখিলম্ ।
যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ তত্তেজো বিদ্ধি মামকম্ ॥১২॥
অনুবাদঃ সূর্যের যে জ্যোতি এবং চন্দ্র ও অগ্নির যে জ্যোতি সমগ্র জগতকে উদ্ভাসিত করে, তা আমারই তেজ বলে জানবে।

গামাবিশ্য চ ভূতানি ধারয়াম্যহমোজসা ।
পুষ্ণামি চৌষধীঃ সর্বাঃ সোমো ভূত্বা রসাত্মকঃ ॥১৩॥
অনুবাদঃআমি পৃথিবীতে প্রবিষ্ট হয়ে আমার শক্তির দ্বারা সমস্ত জীবদের ধারণ করি এবং রসাত্মক চন্দ্ররূপে ধান, যব আদি ঔষধি পুষ্ট করছি।

অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ ।
প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্॥১৪॥
অনুবাদঃ আমি জঠরাগ্নি রূপে প্রাণীগণের দেহ আশ্রয় করে প্রাণ ও অপান বায়ুর সংযোগে চার প্রকার খাদ্য পরিপাক করি।

সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো
মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহনং চ ।
বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো
বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্ ॥১৫॥
অনুবাদঃ আমি সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত এবং আমার থেকেই স্মৃতি, জ্ঞান ও বিলোপ হয়। আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ।

দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ ।
ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কুটস্থোহক্ষর উচ্যতে ॥১৬॥
অনুবাদঃ ক্ষর ও অক্ষর দুই প্রকার জীব রয়েছে। এই জড় জগতের সমস্ত জীবকে ক্ষর, এবং চিৎ-জগতের সমস্ত জীবকে অক্ষর বলা হয়।

উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃত ।
যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ ॥১৭॥
অনুবাদঃ এই উভয় থেকে ভিন্ন উত্তম পুরুষকে বলা হয় পরমাত্মা, যিনি ঈশ্বর ও অব্যয় এবং ত্রিজগতের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে পালন করছেন।

যস্মাৎ ক্ষরমতীতোহহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ ।
অতোহস্মি লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ ॥১৮॥
অনুবাদঃ যেহেতু আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর থেকেও উত্তম, সেই হেতু জগতে ও বেদে আমি পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত।

যো মামেবমসংমূঢ় জানাতি পুরুষোত্তমম্ ।
স সর্ববিদ্ ভজতি মাং সর্বভাবেন ভারত ॥১৯॥
অনুবাদঃ হে ভারত ! যিনি নিঃসন্দেহে আমাকে পুরুষোত্তম বলে জানেন, তিনি সর্বজ্ঞ এবং তিনি সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করেন।

ইতি গুহ্যতমং শাস্ত্রমিদমুক্তং ময়ানঘ ।
এতদ্ বুদ্ধা বুদ্ধিমান্ স্যাৎ কৃতকৃত্যশ্চ ভারত ॥২০॥
অনুবাদঃ হে নিষ্পাপ অর্জুন ! হে ভারত ! এভাবেই সবচেয়ে গোপনীয় শাস্ত্র আমি তোমার কাছে প্রকাশ করলাম। যিনি এই তত্ত্ব অবগত হয়েছেন, তিনি প্রকৃত বুদ্ধিমান ও কৃতার্থ হন।
ওঁ তৎসদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে ‘পুরুষোত্তমযোগো’ নাম পঞ্চদশোঽধ্যায়ঃ

পঞ্চদশ অধ্যায়ে পরমেশ্বর ভগবানের পুরুষোত্তম স্বরূপের কথা আলোচনা করা হয়েছে বিধায় ইহা পুরুষোত্তমযোগ নামে আখ্যায়িত হয়েছে। তবে মাত্র বিশটি শ্লোকবিশিষ্ট এ অধ্যায়টির শুরুতেই একটি উপমার আশ্রয়ে এ জগত-সংসারকে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এই সংসাররূপ অশ্বত্থবৃক্ষটি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এই বৃক্ষের মূল উর্ধদিকে কিন্তু শাখা-প্রশাখা নিম্নদিকে। বাস্তব জগতে আমাদের এমন কোন বৃক্ষের কথা অভিজ্ঞতায় নেই যে বৃক্ষের মূল উর্ধদিকে এবং শাখা-প্রশাখা নিম্নদিকে থাকে। কিন্তু গীতাতে এমন অশ্বত্থবৃক্ষের কথা বলা হলো, কারণ বেদশাস্ত্রমতে এই জগৎ-সংসারের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে মূলতঃ ব্রহ্মলোকে। সেই অনাদির আদি পরমেশ্বর পরব্রহ্ম-ই হচ্ছে এসংসাররূপ বৃক্ষের সৃষ্টিকর্তা। কাজেই এ অশ্বত্থবৃক্ষের মূল উর্ধদিকে। ইহাকে ব্রহ্মবৃক্ষও বলা যায়। এই ব্রহ্মবৃক্ষ উর্ধমূল অর্থাৎ ব্রহ্মলোক থেকে মনুষ্যলোকে (অধঃলোকে) ধাবিত হয়েছে বিধায়ই ইহার শাখা-প্রশাখা অধোগামী। এই সংসারবৃক্ষকে তত্ত্বতঃ জানলে প্রকৃতপক্ষে জীব, জগৎ এবং ব্রহ্ম- এই তিন বিষয়েরই জ্ঞান জন্মে। কিন্তু জগতের সাধারণ মানুষ এই বৃক্ষের প্রকৃত স্বরূপ জানতে পারেনা। আর প্রকৃত স্বরূপ জানতে পারেনা বলেই জীব মায়াবদ্ধ থাকে, তার মুক্তিলাভ হয়না। সেকারণেই বৈরাগ্যরূপ অস্ত্র দ্বারা এই মায়াকে ছেদনপূর্বক পরমেশ্বরকে চিনে নেয়ার জন্য উপদেশ দেয়া হয়েছে। পরমেশ্বরের কথা বলতে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পুরুষোত্তম তত্ত্বেরও ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বললেন, জগতে সাধারণতঃ দু’শ্রেণীর পুরুষের কথা বিদিত। এদের একটি হচ্ছে ক্ষর পুরুষ এবং অপরটি হচ্ছে অক্ষর পুরুষ। কিন্ত শ্রীকৃষ্ণ জানালেন যে তিনি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর অপেক্ষা উত্তম, তাই তিনি পুরুষোত্তম। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে অক্ষর অপেক্ষাও উত্তম পুরুষ বলতে কি বুঝালেন সেকথাটি অনুধাবন করা প্রয়োজন। এজগতে যা কিছু জন্ম, বৃদ্ধি ও মৃত্যুর আবর্তনাধীন তাই ক্ষর শ্রেণীভূক্ত। ক্ষর পুরুষ জন্ম গ্রহণ করে, তার বৃদ্ধি ঘটে এবং একটি সময়ান্তে তার মৃত্যু ঘটে বা বিনাশপ্রাপ্ত হয়। অপরপক্ষে অক্ষর পুরুষ অজ, নিত্য ও শ্বাশত। ইহা জন্ম-মৃত্যুর অতীত, অব্যয়, অদৃশ্যমান, ব্রহ্ম সনাতন। কিন্তু পুরুষোত্তম যিনি তিনি ক্ষরের অতীত অর্থাৎ জড় জগতের পঞ্চভৌতিক জীবের ন্যায় জন্ম-মৃত্যুরমধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জগতে তাঁর আবির্ভাব ও অন্তর্ধ্যান সাধারণ জীবের জন্ম মৃত্যুর মত মনে হলেও তিনি মূলতঃ অজ ও অমর। লীলার কারণে তিনি জীবের ন্যায় আচরণ করেন মাত্র। কাজেই তিনি ক্ষর পুরুষের আওতাভূক্ত নন। আবার তিনি অক্ষর পুরুষের চেয়েও উত্তম, কারণ তিনি অব্যয় ও অক্ষর হওয়া সত্ত্বেও ইচ্ছানুযায়ী তিনি লীলা বিলাসের হেতু দেহধারণ করে ধরাধামে অবতীর্ণ হতে পারেন এবং হয়ে থাকেন। অক্ষর পুরুষ ক্ষর দেহধারণ করতে পারেন না, কিন্তু পুরুষোত্তম তাও করতে পারেন। একারণেই পুরুষোত্তম ক্ষর ও অক্ষর উভয় প্রকার পুরুষ অপেক্ষা উত্তম। এই পুরুষোত্তমবাদই মূলতঃ গীতার কর্ম, ভক্তি, ও জ্ঞানের মধ্যে সমন্বয়ের একটি ক্ষেত্র তৈরী করেছে। অতএব, যিনি ভগবানশ্রীকৃষ্ণকে পুরুষোত্তম বলে জানেন, তিনি-ই প্রকৃতপক্ষে সর্বজ্ঞ এবং তিনিই তাঁকে সর্বতোভাবে ভজনা করেন। জয় শ্রীকৃষ্ণ ।।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.