বৃক্ষ হয়েও তুলসী কেন জগৎপূজনীয়া? তুলসী পূজার আচার, প্রার্থনা ও আরতি।

তুলসী কোনো সাধারণ বৃক্ষ নয়। তিনি এ জড়জগতের উর্ধ্বে অবস্থিত চিন্ময় গোলোকবৃন্দাবন ধামে বসবাসরত  কৃষ্ণপ্রেয়সী এবং রাধাকৃষ্ণের নিত্য সেবিকা। তবুও জীবের প্রতি কৃপা করতে, বিশেষ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে  তিনি এজগতে বৃক্ষরূপে অধিষ্ঠত হয়েছেন। গঙ্গা-স্বরস্বতী যেমন মূর্তিমান দেবী হয়েও  একইসাথে  নদীরূপে বিদ্যমান, তেমনি তুলসী গোলোক নিবাসী গোপিকা হয়েও বিশ্বব্রহ্মান্ডে বৃক্ষরূপে  অবস্থান করছেন।মন্দির বা গৃহাঙ্গনে পবিত্র তুলসী বৃক্ষ রাখা হয়, তাঁর পূজা-পরিক্রমা করা হয়, গলায় তুলসীকাষ্ঠের মালা ধারণ করা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রাচীন সংস্কৃতি। কিন্তু কেন বৃক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তুলসীকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়, এ বিষয়টি অনেকেরই অজানা।সে বিষয়ে জানতে আমাদের নিবন্ধ পড়ুন(তুলসী মূলত কে?এই ভূমন্ডলে কীভাবে হলো তুলসীর আবির্ভাব?)।

তুলসী কীভাবে এই জগতে সকলের কাছে পূজনীয়া হয়ে উঠলেন সে বিষয়ে পৌরাণিক কাহিনীতে উল্লেখ রয়েছে। স্বামী শঙ্খচুরের মৃত্যুর পর শ্রীবিষ্ণুর বরে  তুলসী দেহত্যাগের পর দিব্যদেহ ধারণ করে গোলোকে শ্রীকৃষ্ণকে নিজের  পতিরূপে পাপ্ত হবেন;দেহ থেকে গন্ডকী নদী উৎপন্ন হবে আর  কেশ থেকে উৎপন্ন হবে  পবিত্র তুলসীবৃক্ষ। বিষ্ণু তাকে চিরসখী হিসেবে মর্যাদা দেন।সেই থেকে তুলসী ব্যাতিত নারায়ন পুজা হয়না।তুলসী বিষ্ণুকে অনুরোধ করেন, তাকে গৃহে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বিষ্ণু জানান, তার গৃহে লক্ষ্মী রয়েছেন, সেখানে তুলসী থাকতে পারেন না। ফলে তুলসীর স্থান হয় বাড়ির উঠোনে। সেখানে তিনি শ্রদ্ধার সাথে পূজিতা হন।তাই কেউ যদি তুলসী পূজাকে সাধারণ বৃক্ষপূজা বলে মনে করেন, তা নেহাৎ অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই না। তুলসী তাই জীবশিক্ষার উদ্দেশ্যে ভগবান শ্রীনারায়ণ স্বয়ং এ তুলসী পূজা প্রচলন করেন।সেই থেকেই জগতের সকলের কাছে তুলসী হয়ে ওঠে পরম পূজনীয়া।

 তুলসী পূজা প্রসঙ্গে শাস্ত্রে বহু প্রমাণ রয়েছে, যার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলোঃ

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ (প্রকৃতিখন্ড, ২২ অধ্যায়) অনুসারে

একসময় দেবী তুলসী অভিমানে অন্তর্হিত হলে,শ্রীহরি তুলসীবনে গমন করে তুলসীর পূজা ও স্তব করেন। তখন দেবী তুলসী বৃক্ষ হতে আবির্ভূতা হন এবং শ্রীহরির পাদপদ্মে শরণ নেন। সেখানে এও বলা হয়েছে, যে মানব হরিপ্রণীত মন্ত্ররাজ পাঠ করত ঘৃতপ্রদীপ, ধূপ, সিঁদুর, চন্দন, পুষ্প, নৈবেদ্য ও অন্যান্য উপহার দ্বারা যথাবিধি তুলসীর পূজা করবেন, তিনি সর্বসিদ্ধি লাভ করবেন।

 

পদ্মপুরাণের উত্তরখন্ডে অধ্যায় ২৩ এ আছে

মহাদেব নারদমুনিকে বলেন, “তুলসী সম্বন্ধীয় পত্র, পুষ্প, ফল, মূল, শাখা, ত্বক, স্কন্ধ এবং মৃত্তিকাদি সমস্তই পবিত্র। যে গৃহে তুলসী-বৃক্ষ বর্তমান, তার দর্শন-স্পর্শনেই ব্রহ্মহত্যাদি পাপ বিলুপ্ত হয়। যে যে গ্রহে, গ্রামে বা বনে তুলসী বৃক্ষ অবস্থান করে, শ্রীহরি সেই সেই ক্ষেত্রে বাস করেন।”

 

পদ্মপুরাণ সৃষ্টিখন্ডে (অধ্যায়-৬০)বলা হয়েছে

 সমস্ত পত্র পুষ্পর মধ্যে মঙ্গলময়ী তুলসীই সবচেয়ে পবিত্র।তুলসী সর্বমঙ্গলা, শুদ্ধা, বৈষ্ণবী, বিষ্ণুপ্রিয়া,  মুখ্যা এবং সর্বলোক মধ্যে পরম শুভা। যেখানে তুলসী বন, সেখানেই ভগবান কেশব (কৃষ্ণ) এবং সেখানেই ব্রহ্মা, কমলা (লক্ষী) ও অন্য সমস্ত দেবদেবীরা সন্নিহিত থাকে। অতএব, তুলসী দেবীকে সর্বদাই পূজা করবে।

 

তুলসী পূজার আচার, প্রার্থনা ও আরতি। 

     

তুলসী-প্রদক্ষিণ মন্ত্রঃ

যানি কানি চ পাপানি ব্রহ্মহত্যাদিকানি চ।

তানি তানি প্রনশ্যন্তি প্রদক্ষিণ পদে পদে ॥

অর্থাৎঃ মানুষ যখন শ্রীমতী তুলসীদেবীকে প্রদক্ষিণ করে, তখন প্রতি পদক্ষেপে তার কৃত  পাপকর্ম, এমন কি ব্রহ্মহত্যার পাপও বিনষ্ট হয়ে যায়। তারপরে বাঁ হাতে পষ্ণপাত্র ধারণ করে তা থেকে ডান হাত দিয়ে শ্রীমতি তুলসীদেবীকে জল সিষ্ণন করতে হয়।

 

তুলসী প্রণাম মন্ত্রঃ

ওঁ বৃন্দায়ৈ তুলসী দৈব্যৈ প্রিয়ায়ৈ কেশবস্য চ ।

বিষ্ণুভক্তি প্রদে দেবী সত্যবত্যৈ নমো নমঃ ॥

 

তুলসী জাগরণ মন্ত্রঃ

উত্তিষ্টং তুলসীদেবী গাত্রোত্থানাং কুরু যথা।

অরুণোদয় প্রাতঃ প্রীচরণে প্রণমাম্যহম্।।

 

তুলসী জলদান মন্ত্রঃ

ওঁ গোবিন্দবল্লভাং দেবীং ভক্তচৈতন্যকারিণীম্ ।

স্নাপয়ামি জগদ্ধাত্রীং কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনীম্ ॥

 

তুলসীর মূল লেপন মন্ত্রঃ

তুলসী নিপয়তে গঙ্গা স্থানেমেকং বারাণসী।

সেবনে পঞ্চতীর্থানি তুলসীভ্যাং নমো নমঃ।।

তুলসী ত্বং সদা ভক্তা সর্বতীর্থফলং ভবেৎ।

লেপনাৎ তব মূলঃ সর্বপাপৈ প্রমুচ্যতে।।

তন্মুলে সর্বতীর্থানি তৎপত্রে সর্বদেবতা।

তদঙ্গে সর্বপুণ্যানি কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনীং।।

তুলসী চয়ন মন্ত্রঃ

ওঁ তুলস্যমৃতজন্মাসি সদা ত্বং কেশবপ্রিয়া ।

কেশবার্থে চিনোমি ত্বাং বরদা ভব শোভনে ॥

 

তুলসীর স্তুতিঃ

মহাপ্রসাদ জননী সর্বসৌভাগ্যবর্ধিনী।

আধিব্যাধিহরি নিত্যং তুলসী ত্বং নমোহস্তুতে।।

 

তুলসীর ধ্যানঃ

তুলসী সর্বভূতানাং মহাপাতকনাশিনী।

স্বর্গাপবর্গদে দেবী বৈষ্ণবানাং প্রিয়ে সদা।।

সত্যে সত্যবতীচৈব ত্রেতায়াং মানবী তথা।

দ্বাপরে অবতীর্ণাসি বৃন্দা ত্বং তুলসী কলৌ।।

 

শ্রী শ্রী তুলসী আরতিঃ 

নমো নমঃ তুলসী ! কৃষ্ণপ্রেয়সী ৷

রাধাকৃষ্ণ-সেবা পাব এই অভিলাসী ৷৷

যে তোমার শরণ লয়, তার বাঞ্ছা পূর্ণ হয়,

কৃপা করি কর তারে বৃন্দাবন বাসী ৷

মোর এই অবিলাস, বিলাস-কুঞ্জে দিও বাস,

নয়নে হেরিব সদা যুগলরূপরাশি ৷৷

এই নিবেদন ধর, সখীর অনুগত কর,

সেবা অধিকার দিয়ে কর নিজ দাসী ৷

দীন কৃষ্ণদাসে কয়, এই যেন মোর হয়,

শ্রীরাধাগোবিন্দ প্রেমে সদা যেন ভাসী ৷৷

 

সোর্সঃউইকিপিডিয়া; পৌরাণিক অভিধান—রচনায় সুধীর চন্দ্র সরকার।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.