ষষ্ঠী দেবী হলে একজন হিন্দু দেবী, যাকে নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারতে শিশুদের কল্যাণদাতা এবং রক্ষাকর্তা হিসেবে পূজা করা হয়। তিনি সন্তানদাত্রী ও তাহার রক্ষাকর্ত্রী দেবী; তার কৃপায় নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তান লাভ হয় এবং তিনিই সন্তানের রক্ষাকর্ত্রী, পুরাণ মতে যেহেতু তিনি আদিপ্রকৃতির ষষ্ঠাঙ্গ অংশভুতা তাই তাহার নাম ষষ্ঠী দেবী। সম্পূর্ণ বঙ্গ ও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ষষ্ঠী দেবীর নামে বহু কঠিনতঃ ও সরল দুই প্রকারেই ব্রত প্রচলিত আছে। বিহার সীমান্ত উত্তরপ্রদেশ কিছু অঞ্চল সম্পূর্ণ বিহার ও মিথিলাঞ্চলে এই ষষ্ঠীদেবী ও সূর্য্যদেবতারই উদ্দেশ্যে চৈত্র ও কার্তিক শুক্লা ষষ্ঠী তে ছট্-পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সেইখানের লোক ভাষাতে দেবীকে ছঠী-মাই বলে সম্বোধিত করা হয়। এই ব্রত বিহার ও মিথিলাঞ্চলের গৃহস্থদের সবথেকে কঠিনতম ব্রতের মধ্যে অন্যতম।
ভাদ্রমাসের শুক্লা পক্ষের ষষ্ঠীতে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয় চাপড়া ষষ্ঠী ব্রত। সন্তান কামনায় এবং সন্তান-সন্ততি যাতে সুস্থ ও ভাল থাকে তার জন্য বিবাহিতা নারীরা এই ব্রত পালন করে থাকেন।
বাংলা বছরের প্রায় সব মাসেই ষষ্ঠীদেবীর পূজা করা হয়ে থাকে। নানা রকম নামে তাকে পূজা করা হয়ে থাকে। ভাদ্র মাসে চাপড়াষষ্ঠী বা মন্থন ষষ্ঠীর পূজা করা হয়। তবে মূলত প্রকৃতি ফলবতী হওয়ার কামনায় উদযাপন করা হয়ে থাকে।
চাপড়া ষষ্ঠী কিভাবে পালন করা হয়ঃ
ষষ্ঠীদেবীর পূজা সাধারণত বটগাছতলায়, বাড়ির আঙিনায়, নদী বা পুকুরের ধারে হয়ে থাকে। অনেক গ্রামে বট-অশ্বত্থ বৃক্ষমূলে ‘ষষ্ঠীতলা’ বলে নির্দিষ্ট স্থানে বিভিন্ন ষষ্ঠীদেবী নির্দিষ্ট তিথিতে পূজিতা হন। মূলত গৃহস্থ নারীরা তেল-হলুদ-দই, ঘট, বটের ডাল ইত্যাদি উপকরণের মাধ্যমে পূজা নির্বাহ করে থাকেন, পূজাশেষে ‘ব্রতকথা’ শ্রবণ করে স্নান সেরে বাড়ি ফিরে ফলাহার করেন।বটতলাই হলো ষষ্ঠীর আটন।এই কারণে তাকে বটবিটপবিলাসী বলা হয়েছে।বর্ণহিন্দু নবশাখ গোষ্ঠীর মহিলারা ষষ্ঠীর ব্রত করলেও তথাকথিত অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের রমণীরা শুধুমাত্র অরণ্য ও শীতলা ষষ্ঠী ব্রত পালন করেন।তবে সন্তান প্রসব করার ছয় দিন পরে ষেটেরা বা ষষ্ঠীপুজো গ্রামাঞ্চলের হিন্দুমাত্রই পালন করে থাকেন।মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্যে শিশুজন্মের পর ষেটেরা ,আটকলাই, নর্তা, একতির্সা প্রভৃতি উৎসব পালন করার বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।শিশু জন্মের ছয় দিনের মাথায় গো-ভাগার থেকে গো-মুন্ড নিয়ে এসে আঁতুরঘরের দরজায় পোঁতা হতো।এখন আর লোকাচারটি পালিত না হলেও এই দিনে প্রথম মায়ে-ছা’য়ে স্নান করার বিধি আছে।বারো মাসেই ষষ্ঠীব্রত পালন করার বিধি।যেমন বৈশাখমাসে ধূলাষষ্ঠী।জষ্ঠিতে অরণ্য।আষাঢ়ে কোড়া।শ্রাবণে নোটন,ভাদ্রে মন্থন বা চাপড়া। আশ্বিনে দুর্গা ষষ্ঠী।কার্তিকে গোটা,অঘ্রানে মূলা,পৌষে পাটাই। মাঘমাসে শীতলা।ফাল্গুনে অশোক আর চৈত্রে নীলষষ্ঠী। অরণ্যষষ্ঠীর পুজোর উপকরণে বিস্মৃত যুগের উপাচার। সাতটি সতেজ বাঁশপাতা,গোটা ফল ৫-৭ টি।তালেরপাখা একটি।একগুচ্ছ দূর্বাঘাস।দই-হলুদ-তেল।ষষ্ঠীর ডোর বা সুতো। যে সব মহিলাদের কন্যাসন্তান হয়েছে ও প্রথম ষষ্ঠী ব্রত পালন করবেন তাদের লাগবে সাতটি ডালি।তাতে সাতটি গোটা ফল ও সাতটি তালের পাখা।আর পুত্রসন্তান হলে লাগবে ৯টি পাখা ও ডালি।পুজোর পর ঐ ডালিগুলি বাচ্ছাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে।দই তেল হলুদের যাদু ফোঁটা দেবেন মা তাদের সন্তানের ও জামাতার কপালে।কেউ অনুপস্থিত থাকলে তার উদ্দেশে প্রতীকী ফোঁটা পড়বে বাড়ির বড়ঘরের দরজার বাজুর উপরে।এই পুজো যে প্রজননের ও সতেজও জীবনের কামনায় তা বোঝা যায় পুজোর উপকরণ দেখে।তবে তালপাখার বিষয়ে অন্য কাহিনি আছে।জষ্ঠি মাসের তাপ দগ্ধ দহনে পুড়ে খাক মাঠ-ঘাট বন-বাদাড়।মেয়েরা বৃষ্টি কামনায় , উত্তম ফসল প্রাপ্তির আশায় বনে গিয়ে গান গেয়ে আর পুজো দিয়ে বনদেবীকে সন্তুষ্ট করতো।যাতে নেমে আসে বৃষ্টি।নারী আর কৃষি যখন সমার্থক হয়ে উঠলো তখন থেকেই অরণ্যের দেবী হয়ে উঠলেন প্রজননের দেবী।নারীর ফসল অর্থাৎ সন্তান রক্ষয়িত্রী।রাঢ় অঞ্চলে তাই শুধু মায়েরাই ষষ্ঠীর ব্রত করেন না কৃষি জমির ও ষষ্ঠীপুজো হয় ।এর নাম গাবরষষ্ঠী।ভাদ্র সংক্রান্তিতে ধানের জমির এক কোনে এই গাবর ষষ্ঠীর পুজো আজও পালিত হয়।রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্ব থেকে জানা যায় জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা তিথিতে মহিলারা অরণ্যে গিয়ে পাখা হাতে বিন্দ্যবাসিনী স্কন্দ ষষ্ঠীর পুজো করতো।এ পুজো গ্রামের বা বাড়ির ভিতরে হতো না ,বনভূমি বা অরণ্যের মধ্যেই নিস্পন্ন হতো।এই কারণেই এর নাম অরণ্যষষ্ঠী।একসময় শশুড়বাড়িতে অধিকাংশ বউ’র কপালে জুটতো লাঞ্ছনা গঞ্জনা।তার উপর যদি বউ’র বাচ্ছা কাচ্ছা না হতো অত্যাচারের মাত্রাটি কোথায় গিয়ে পৌঁছাত সহজেই অনুমান করা যায়।এই কারণেই জামাইকে তোয়াজ করার বিষয়টি এসে পড়ে।তাছাড়া শশুড় শাশুড়ির কাছে জামাতাও পুত্র।সারা বছরে ষষ্ঠী পুজোয় নিজের সন্তানদের মঙ্গল কামনাই হয়ে ওঠে মুখ্য। বেচারা জামাই থাকে বাইরে।তাই শুধু মাত্র অরণ্যষষ্ঠীতেই জামাইদের এই স্পেশাল খাতির।কোন কোন গবেষক আবার মনে করেন জষ্ঠিমাসের কৃষ্ণপক্ষের সাবিত্রী চতুর্দশী তিথিতে স্ত্রীরা স্বামীদের দীর্ঘজীবন কামনা করে যমের আরাধনা করতেন। এই লোকাচারটির সূত্র ধরেই কলকাতার বাবু সংস্কৃতিতে নাকি জামাই ষষ্ঠীর অনুপ্রবেশ। বাল্যবিবাহ-সতীদাহ ইত্যাদি ঘটনার অনুষঙ্গ ধরেই হয়তো এক সময় খুব স্বাভাবিক ভাবেই শাশুড়িমাতা জামাইবাবা জীবনের দীর্ঘজীবন কামনা করতেন।
চাপড়া ষষ্ঠী কেন পালন করা হয়ঃ
এক দেশে এক সওদাগর আর তার স্ত্রী তাদের তিন ছেলে বউ আর নাতিনাতনি নিয়ে বাস করত। সওদাগর বেশ ধনী ছিল। সব নাতিনাতনির মধ্যে ছোট বউয়ের ছেলেকে পরিবারের সবাই একটু বেশি ভালোবাসতো। একবার ভাদ্র মাসে ষষ্ঠী পূজার সময় সওদাগরের স্ত্রী তাকে বলল, বউ-ছেলেপুলে নিয়ে অন্যদের পুকুরে ষষ্ঠী পূজা দিতে যেতে ভালো লাগেনা। যদি নিজেদের পুকুর থাকত ,কত ভালো হতো, এই কথা শুনে সওদাগর তার বাড়ির সামনে মজুর ডাকিয়ে বড় করে পুকুর কাটালো ও তার চারদিকে ঘাট বাঁধিয়ে নানা গাছ লাগিয়ে দিল। কিন্তু পুকুরে একফোঁটাও জল উঠল না। তাই দেখে সওদাগর আর তার পরিবার খুব দুঃখ পেল। আর পাড়ার লোকেদের মধ্যে একজনের কান থেকে অন্যজনের কানে দেওয়া শুরু করল। তারা আলোচনা করতে লাগল, “ওরা নিশ্চয়ই পাপী লোক, তাই ওদের পুকুরে জল উঠছে না। এসব কথা শুনে সওদাগর মনে মনে মা ষষ্ঠীকে ডাকতে থাকল।”
একরাতে সওদাগর স্বপ্ন দেখল মা ষষ্ঠী তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলছেন, কাল তো ষষ্ঠী, তুই তোর যে ছোট নাতিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিস তাকে কেটে, সেই রক্ত যদি পুকুরে ছড়িয়ে দিতে পারিস তাহলে এই পুকুরে জল উঠবে।
ঘুম ভেঙ্গে সওদাগর হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। গিন্নিকে সব কথা জানাল, সকালে নিজের কাজ সেরে ছোট নাতিকে কাছে নিয়ে এল তাকে খুব আদর করে নিজের মনকে শক্ত করে ভাবল মা ষষ্ঠীর আদেশ পালন করতেই হবে। মায়ের দয়া হলে আবার মা নাতিকে ফিরিয়ে দেবেন এই আশায়, ভরসায় সে তার ছোট নাতিকে কেটে তার রক্ত পুকুরে দিয়ে দিল। দেখতে দেখতে তখনই পুকুরের চারদিকে ভরে গেল জলে। সওদাগর তাড়াতাড়ি গিন্নিকে ডেকে আনল। তারপর পুরোহিত ডেকে পুকুর প্রতিষ্ঠিত করল। সেদিন ছিল ষষ্ঠী। তারা সবাই মিলে ঘাটে ষষ্ঠী পূজা করতে বসল। পূজার শেষে ব্রত কথা শুনে সবাই তার ছেলের নাম করে পিটুলির বিগ্রহ ও চাপড়া জলে ভাসাল, আর নিজে নিজের ছেলের নাম করে বলল- চাপড়া গেল ভেসে অমুক এল হেসে।
অমনি ছোট বউয়ের ছেলে তার আঁচলে টান দিতেই জলের ভিতর থেকে উঠে এল তার ছেলে। তারপর ছোট বউ তার ছেলের গা মুছিয়ে কোলে বসিয়ে খুব আদর করল কিন্তু কীভাবে সে জলের ভেতর থেকে উঠে এল জিজ্ঞেস করলে ছেলে কিছু বলল না। এরপর সওদাগর তার স্বপ্নের কথা সবাইকে জানাল।
ছোট বউ ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। পরে চেতনা ফিরলে সে মা ষষ্ঠীকে প্রণাম করে খুব কাঁদল। তারপর তিন বউ মিলে মা ষষ্ঠীর খুব নাম জপ করল। তাদের ছেলে কেটে তার রক্তে পুকুরের জল ওঠা আবার মা ষষ্ঠীর কৃপায় ছেলেকে ফিরে পাবার গল্প চারিদিকে প্রচার হতে লাগল। সওদাগর আর তার পরিবার আনন্দের সাথে চাপড়া ষষ্ঠী ব্রত কথা ,তার মহিমা চারিদিকে প্রচার করতে লাগল।
সেই থেকে এই চাপড়া ষষ্ঠীর ব্রতের মাহাত্ম্য কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
আরো আপডেট পেতে
Bangla Panjika 2023 Paji 1430 Download করুন
For Bangla Calendar, Bangla Panjika, Bengali Calendar, Horoscope download Bangla Panjika 2023 Paji 1430