পরাক্রমী রাক্ষসরাজ বালি,বলিরাজের পিতার নাম বিরোচন। ইনি বিষ্ণুভক্ত হিরন্যাকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদের পৌত্র। এঁর দুটি স্ত্রী ছিল। এঁরা হলেন- বিন্ধ্যাবলি ও সুদেষ্ণা। দীর্ঘতমা মুনি বলিরাজের অনুমতিক্রমে সুদেষ্ণার গর্ভে পাঁচটি সন্তান উৎপন্ন করেন। এঁরা হলেন- অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম। এছাড়া এঁর আরও একশতটি পুত্র ছিল। এদের মধ্যে বাণ ছিলেন শ্রেষ্ঠ। তপস্যার দ্বারা ইনি অজেয় ও অমর হয়ে স্বর্গ আক্রমণ করেন এবং দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ ও পৃথিবীর অধিকর্তা হন।
প্রহ্লাদ ছিলেন পরম হরিভক্ত । বালি ছিলেন বিষ্ণুবিদ্বেষী । বিষ্ণুনিন্দা করার জন্য প্রহ্লাদ বালিকে অভিশাপ দিয়েছিলেন – ” বিষ্ণুনিন্দার জন্য রাজ্য হারাবে। তোমার দারুণ অধঃপতন হবে । ” বালি এতে ভয় পেয়ে বললেন – ” কি উপায় হবে , পিতামহ ? এমন শাপ কেন দিলেন ? ” প্রহ্লাদ বললেন – ” উপায় আবার কি ? শ্রীহরিতে ভক্তি জন্মালেই সব ফিরে পাবে ।”
প্রহ্লাদ হরিভক্ত ছিলেন – তাই বলে ইন্দ্রের প্রতি ক্ষোভ তাঁর কম ছিল না । দেবতাদের তিনি শত্রু বলেই মনে করতেন । একশ বছর ধরে প্রহ্লাদ দেবতাদের সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ চালান । বৃদ্ধ বয়সে প্রহ্লাদ পরাজিত হয়ে রাজত্ব ত্যাগ করেন । তিনি পৌত্র বালিকে রাজ্যে অভিষিক্ত করেন এবং গদ্ধমাদন পর্ব্বতে তপস্যার জন্য প্রস্থান করেন । বালি রাজা হয়ে দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে থাকেন । বালির অন্তরে বিষ্ণুভক্তি তখনও জাগে নাই । পিতামহের অভিশাপের ফল ফলল । ইন্দ্র বিষ্ণুর সহায়তায় বালিকে রাজ্যভ্রষ্ট করলেন। ইন্দ্রের ভয়ে বালি নানাস্থানে লুকাইয়া বেড়াইত। একবার তিনি গর্দ্দভের রূপ ধরে ভ্রমণ করতেছিলেন । ছদ্মরূপ ধরলেও তা দেবতাদের দৃষ্টি এড়ায় না । ইন্দ্র তাঁকে দেখেই চিনতে পারলেন এবং বললেন- ” হে দৈত্যরাজ , আজ না হয় তুমি রাজ্যহারা হয়েছ । তাই বলে এ কি দুর্গতি তোমরি ! ছি ছি ! কাপুরুষের মত তুমি একটা গর্দ্দভের মধ্যে আত্মগোপন ক’রে আছ ! বড়ই লজ্জার কথা । “
দৈত্যরাজ উত্তর দিলেন – ” এতে আর লজ্জা বা দুঃখ কি আছে? তোমাদের হত্তাকর্ত্তা বিধাতা বিষ্ণু মৎস , কূর্ম্ম , বরাহ ইত্যাদির রূপ ধরেছিলেন প্রয়োজনসিদ্ধির জন্য । তুমি নিজেও ব্রহ্মহত্যা করে মানস – সরোবরে পদ্মপাতার তলায় আশ্রয় নিয়েছিলে । আজ আমার দুর্দ্দিন – তাই আমাকে ধিক্কার দিচ্ছ । ইন্দ্র , আমার এদিন থাকবে না । চাকা উলটে যাচ্ছে । ইহলোকের ঐশ্বর্য্য , ধনসম্পদ আজ আছে , কাল নেই । তা নিয়ে গর্ব্ব করছ , কর । দু’দিন পরে তোমার দশাও এমনি হবে । ” দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্য বালিকে নানাস্থানে খুঁজতে লাগলেন। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলেন । তিনি বালিকে বিশ্বজিৎ যজ্ঞে অভিষিক্ত করলেন । সেই যজ্ঞের অগ্নিতে আহুতি দেওয়ামাত্রই ইন্দ্রের রথের মত একটি রথ , ইন্দ্রের অশ্বের মত অশ্ব , সিংহচিহ্নিত ধ্বজা , স্বর্ণময় ধনু , দিব্য কবচ ও দুইটি অক্ষয় বাণে পূর্ণ তূণ উত্থিত হইল । শুক্রাচার্য্য একটি বিজয়শঙ্খ দান করলেন ।
নবরূপে সজ্জিত হয়ে বালি দৈত্যসেনা নিয়ে প্রথমে পৃথিবীর রাজ্য অধিকার করলেন ও তারপর স্বর্গরাজ্য – জয়ের জন্য যাত্রা করলেন । দেবগণ ভীত হয়ে দেবগুরু বৃহস্পতির শরণ নিল। বৃহস্পতি বললেন – ” তোমরা যুদ্ধ করতে যেও না । তোমরা এখন দুর্ব্বল । শুক্রাচার্য্য সঞ্জীবনী বিদ্যার দ্বারা দৈত্যদের বাঁচিয়ে দেবে । তা ছাড়া, দুর্ব্বাসার অভিশাপ তোমাদের উপর চলছে । তোমরা সব স্বর্গ হতে সরে পড় । মর্ত্তলোকে গিয়ে মানুষ ও জীবজন্তুর মধ্যে লুকিয়ে থাক ।” বালি বিনাযুদ্ধে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে নিলেন । এভাবে অসুর বালি নিজেকে শক্তিশালী করে স্বর্গ, মর্ত্য আর পাতালের অধীশ্বর বানিয়ে নিয়েছিলেন | সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠেছিলেন খুব অহংকারী , তবে তিনি খুব দানবীর ও ছিলেন |
তিন লোকের সম্রাট হলেন বালী | তাঁর গুরু ছিলেন স্বয়ং শুক্রাচার্য | তাঁর পরামর্শে রাজা বলীর খ্যাতি দশ দিকে বিকশিত হল | শুক্রাচার্য্য বালিকে স্থায়ীভাবে রাজত্ব দেয়ার জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলেন। তখন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্য বালিকে আদেশ দিলেন একশত অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভ করার জন্য। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্যের উপদেশে বালি একশত বার অশ্বমেধ যজ্ঞ করলেন ।
দেবগুরু বৃহস্পতি দেবতাদের উপদেশ দিলেন – ” দেখ , সমুদ্রমন্থন করে অমৃত উদ্ধার করতে না পারলে আর দৈত্যদের তাড়ানো যাবে না । অমৃত পেলে তোমরা অমর হয়ে যাবে । শুক্রাচার্য্যের সঞ্জীবনী বিদ্যা তখন বেশি অনিষ্ট করতে পারবে না । সমুদ্রমন্থন খুব দুরূহ কাজ । তোমরা একা পারবে না – দৈত্য ও দেবতা দুই দলে মিলে মন্থন করতে হবে । বালির কাছে গিয়ে প্রস্তাব করো । ওদের সাহায্যে সমুদ্রমন্থন ক’রে অমৃত উঠলে ফাঁকি দিয়ে তোমরা অমৃতভাণ্ডটা অধিকার করে নিতে পারবে । বিষ্ণুর সঙ্গে পরামর্শ কর । ” দেবগণ বালির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমুদ্রমন্থনের প্রস্তাব করলেন। বালি সম্মত হলেন । দেবতারা দৈত্যদের সঙ্গে যোগ দিয়া সমুদ্রমন্থন করে অমৃত অধিকার করলেন । তাহাতে দেবাসুরে সংগ্রাম ঘোরতর হয়ে উঠিল । দেবতারা কিছুতেই স্বর্গরাজ্য হতে দৈত্যদের আড়াতে পারলেন না।
ইন্দ্রের অভিশাপ প্রাপ্তিঃ
বিভিন্ন পৌরাণিক সূত্র অনুযায়ী দুর্বাসা-ইন্দ্র সাক্ষাতই অনুঘটক ছিল সমুদ্রমন্থনের | একদিন ভ্রমণ করছিলেন দুর্বাসা | সাক্ষাত্ হল অপ্সরা বিদ্যাধরীর সঙ্গে | অপ্সরার কণ্ঠে এক অপূর্ব পুষ্পহার দেখে মুগ্ধ হলেন দুর্বাসা | স্বর্গীয় সেই কণ্ঠহার তাঁকে দিয়ে দিলেন অপ্সরা | ওটা গলায় পরেই পদব্রজে এগোচ্ছিলেন ঋষি | এ বার দেখা হল ঐরাবতে আসীন দেবরাজ ইন্দ্রর সঙ্গে | তাঁকে ওই কণ্ঠহার উপহার দিলেন দুর্বাসা | কোথায় রাখবেন বুঝে না পেয়ে সেটা ঐরাবতের মাথায় রাখলেন ইন্দ্র | এদিকে ফুলের গন্ধ মোটেও ভাল লাগল না ঐরাবতের | সে মাথা ঝাঁকিয়ে ফেলে দিল পুষ্পহার | পা দিয়ে পিষ্ট করে দিল সেটা | তাঁর দেওয়া উপহারের এই পরিণতি দেখে দুর্বাসা তো সীমাহীনভাবে ক্ষুব্ধ | তিনি অভিশাপ দিলেন যে একদিন স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত হবেন ইন্দ্র | দেবরাজের বহু অনুনয়েও কাজ হল না | দ্রবীভূত হল না দুর্বাসার মন | সত্যি তাঁর অভিশাপে স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করল অসুররা | উপায় না দেখে ব্রহ্মার পরামর্শে বিষ্ণুর কাছে গেলেন দেবতারা | তখন বিষ্ণু পরামর্শ দিলেন সমুদ্রমন্থন করে অমৃতকুম্ভ তুলে আনতে | ফলে কার্যত দুর্বাসার অভিশাপেই অমরত্ব পেয়েছিলেন দেবতারা |
দেবমাতা অদিতি ও বিষ্ণুঃ
পুত্র ইন্দ্রকে বিমর্ষ দেখে ব্যাকুল হলেন অদিতি | জানতে চাইলেন কারণ | সব শুনে আশ্বাস দিলেন‚ পুত্রের সিংহাসন ফিরিয়ে দিতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন | কোনও পথ না পেয়ে দেবমাতা অদিতি বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন | ভগবানকে তিনি বললেন‚”বালী হয়তো যোগ্য | কিন্তু তারপর? বংশানুক্রমিক ভাবে স্বর্গরাজ অসুরদের করায়ত্ত হয়ে গেলে তো রসাতলে যাবে | বৎস , তুমি ছাড়া ত আমার ছেলেদের আর স্বর্গরাজ্য ফিরে পাওয়ার উপায় দেখছি না । তুমি একটা উপায় কর ।” এবার বালীর কাছ থেকে সিংহাসন ইন্দ্রকে ফিরিয়ে দিতে রাজি হলেন বিষ্ণু | বিষ্ণু বললেন- “মা , প্রতিকার করবার জন্য তোমার গর্ভেই আমি একবার জন্ম নেব । তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে যাও । এবার আমি বামন হয়ে জন্মাব । ” শ্রীবিষ্ণু অদিতির গর্ভে বামনরূপে জন্ম নিলেন । ঋষি কশ্যপ এবং অদিতির ঘরে জন্ম নিল এক পুত্রসন্তান | ঘোর কৃষ্ণবর্ণ‚ কিন্তু মুখের হাসি স্বর্গীয় | দেবোপম সেই শিশু কিন্তু বড় হল খর্বকায় রূপেই | তিনি দ্বাদশ আদিত্যের অন্যতম। ইনি ইন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রূপেও পরিচিত।
শততম অশ্বমেধ যজ্ঞঃ
কয়েক বছর পরের কথা । নর্ম্মদাতীরে ভূগুকচ্ছ নামক স্থানে বালি শততম অশ্বমেধ যজ্ঞটি শুরু করলেন । এটি সম্পন্ন হয়ে গেলেই ইন্দ্র আর তাঁর কাছ থেকে সিংহাসন ফিরিয়ে নিতে পারবেন না | সে যজ্ঞে বালি যে যাহা চাইতেছিল , তাহাই দান করতেছিল বালী। খর্বাকার বামনদেব সেই যজ্ঞস্থলে বাঁশের ছাতা হাতে নিয়ে অতিথি হয়ে রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন | তাঁর জ্যোতিতে ম্লান হয়ে গেল চারদিক | মুগ্ধ বলীরাজ বামনদেবকে সমাদর করে পাদ্য – অর্ঘ্য দিয়া অভ্যর্থনা করে জিজ্ঞাসা করলেন – ” হে ব্রাহ্মণ , আপনার প্রার্থনা কি ? যা চান তা- ই পাবেন । ” বামন বললেন- ” আমার প্রার্থনা সামান্য । আমি ধনরত্ন চাই না ,আমি চাই সামান্য ত্রিপাদ ভূমি । ” বালি তা দিতে সম্মত হন |
শুক্রাচার্য্য দেখেই বুঝলেন – এই বামন নিশ্চয় ছদ্মবেশী বিষ্ণু । উদ্দেশ্য ভাল নয় । বালিকে তিনি বললেন – ” মহারাজ , সাবধান ! এই বামন যা চাইবে , তা – ই দিতে সম্মত হবেন না । এই বামন এসেছে আপনার সাথে ছলনা করতে । ” গুরুর সাবধানবাণী শুনলেন না বালী | বালি বললেন – ” বিষ্ণু যখন তাঁর কাছে কিছু চাইতে এসেছেন‚ তখন বাকি সব তুচ্ছ | আমি যখন অঙ্গীকার করেছি , তখন ইনি যা চান , তা – ই দেব । যদি ইনি স্বয়ং বিষ্ণুই হন তাহলে তো স্বয়ং সমগ্র সংসার কে আশীর্বাদ প্রদানকারী ভগবান বিষ্ণুকেও হাত পেতে ভিক্ষা চাইতে হয়েছে। দানীর হাত সবসময় উপরেই থাকে গুরুদেব। ”
দান করিবার আগে আচমন করতে হয় । আচমনের জল যাতে বালি না পান , সেজন্য শুক্রাচার্য্য বালির ভূঙ্গারের মধ্যে প্রবেশ করে জলরোধ করলেন । ভূ্ঙ্গার ভরা , অথচ জল পড়ে না ! তখন বামন একটি কুশ নিয়া ভূঙ্গারের নলের মধ্যে খোঁচা দিলেন – তাহাতে শুক্রাচার্য্যের একটি চোখ অন্ধ হয়ে গেল । সেই থেকে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্যের একচোখ অন্ধ। যাই হোক , বালি আচমন করে দানে উদ্যত হলেন ।
বামনদেব তখন বিশ্বরূপ ধারণ করলেন । এক পায়ে তিনি পৃথিবী , অন্য পায়ে তিনি স্বর্গ আক্রমণ করলেন । তাঁহার নাভিদেশ হইতে তৃতীয় একটি চরণ নিঃসৃত হল। বামনদেব বললেন – ” এই পদটি কোথায় ফেলব , দৈত্যরাজ ? ”
তখন রাজা বালি সমস্ত বুঝতে পারেন। প্রহ্লাদের পৌত্র বালি , রক্তের মধ্যে হরিভক্তি ছিল – সেই ভক্তির চরম নিদর্শন দেখানোর সময় উপস্থিত। এরপর তিনি বিষ্ণুর সামনে নিজের মস্তক নত করে সেখানে বামনরূপী বিষ্ণুর তৃতীয় চরণ রাখার অনুরোধ করেন বালি। তৃতীয় পদ বালির মাথায় রাখার সাথে সাথে বালি বিষ্ণুর স্তব করতে থাকেন। এমন সময় প্রহ্লাদ এসে বালি বন্ধন মুক্তির জন্য অনুরোধ করলে, বিষ্ণু বালিকে মুক্তি দেন এবং বালি সত্য রক্ষার জন্য বহুকষ্ট স্বীকার করেছেন বলে- বিষ্ণু দেবতাদের দুষ্প্রাপ্য পাতললোককে তাঁর বাসের জন্য দান করেন এবং সেখানকার রাজা ঘোষণা করেন। দেবতারা বামনের ছলনায় স্বর্গরাজ্য ফিরিয়া পেলেন। শ্রী হরিও চিরদিনের জন্য বলির কাছে বন্দী হয়ে রইলেন । পাতালে গিয়ে সেখানেও সুশাসন প্রবর্তন করলেন বালী | ভক্ত বালীর রাজ্যে গিয়ে দ্বারপালের কাজ করেন স্বয়ং বিষ্ণু | এমনকী‚ সেখানে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন মা লক্ষ্মীও | দুজনের আশীর্বাদে ধন্য হয় বালীর পাতালরাজ্য | স্বর্গ ছেড়ে পাতালে গিয়েও কোনও অনুতাপ ছিল না বালীর | আরাধ্য দেবতার সেবা করতে পেরে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন |