সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণকে ঘিরে বহুকাল থেকেই অনেক পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। শুধু ভারত নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গ্রহণ ঘিরে রয়েছে একাধিক ধর্মীয় ও সংস্কৃতিগত ‘বিশ্বাস’। আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকা বিশ্বের সর্বত্রই সূর্যগ্রহণ নিয়ে রয়েছে নানা পৌরানিক কাহিনি।প্রসঙ্গত, চাঁদ যখন পরিভ্রমণরত অবস্থায় কিছু সময়ের জন্য পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবীর কোন দর্শকের কাছে সূর্য আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য। এই ঘটনাকে সূর্যগ্রহণ বলা হয়। অন্যদিকে, যখন সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে চাঁদ অবস্থান নেয়, তখন পৃথিবীপৃষ্ঠের পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে সূর্য চাঁদের পেছনে আড়ালে চলে যায় এবং সূর্যের গ্রহণ ঘটে। আবার পৃথিবী যখন চাঁদ ও সূর্যের মধ্যে আসে তখন পৃথিবীর আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়ে এবং চন্দ্রগ্রহণ হয়।
সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণকে ঘিরে বহুকাল থেকেই অনেক পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। শুধু ভারত নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গ্রহণ ঘিরে রয়েছে একাধিক ধর্মীয় ও সংস্কৃতিগত ‘বিশ্বাস’। আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকা বিশ্বের সর্বত্রই সূর্যগ্রহণ নিয়ে রয়েছে নানা পৌরানিক কাহিনি। দেখে নেওয়া যাক, সেই সব কাহিনিকে। কোরিয়ানরা মনে করেন যে সূর্যকে চুরি করে নিয়েছে কোনও রাক্ষুসে কুকুর। কোরিয়ান লোক সঙ্গীতে এই নিয়ে বহু সুরও বাঁধা হয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার বেনিন ও টোগে উপজাতির মানুষরা বিশ্বাস করেন যে ‘গ্রহণ’ মানে সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে ক্রমাগত যুদ্ধ। তাঁদের আরও ধারণা যে একমাত্র পৃথিবীই এই যুদ্ধ মেটাতে সক্ষম। প্রাচীন গ্রিসের পৌরনিক কাহিনিতে মনে করা হত সূর্যগ্রহণের ঘটনা মানেই কোনও না কোনও দেবদেবী রুষ্ট হয়েছেন। যার ফলে কোনও দুর্যোগের আশঙ্কা করা হত। মূলত এই মহাজগতিক ঘটনাকে নেতিবাচক চোখে দেখা হত এখানে। অন্যদিকে,জ্যোতিষ মতে মনে করা হয় অনেকেরই কোষ্ঠীতেই গ্রহণ দোষ থাকে। কালসর্প,পিতৃদোষ, মাঙ্গলিকের মতো গ্রহণ দোষও একটি দোষ।
চন্দ্র গ্রহণ: পৃথিবী যখন চন্দ্র ও সূর্য-এর মধ্যে চলে আসে, তখন পৃথিবীর আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়ে এবং চন্দ্রগ্রহণ হয়। সূর্য একটি তারা বলে তার আলো পৃথিবীতে বাধা পায় এবং চাঁদ পৃথিবীর ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়। পৃথিবী চাঁদের চেয়ে বড় হওয়ায়, পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রপৃষ্ঠকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে। এই কারণে চন্দ্রগ্রহণ পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে পূর্ণগ্রাস হিসাবে দেখা যায়। এই পূর্ণগ্রাস বা আংশিকগ্রাস পৃথিবীর সকল স্থান থেকে একই রকম দেখা যায়। কিন্তু পৃথিবীর সকল স্থানে কোনো না কোনো সময় পূর্ণ বা আংশিক গ্রহণ দেখা যায়।
আদিম মানুষের কাছে চন্দ্রগ্রহণ এবং সূর্যগ্রহণ একটি রকমের কৌতুহলের বিষয় ছিল। বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা করার আগে, এ নিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা রকম গল্প সৃষ্টি হয়েছে। কালক্রমে তা ধর্মতত্ত্বে পৌরাণিক কাহিনি হিসেবে যুক্ত হয়েছে। যেমন, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে― সমুদ্রমন্থন শেষে উত্থিত অমৃত অসুরদের বঞ্চিত করে দেবতারা পান করেছিল। রাহু (দানব বিশেষ। দানব বিপ্রচিত্তির ঔরসে ও সিংহিকার গর্ভে এঁর জন্ম হয়) কৌশলে এবং গোপনে অমৃতপান করতে থাকলে, চন্দ্র ও সূর্য এঁকে চিনতে পেরে অন্যান্য দেবতাদের জানিয়ে দেয়। এই সময় বিষ্ণু এঁর দুই বাহু মাথা কেটে দেন। কিছুটা অমৃত পান করায় এই দানব ছিন্নমস্তক হয়ে অমরত্ব লাভ করেন। এঁর মস্তকভাগ রাহু ও দেহভাগ কেতু নামে পরিচিত। এরপর থেকে সুযোগ পেলেই রাহু চন্দ্র সূর্যকে গ্রাস করার জন্য অগ্রসর হয়। কিছুটা গ্রাস করতে সক্ষম হলেও তার কর্তিত দেহ থেকে চাঁদ-সূর্য বেরিয়ে আসে। রাহুর এই গ্রাসকালীন সময়ে চন্দ্র বা সূর্য গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
কখন দেখা যাবে?
গ্রহণ সময়
ভারতঃ
পৃথিবীতে গ্রহণ আরম্ভ প্রভৃতি-গ্রহণ স্পর্শ (আরম্ভ) দিবা ১২ টা ৪৮ মিনিট থেকে
গ্রহণ মধ্য দিবা ২ টা ৩৩ মিনিট
গ্রহণ মোক্ষ (সমাপ্তি) দিবা ৪ টা ১৭ মিনিট
গ্রহণের স্থিতিকাল ৩ ঘণ্টা ২৮ মিনিট ২৩ সেকেন্ড
গ্রাসমান ০.৯৭৯
উপচ্ছায়া স্পর্শ (প্রবেশ) দিবা ১১ টা ৩০ মিনিট
উপচ্ছায়া মোক্ষম (ত্যাগ) সন্ধ্যা ৫ টা ৩৬ মিনিট
বাংলাদেশঃ
পৃথিবীতে গ্রহণ আরম্ভ প্রভৃতি-গ্রহণ স্পর্শ (আরম্ভ) দিবা ১ টা ১৮ মিনিট থেকে
গ্রহণ মধ্য দিবা ৩ টা ৩ মিনিট
গ্রহণ মোক্ষ (সমাপ্তি) দিবা ৪ টা ৪৭ মিনিট
গ্রহণের স্থিতিকাল ৩ ঘণ্টা ২৮ মিনিট ২৩ সেকেন্ড
গ্রাসমান ০.৯৭৯
উপচ্ছায়া স্পর্শ (প্রবেশ) দিবা ১২ টা
উপচ্ছায়া মোক্ষম (ত্যাগ) সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট
এবারে চন্দ্রের রং হবে প্রায় রক্তের মতো লাল। তাই তার নাম ‘ব্লাড মুন’ বা ‘বিভার মুন’ও।
দীর্ঘক্ষণ খণ্ডগ্রাসের ব্লাড মুনের কারণ?
পৃথিবীকে চাঁদের প্রদক্ষিণ করার পথের আকার। পৃথিবীকে একটি উপবৃত্তাকার (‘ইলিপ্টিক’) কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চাঁদ। ফলে, প্রদক্ষিণের পথে কখনও একেবারে কাছে (‘পেরিজি’) আবার কখনও একেবারে দূরে (‘অ্যাপোজি’) চলে যায় চাঁদ। কাছে এলে পূর্ণিমার চাঁদের আকার বড় হয়। দূরে গেলে হয়ে যায় ছোট। শুক্রবারের পূর্ণিমার চাঁদ প্রদক্ষিণ-পথে পৃথিবী থেকে রয়েছে দূরে। এ বছরে সবচেয়ে দূরে। তাই শুক্রবারের পূর্ণিমার চাঁদ হবে এ বছরে সবচেয়ে ছোট আকারের।
কিভাবে দেখবেন?
সূর্যগ্রহণের মতো চন্দ্রগ্রহণ দেখতে কোনও আলাদা সতর্কতার প্রয়োজন নেই। খালি চোখেই এই গ্রহণ দেখা যেতে পারে। তাতে চোখের ক্ষতির কোনও আশঙ্কা নেই। তবে টেলিস্কোপের সাহায্যে এই গ্রহণ দেখলে নিঃসন্দেহে গ্রহণের সৌন্দর্য আরও তীব্র ভাবে ধরা পড়বে।
গ্রহণের কুপ্রভাব নিয়ে জ্যোতিষ শাস্ত্রের মতামতঃ
চন্দ্রগ্রহণ হয় একেবারেই বৈজ্ঞানিক কারণে। কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসে এই গ্রহণকে অনেকেই অশুভ বলে মনে করেন। এই সময় কোনও ধর্মীয় কাজ করা হয় না। ধর্মীয় বিশ্বাস মেনে অনেকেই গ্রহণ চলাকালীন শিব চালিশা পাঠ করেন এবং গ্রহণ শেষ হলে গঙ্গাজলে স্নান করেন। তারপর পুজোপাঠ করে দান করার রীতি রয়েছে।
গ্রহণের সময় কি করবেন না:
● শাস্ত্রে গ্রহণের সময় এবং গ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত দৈবমূর্তি স্পর্শ নিষিদ্ধ।
● বাড়ির মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া উচিত, যাতে ভগবানের ওপর গ্রহণের কোনও প্রভাব না-পড়ে।
● সূতক কাল এবং গ্রহণের সময় অশুভ শক্তির ক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়, তাই এ সময় নির্জন স্থান বা শ্মশানে যাওয়া উচিত নয়।
● সূতক লাগার পর কোনও শুভ কাজ করবেন না।
● গ্রহণের সময় চুল এবং নখ কাটবেন না। এন ছাড়া ভোজন বা জল গ্রহণও অনুচিত।
গ্রহণের পরে অবশ্যই যা যা করবেন:
● চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ সম্পর্কিত মন্ত্র জপ করা উচিত।
● গ্রহণ শেষ হলে স্নান করে শুদ্ধবস্ত্র পড়ে দান করা উচিত।
● গ্রহণ শেষ হলেই অন্য কোনও কাজ করবেন।
● গ্রহণ শেষ হলে সারাঘরে গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করা উচিত।
● কাছাকাছি কোনও মন্দিরে পুজো করে দান করুন।
● গ্রহণ শেষ হলে, গোরুকে রুটি খাওয়ানো শুভ।
● লক্ষ্মীর কৃপা প্রাপ্তির জন্য গ্রহণের পরে ইন্দ্রের পুজো করার বিধান রয়েছে।
● তুলসী চারার পাশে অবশ্যই প্রদীপ জ্বালাবেন। এতে বাড়ির পরিবেশ প্রাণোজ্জ্বল থাকে।
গ্রহণ এবং গর্ভাবস্থা – এটা কি গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ক্ষতিকর?
চন্দ্রগ্রহণের সময় গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পরামর্শ
বিশ্বাস করা হয় যে গর্ভবতী মহিলারা চাঁদের গ্রহনকালে সেট করা কিছু বিধিনিষেধ মেনে চললে তাদের এবং তাদের বাচ্চাদের ক্ষতি হয় না। চাঁদের গ্রহনকালে গর্ভবতী মহিলাদের পরামর্শ দেওয়া হয় এমন কিছু সাধারণ সতর্কতা হল:
● গ্রহণের সময় উপবাস।
● চন্দ্রগ্রহণের দিনে কিছু বুনন বা সেলাই না করা।
● আগের দিন রান্না করা হয়েছে এমন কিছু জিনিস রান্নাঘরে না রাখা।
● কাঁচি এবং ছুরির মত ধারালো বস্তু ব্যবহার করবেন না।
● দিনের বেলা সূর্যের আলোর রশ্মিতে উন্মুক্ত হবেন না। সূর্যালোক এড়াতে; ভারী পর্দা টানা উচিত, এবং জানালা খবরের কাগজ দিয়ে আচ্ছাদিত করা উচিত।
● গ্রহণের সময় ঘরের বাইরে যাবেন না।
● গর্ভবতী হলে হাত-পা মুড়ে বা বেঁকে ঘুমাবেন না।
● গ্রহণের সময় শরীর সোজা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
সতর্কতা অনুসরণ করার সময় মনে রাখার জিনিস
এটা খুব সম্ভব যে আপনাকে গ্রহণের সময় খাওয়া বা পান করা এড়াতে বলা হবে। এটি আপনার এবং আপনার শিশুর উপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারে। এটা ডিহাইড্রেশনের কারণ হতে পারে। গ্রহণের সময় এবং আপনার প্রবীণদের বিভিন্ন বিধিগুলি মানার সময় অপ্রয়োজনীয় নিয়মগুলি আপনাকে উদ্বিগ্ন এবং ভীত করে তুলতে পারে। এতে রক্তচাপ বৃদ্ধি হতে পারে যা আপনার শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ হতে পারে।
গ্রহণের সময় সতর্কতা অবলম্বন করার সময় আপনি নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখছেন কিনা তা নিশ্চিত করুন:
● মাথা ঘোরা
● গুরুতর মাথাব্যাথা
● অচেতন হওয়ার মত অনুভূতি
● অম্বল বা বদহজম
আপনি যদি এই উপসর্গগুলি লক্ষ্য করেন, অবিলম্বে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। একটি চন্দ্রগ্রহণের ঘটনা ঘটলে এবং আপনি সতর্কতাগুলি অনুসরণ করে থাকেন তবে অগ্রিম ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিন।