আদ্যাশক্তি মহামায়ার অনন্ত তাঁর রূপ, অনন্ত তাঁর বৈচিত্র্য, অনন্ত তাঁর বৈভব। তাঁর কোন নিদিষ্ট মূর্তি নেই। সাধকের কল্যাণার্থে বিভিন্ন রূপে তিনি প্রকাশিত হন। মা আদ্যাশক্তির অনন্ত রূপের মধ্যে বঙ্গদেশে খুবই জনপ্রিয় পূজিত বিগ্রহ হলেন দেবী মনসা। যিনি মহাজ্ঞানযুক্তা, জ্ঞানিদের প্রধানা, শ্রেষ্ঠা, সিদ্ধগণের অধিষ্ঠাতৃদেবী, সিদ্ধিস্বরূপিনী এবং সিদ্ধিদায়িণী। পৌরাণিক এবং লৌকিক দুটি উৎসেই অসংখ্য গল্প কাহিনী রচিত হয়েছে দেবীর মাহাত্ম্যকে কেন্দ্র করে। দেবী মনসা যে ব্রহ্মস্বরূপিনী আদ্যাশক্তি; বিষয়টি দেবীভাগবতের নবমস্কন্ধের আটচল্লিশতম অধ্যায়ের শুরুতেই আমরা এর উল্লেখ পাই। সেখানে বিস্তারিত দেবীমাহাত্ম্য বর্ণিত আছে।
শ্বেতচম্পকবর্ণাভাং রত্নভূষণভূষিতাম্।
বহ্নিশুদ্ধাংশুকাধানাং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।।
মহাজ্ঞানযুতাং তাঞ্চ প্রবরজ্ঞানিনাং বরাম্।
সিদ্ধাধিষ্ঠাতৃদেবীঞ্চ সিদ্ধাং সিদ্ধিপ্রদাং ভজে।।
(দেবীভাগবত: নবমস্কন্ধ, ৪৮.২-৩)
“যাঁর দেহের বর্ণ শ্বেতচম্পক ফুলের মত শুভ্র, অঙ্গে বিবিধ প্রকারের রত্নভূষণ শোভা পাচ্ছে, যিনি অগ্নিবর্ণের রক্তিম বস্ত্র পরিধান করে আছেন; যিনি মহাজ্ঞানযুক্তা, জ্ঞানীদের প্রধানা, শ্রেষ্ঠা, সিদ্ধগণের অধিষ্ঠাতৃদেবী, সিদ্ধিস্বরূপিনী এবং সিদ্ধিদায়িনী তাঁর সদা ভজনা করি।”
স্বয়ং প্রকাশিতা আদ্যাশক্তি দেবী নাগ ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত জীবদের রক্ষার্থে পুরাকালে আবির্ভূত হন। নাগের আক্রমণ হতে রক্ষার জন্যে, কশ্যপ মুনি মানব রক্ষায় যখন চিন্তিত মনে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন, তখন কাশ্যপ মুনির চিন্তিত মনের মাঝেই দেবী প্রকাশিত হন। তাঁর কোন জন্ম নেই, জীবদের রক্ষার্থে তিনি আবির্ভূত হয়ে রক্ষা করেন, লীলা করেন।অনন্ত রূপধারিণী লীলাময়ী তিনি। চিন্তার অতীত তাঁর স্বরূপ, তিনি যতটা কৃপা করে জানান ; মায়াবদ্ধ জীব ততখানিই তাঁকে জানতে পারে।
পুরা নাগভয়ক্রান্তা বভূবুর্মানবা ভুবি ।
গতাস্তে শরণং সর্বে কশ্যপং মুনিপুঙ্গবম্ ।।
মন্ত্রংশ্চ সসৃজ্যে ভীতঃ কশ্যপো ব্রহ্মণান্বিতঃ ।
বেদবীজানুসারেণ চোপদেশেন ব্রহ্মণঃ ।।
মন্ত্রাধিষ্ঠাতৃদেবীং তাং মনসা সসৃজ্যে তথা ।
তপসা মনসা তেন বভূব মনসা চ সা ।।
(দেবীভাগবত: নবমস্কন্ধ, ৪৮.১১-১৩)
“পুরাকালে পৃথিবীতে নাগের ভয়ে ভীত হয়ে মনুষ্যগণ জীবন রক্ষার্থে মুনিশ্রেষ্ঠ কশ্যপের শরণাপন্ন হন। ভীত মনুষ্যদের বর্ণনা শুনে, কশ্যপ মুনিও ভীত হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। তখন ব্রহ্মার আদেশে কশ্যপ মুনি নাগভয় থেকে মুক্তির জন্য এক বেদোক্ত বীজ অনুসারে জপ-ধ্যান শুরু করলেন। তৎকালে মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা ধ্যানরত কাশ্যপ মুনির মন হতে আবির্ভূত হলেন; তাই তাঁর নাম হল মনসা।”
আদ্যাশক্তির মহামায়ার অনন্ত রূপের মধ্যে সৃষ্টি স্থিতি এবং লয়ের অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে পূজিত সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং কালী। এ সকল প্রধান রূপ থেকেই মনসা দেবী অভিন্ন। তাই মনসাদেবীর দ্বাদশাক্ষর বীজমন্ত্রে দেবীদুর্গা, লক্ষ্মী, কালী এবং সরস্বতী এ সকলেরই অধিষ্ঠান দেখা যায়। এ কল্পতরু স্বরূপ বীজমন্ত্রটি হল: “ওঁ হ্রীং শ্রীং ক্লীং ঐং মনসাদেব্যৈ স্বাহা।” তাই কেউ দেবীকে সদা চিন্তন করেও মুক্তিলাভ করতে পারে। তিনি ব্রহ্মস্বরূপিনী কুলকুণ্ডলিনী শক্তি। নাগ তাঁর গায়ের যজ্ঞোপবীত।
নাগের সাথে যোগের এবং যোগীর নিকট সম্পর্ক। তাই শিবের গায়েও নাগের যজ্ঞোপবীত দেখা যায়। নাগ গুহাবাসী, শীতের কয়েকটি মাস, শুধু বায়ু ভক্ষণ করেই বা সামনে যা খাবার আসে তাই ভক্ষণ করে অযাচক বৃত্তিতে তাই গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। এমন আচরণ পর্বত গুহাতে বসবাসকারী একজন যোগীর জীবনেও দেখা যায়। তাই রঘুনন্দন ভট্টাচার্য তাঁর ‘অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব’ নামক সুবিখ্যাত গ্রন্থে পদ্মপুরাণোক্ত দেবী মনসার একটি ধ্যানমন্ত্রে উদ্ধৃত করেছেন। সে ধ্যানমন্ত্রটি আজও বহুল ব্যবহৃত দেবীর পূজায়। ধ্যানমন্ত্রটিকে দেবীকে যায়, ‘কামরূপাম্’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাযোগিনী দেবী কামেশ্বরী রূপে প্রত্যেকটি জীবকে নাগরূপা কুলকুণ্ডলিনী শক্তি দ্বারা জীবের কামনা বাসনা থেকে মুক্ত করেন।
দেবীমম্বামহীনাং শশধরবদনাং চারুকান্তিং বদন্যাং হংসারূঢ়ামুদারামরুণিতবসনাং সর্বদাং সর্বদৈব।
স্মেরাস্যাং মণ্ডিতাঙ্গীং কণকমণিগণৈর্নাগরত্নৈ- র্বন্দেহং সাষ্টনাগামুরুকুচযুগলাং ভোগিনীং কামরূপাম্।।
“সর্পকুলের জননী, চন্দ্রবদনা, সুন্দর কান্তি বিশিষ্টা, বদন্যতাগুণসম্পন্না, হংসবাহিনী, উদার স্বভাবা, রক্তবস্ত্র পরিহিতা, সর্বদা অভিষ্ট প্রদায়িনী, সহাস্য বদনা, কণকমনি এবং নাগশ্রেষ্ঠগণের দ্বারা ভূষিতাঙ্গী,অষ্টনাগ পরিবৃতা, উন্নত কুচযুগল শোভিতা, ভোগিনী, কামরূপা দেবীকে সদা বন্দনা করি।”
দেবাদিদেব মহাদেব মনসা দেবীকে দিব্যজ্ঞান প্রদান করে সামবেদ অধ্যয়ন করিয়ে শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা করতে নির্দেশ দেন। সে নির্দেশনা অনুসরণ করে দেবী মনসা পুষ্কর তীর্থে গিয়ে তিন যুগ ধরে শ্রীকৃষ্ণের অষ্টাক্ষর মন্ত্র জপ করেন। দেবীর আরাধনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রসন্ন হয়ে তাঁকে দর্শন দেন। আমরা ঈশ্বরকে যতই আলাদা স্বরূপে উপাসনা করি, সে সকল উপাসনা একই ঈশ্বরের কাছেই পৌঁছে যায়। শুধু হৃদয়ে ভক্তি থাকলেই যথেষ্ট। পৌরাণিক কাহিনী মধ্যে অনেক রূপক গল্প আছে, এ গল্পগুলো সত্য নাও হতে পারে, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থটি সত্য। রূপকের আবরণে মোড়ানো থাকে বলে আমরা অনেক সময়েই ধরতে পারি না। দেবীভাগবতের এ নবম স্কন্ধের মনসাদেবীর কাহিনীর সাথে কথাগুলো শতভাগ সত্য।
আমরা এ পৌরাণিক আখ্যানটিতে দেখি, দেবী প্রথমে কৈলাশ পর্বতে গিয়ে দেবাদিদেব মহাদেবের আরাধনা করলেন; তাঁর আরাধনায় তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে দর্শন দিলেন। তিনি দেবী মনসাকে এরপরে নির্দেশ দিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করতে। দেবাদিদেব শিবের নির্দেশে দেবী পুষ্কর তীর্থে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করলেন এবং তাঁর দর্শন পেলেন।এ আখ্যানটিতে সবচেয়ে মজার বিষয় হল, মনসাদেবী যাদের নিষ্ঠার সাথে উপাসনা করেছেন, সেই মহাদেব এবং শ্রীকৃষ্ণই মনসাদেবীকে দর্শন দিয়ে তাঁর পূজা করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই মনসাদেবীর পূজা প্রবর্তন করেন।পৌরাণিক কাহিনীটিতে আমরা দেখছি, ভগবান শিব এবং কৃষ্ণকে যেমন দেবী মনসা আরাধনা করেছেন; তেমনিভাবে ভগবান শিব এবং শ্রীকৃষ্ণও দেবী মনসার আরাধনা করেছে। অর্থাৎ ভক্ত হয়ে যিনি আরাধনা করেছেন, তিনিই আবার পরক্ষণে তাঁর ইষ্টদ্বারা আরাধিত হয়েছেন। এ ঘটনাগুলো আমাদের একটি বিষয় উপলব্ধি হয় এবং শিক্ষা দেয় যে; স্রষ্টা ভিন্ন রূপে আরাধিত হলেও, আদতে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রথম দেবী মনসার পূজা করলেন। এরপর ভগবান শিব ও কশ্যপ মুনি দেবী মনসার পূজা করেন। এর ধারাবাহিকতায় ক্রমে ক্রমে মুনি, মনু, নাগ এবং মানব প্রভৃতি ত্রিলোকবাসী লোকজন দেবী মনসার পূজা নিষ্ঠার সাথে করতে লাগলেন। এভাবেই জগতে দেবী মনসার পূজা প্রচারিত হয়।
ত্রিযুগঞ্চ তপস্তপ্তা কৃষ্ণস্য পরমাত্মনঃ ।
সিদ্ধা বভূব সা দেবী দদর্শ পুরতঃ প্রভুম্ ।।
দৃষ্টা কৃশাঙ্গীং বালাঞ্চ কৃপয়া চ কৃপানিধিঃ ।
পূজাঞ্চ কারয়ামাস চকার চ স্বয়ং হরিঃ ।।
বরঞ্চ প্রদদৌ তস্যৈ পূজিতা ত্বং ভবে ভব ।
বরং দত্তা চ কল্যাণ্যৈ ততশ্চান্তর্দধে হরিঃ ।।
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা ।
দ্বিতীয়ে শঙ্করেণৈব কশ্যপেণ সুরেণ চ ।।
মুনিনা মনুনা চৈব নাগেন মানবাদিভিঃ ।
বভূব পূজিতা সা চ ত্রিষু লোকেষু সুব্রতা ।।
(দেবীভাগবত: নবমস্কন্ধ, ৪৮.১৯-২৩)
” দেবী মনসা পুষ্কর তীর্থে গমন করে তিন যুগ ধরে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করে সিদ্ধ হলেন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পেলেন। কৃপানিধি শ্রীহরি সেই কৃশাঙ্গী বালিকাকে দেখে, স্বয়ং নিজে পূজা করলেন ও অন্য সকলের দ্বারা পূজা করাইলেন । ভগবান হরি এরপর সেই বালিকাকে ‘তুমি ত্রিজগতে পূজ্যা হও’ বলে আশীর্বাদ করে অন্তর্হিত হলেন । পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ, প্রথমে মা মনসার পূজা করলেন। এরপর মহাদেব ও কশ্যপ মুনি মা মনসার পূজা করলেন । ক্রমে ক্রমে মুনি, মনু, নাগ এবং মানব প্রভৃতি ত্রিলোকবাসী লোকজন সেই দেবীর নিষ্ঠার সাথে পূজা করতে লাগলেন ।”
মনসাপূজাতে বলি অনেকটাই আবশ্যিক। এ কারণে বিভিন্ন পুরাণ এবং স্মার্ত পণ্ডিতদের বিধানে দেবীর পূজার বিধিতে বলিদানের কথা বারেবারেই দেখা যায়। দেবীভাগবতে আমরা দেখতে পাই, দেবরাজ ইন্দ্র শুদ্ধ হৃদয়ে , বিষ্ণু এবং শিবের আজ্ঞায় পশুবলি সহ ষোড়শ উপচারে মনসাদেবীর পূজা করেছিলেন। মনসাপূজার বলির আবশ্যকীয়তা আমরা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও পাই। সেখানে বলা হয়েছে, দেবী মনসাকে যে ব্যক্তি বলি প্রদান করে, সে ধনবান, কীর্তিমান এবং পুত্রবান হয়। তাই সর্বদা নিষ্ঠার সাথে বলিদান করে দেবীকে পূজা করে সন্তুষ্ট করা প্রয়োজন।
নত্বা ষোড়শোপচারং বলিঞ্চ তৎপ্রিয়ং তদা।
প্রদদৌ পরিতুষ্টশ্চ ব্রহ্মাবিষ্ণুশিবাজ্ঞয়া।।
(দেবীভাগবত: নবমস্কন্ধ, ৪৮.১১৪)
“দেবরাজ ইন্দ্র ভক্তিযুক্ত শুদ্ধ হৃদয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবের আজ্ঞায় পশুবলি সহ ষোড়শ উপচারে মনসাদেবীর পূজা করলেন।”
পঞ্চম্যাং মনসাখ্যায়াং দেব্যৈ দদ্যাচ্চ যো বলিম্।
ধনবান্ পুত্রবাংশ্চৈব কীর্তিমান্ স ভবেদ্ ধ্রুবম্।।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ : প্রকৃতি খণ্ড,৪৬.৯)
“পঞ্চমী তিথিতে দেবী মনসাকে যে ব্যক্তি বলি প্রদান করে, সে ধনবান, কীর্তিমান এবং পুত্রবান হয়।”
আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার পর যে পঞ্চমী তিথি, সে তিথিকে নাগপঞ্চমী বলে। সাধারণত নাগপঞ্চমীতে সারা ভারতবর্ষে দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ ভারতে নাগপঞ্চমীতে নাগদেবী রূপে ঘরে ঘরে পূজিত হন দেবী। ভারতবর্ষের কিছু কিছু স্থানে নাগপঞ্চমী থেকে ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা পঞ্চমী পর্যন্ত দেবীকে পূজা করা হয়। আজকের ভারতে নাগপঞ্চমী এক অতি জনপ্রিয় উৎসব। মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের নামই নাগপুর। এখানে একটি বিখ্যাত নাগদেবতার মন্দির আছে।
গোটা উত্তর ভারত জুড়ে পালিত হয় নাগপঞ্চমী। কাশীর বিভিন্ন কুস্তির আখড়াগুলিতে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে অনুষ্ঠিত হয় নাগপূজা।নাগদেবতাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে চন্দন, হলুদ ও সিঁদুর এবং দুধ সহ বিবিধ নৈবেদ্য এবং বলি অর্পণ করা হয় ।তাঁর সম্মুখে পারিবারিক সমৃদ্ধি ও সার্বিক কল্যাণের জন্য, কর্পূরের প্রদীপ জ্বালিয়ে পাঠ করা; মহাভারতের কদ্রু-বিনতা এবং জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ সহ বিবিধ আখ্যান।
বৃহত্তর বঙ্গে পুরো শ্রাবণ মাস জুড়েই দেবীর উপাসনা করা হয়। শ্রাবণের প্রথম দিন ঘটস্থাপন করে, সম্পূর্ণ শ্রাবণ মাস জুড়ে দেবীর ‘মনসামঙ্গল’ পাঠ করে; শ্রাবণের শেষ দিন ৩২ তারিখে মহোৎসবে দুধকলা, বিবিধ উপাচার এবং পশুবলি সহ তাঁর পূজা করা হয়। ফণীমনসা বা সিজগাছ স্থাপন করে মনসা পূজা করা হয়। বঙ্গের অনেক স্থানেই দেবীর মুখমণ্ডল চিত্রিত ঘট স্থাপন করে তাঁর উপাসনা করা হয়। কোথাও কোথাও অষ্টনাগের প্রতিমাতেই দেবীকে পূজা করা হয়।দেবীর ঘট এ জগতের প্রতীক।
হিন্দুরা পূজার সময় যেমন ভগবানের সাকার স্বরূপ কে পূজা করে, তেমনি নিরাকার স্বরূপকেও পূজা করেন। তাই প্রত্যেক পূজার মধ্যেই নিরাকার মানসপূজা এবং ঘটস্থাপন একান্ত আবশ্যক। ঘট স্থাপন ছাড়া পূজা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। মনসা পূজাতে তো বটেই, প্রায় সকল পূজাতেই তাই দেবতাদের ঘটে পূজা করা হয়। দেবী মনসাকে সামান্য একটি সাপ হিসেবে মনে করে, ভারতবর্ষে বিশেষ করে বঙ্গে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত আছে। বঙ্গদেশে লোকবিশ্বাস যে, নাগেদের দেবী মনসার একচোখ কানা; সে ধূপের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না ইত্যাদি। যদি ভুলেও কেউ দেবীর পূজায় ধূপধুনা দেয়, তবে দেবী রুষ্ট হয়ে অভিশপ্ত করেন। তাই মনসা পূজায় ধূপের ধুনা নিষিদ্ধ। কিন্তু লোকবিশ্বাস ছাড়া দেবী ভাগবত সহ কোন শাস্ত্রেই এমন নির্দেশনা পাওয়া যায় না। তবে শাস্ত্রে না থাকলেও, বিষয়টি বঙ্গের লৌকিক জীবনে প্রচলিত। বরং আমরা পুরাণের মধ্যে, মনসা দেবীর পূজায় ধূপ, দীপ দিয়ে অর্চনা করতে বলা হয়েছে।
ইতি ধ্যাত্বা চ তাং দেবীং মূলেণৈব প্রপূজয়েৎ।
নৈবদ্যের্বিবিধৈর্ধূপৈঃ পুষ্পগন্ধানুলেপনৈঃ।।
(দেবীভাগবত: নবমস্কন্ধ, ৪৮.৪)
“দেবী মনসার ধ্যান করে মূল মন্ত্রে নানাপ্রকার নৈবেদ্য, ধূপ, দীপ, পুস্প এবং অনুলেপন দ্বারা পূজা করবে।”
দেবীভাগবতে দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক একটি বিস্তৃত মনসা দেবীর স্তোত্র আছে। এ স্তোত্রে দেবরাজ ইন্দ্র বলেছেন, যারা মনসাদেবীর পূজা না করে তাঁর নিন্দা করবেন; তারা সর্বদা সর্পদংশনের ভয়ে ভীত থাকবে।লক্ষ্মীদেবী একদণ্ডও তাঁর গৃহে বাস করবেন না। কারণ রূপ আলাদা হলেও তাঁরা দুজনেই অভিন্না। দুজনের নামের ক্ষেত্রেই ‘পদ্মা’ নামটি পাওয়া যায়। তাই দুজনের মূর্তি পরিকল্পনায় অসম্ভব সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
যে ত্বাং ন পূজয়িষ্যন্তি নিন্দন্ত্যজ্ঞানতো জনাঃ।
লক্ষ্মীহীনা ভবিষ্যন্তি তেষাং নাগভয়ং সদা।।
ত্বং স্বয়ং সর্বলক্ষ্মীশ্চ বৈকুণ্ঠে কমলালয়া।
নারায়ণাংশো ভগবান্ জরৎকারুমুর্নীশ্বরঃ।।
(দেবীভাগবত: নবমস্কন্ধ, ৪৮.১৩৩-১৩৪)
“হে দেবী, অজ্ঞানতাবশত যে সকল ব্যক্তি আপনার পূজা না করে নিন্দা করবে,তারা সর্বদাই সর্পভয়ে আক্রান্ত হবে; লক্ষ্মীদেবী তাদের গৃহ হতে চলে যাবেন। আপনি জগতের লক্ষ্মী, বৈকুণ্ঠের কমলাদেবী স্বরূপিনী; তাই ভগবান নারায়ণের অংশসম্ভূত জরৎকারু মুনি আপনার স্বামী।”
দেবীভাগবত পুরাণের মত, হুবুহু প্রায় একই রকমের আরেকটি মনসাদেবীস্তোত্র আছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডে। স্তোত্রটিতে দেবরাজ ইন্দ্র বিস্তৃতভাবে দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন। তিনি দেবীকে সকল দেবতার ঈশ্বরী সুরেশ্বরী বলে অবিহিত করেন। দেবরাজ ইন্দ্র বলেন, দেবী মনসা সকল জীবের মুক্তি দান করেন তাই তিনি সিদ্ধযোগিনী। সকল জীবের তিনি মা, তাই তিনি জগদম্বিকা।তিনি বিষ্ণুর শক্তি স্বর্গলক্ষ্মী এবং বৈকুণ্ঠের কমলাকলা। দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক এ স্তোত্রটিতে দেবীর ব্রহ্মস্বরূপিনী সকল ভাবই রূপায়িত।স্তোত্রটির পরিসমাপ্তি করে দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গের সুরভি গাভীর দুগ্ধ দ্বারা দেবী মনসাকে অভিষিক্ত করেন।
“মহেন্দ্র উবাচ।
দেবি ত্বাং স্তোতুমিচ্ছামি সাধ্বীনাং প্রবরাং বরাম্ ।
পরাপরাঞ্চ পরমাং ন হি স্তোতুং ক্ষমোঽধুনা ।।
স্তোত্রাণাং লক্ষণং বেদে স্বভাবাখ্যানতৎপরম্ ।
ন ক্ষমঃ প্রকৃতিং বক্তুং গুণানাং তব সুব্রতে ।।
শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপা ত্বং কোপহিংসাবিবর্জিতা।
ন চ শপ্তো মুনিস্তেন ত্যক্তয়া চ ত্বয়া যতঃ ।।
ত্বং ময়া পূজিতা সাধ্বি জননী চ যথাদিতিঃ ।
দয়ারূপা চ ভগিনী ক্ষমারূপা যথা প্রসূঃ ।।
ত্বয়া মে রক্ষিতাঃ প্রাণাঃ পুত্রদারাঃ সুরেশ্বরি ।
অহং করোমি ত্বাং পূজ্যাং প্রীতিশ্চ বর্দ্ধতে মম ।।
নিত্যা যদ্যপি পূজ্যা ত্বং ভবেঽত্র জগদম্বিকে ।
তথাপি তব পূজাঞ্চ বর্দ্ধয়ামি চ সর্বতঃ ।।
যে ত্বামাষাঢ়সংক্রান্ত্যাং পূজয়িষ্যন্তি ভক্তিতঃ ।
পঞ্চম্যাং মনসাখ্যায়ামিষান্তং বা দিনে দিনে ।।
পুত্রপৌত্রাদয়স্তেষাং বর্দ্ধন্তে চ ধনানি চ ।
যশস্বিনঃ কীর্তিমন্তো বিদ্যাবন্তো গুণান্বিতাঃ ।।
যে ত্বং ন পূজয়িষ্যন্তি নিন্দন্ত্যজ্ঞানতো জনাঃ ।
লক্ষ্মীহীনা ভবিষ্যন্তি তেষাং নাগভয়ং সদা ।।
ত্বং স্বর্গলক্ষ্মীঃ স্বর্গে চ বৈকুণ্ঠে কমলাকলা ।
নারায়ণাংশো ভগবান্ জরৎকারুর্মুনীশ্বরঃ ।।
তপসা তেজসা ত্বাঞ্চ মনসা সসৃজে পিতা ।
অস্মাকং রক্ষণায়ৈব তেন ত্বং মনসাভিধা ।।
মনসা দেবিতুং শক্তা স্বাত্মনা সিদ্ধযোগিনী ।
তেন ত্বং মনসাদেবীং প্রবদন্তি পুরাবিদঃ ।।
সত্ত্বরূপা চ দেবি ত্বং শশ্বৎ সত্ত্বনিষেবয়া ।
যো হি যদ্ভাবয়েন্নিত্যং স তৎপ্রাপ্নোতি তৎসমঃ ।।
( ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ:প্রকৃতিখণ্ড, ৪৬.১২৮- ১৪১)
“হে পতিব্রতাপ্রধানে, হে সর্বশ্রেষ্ঠে, মনসা দেবি, আমি আপনার স্তব করছি । কিন্তু পরাপর-রূপিণী পরমেশ্বরীস্বরূপা আপনার স্তব করতে আমার কোন ক্ষমতা নাই। বেদে ‘স্ত্রোত্র’ শব্দের অর্থ স্বরূপকথন বলে নির্দিষ্ট হয়েছে। হে সুব্রতে, আপনার গুণ এবং মাহাত্ম্য অসীম এবং সে সকল সম্পূর্ণ বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।হে শুদ্ধস্বত্ত্বস্বরূপিণি আপনি হিংসা ও ক্রোধের ঊর্ধ্বে। জগতকারু মুনি আপনাকে ত্যাগ করলেও আপনি পতিব্রতা ধর্মের পালন করতে মুনিকে অভিশাপ দেন নি। হে দেবি, হে পতিব্রতে, আপনাকে আমি দেবমাতা অদিতির ন্যায় পূজা করছি। আপনি আমার প্রতি জননীর ন্যায় ক্ষমা করেছেন এবং ভগিনীর ন্যায় সদয়া হয়েছেন। হে সুরেশ্বরী, আপনি আমার প্রাণ, সন্তান ও পরিবারাদি রক্ষা করেছেন । আমিও আপনার পূজা করে সন্তোষ লাভ করলাম। হে জগজ্জননী, আপনি জগজ্জন কর্ত্তৃক রোজ পূজিতা হলেও আমি আপনার পূজা বর্ধিত করব।
হে দেবি, যে ব্যাক্তি আষাঢ়ীয় সংক্রান্তি এবং মনসাপঞ্চমী হতে আশ্বিন মাস পর্যন্ত আপনার আরাধনা করবে সে যশ, কীর্ত্তি, বিদ্যা এবং গুণবাণ পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে অতুল ঐশ্বর্যের আধিপত্য লাভ করবে। যারা অজ্ঞানতাবশত আপনার পূজা না করে, নিন্দা করবে তারা সর্পভয় থেকে কোনদিনই মুক্ত হবে না এবং দেবী কমলা তাদেরকে পরিত্যাগ করে চলে যাবেন। আপনি স্বর্গে স্বর্গলক্ষ্মী, বৈকুণ্ঠে কমলাদেবীর কলাস্বরূপিণী; নারায়ণদেবের অংশ জগতকারুমুনি আপনার পতি।পিতা কশ্যপ মুনির স্বীয় তপস্যার তেজে আমাদের রক্ষার্থে তাঁর মন থেকে আবির্ভূত হয়েছেন বলে আপনি ‘মনসা’ নামে খ্যাতা । আত্মশক্তিতে আপনি ‘সিদ্ধযোগিনী’। মনে ক্রিড়া করেন বলে ত্রিজগত আপনাকে ‘মনসা’ বলে অবিহিত করে।দেবতারা নিরন্তর সর্বতোভাবে আপনাকে ভক্তিভরে মনে মনে পূজা করেন, তাই শাস্ত্রবিদগণ সকল দেবপূজ্যা আপনাকে ‘মনসা’ নামেই কীর্তন করেন। আপনি নিরন্তর সত্ত্বপুরুষকে কৃপা করে ‘সত্ত্বরূপিণী’ নামে কীর্তিত হয়েছেন। যে ব্যাক্তি যে বস্তু কামনা করে আপনার কৃপা প্রার্থনা করে, আপনার কৃপায় সে তা সকলই প্রাপ্ত হয়।”
দেবী মনসার এক নাম ‘বিষহরি।’ জীবের সকল বিষ তিনি হরণ করেন। এ বিষ শুধু সাপের নয়; সাপের বিষের থেকেও ভয়ঙ্কর বিষ অবস্থান করে আমাদের মনে। কাম, ক্রোধ,লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এ ষড়রিপুর বিষ সাপের বিষের থেকেও ভয়ংকর। এরা আমাদের জীবনীশক্তিকে তিলে তিলে দগ্ধ করে দেয়। দেবীর কৃপায় এ বিষ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। ব্রহ্মস্বরূপিনী মনসাদেবী শুদ্ধ জ্ঞানের প্রতীক।তাই তাঁর বাহন রাজহংস। রাজহংস যেহুতু দুধে জলে মিশিয়ে দিলে, জলের অংশ পরিত্যাগ করে শুধুই দুধের অংশ গ্রহণ করে।দেবীও তেমনি কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে সাধককে মুক্তির পথে অগ্রসর করে।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মূল পোষ্ট
বিঃ দ্রঃ এ লেখাটি লেখকের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এবং হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে।