যেসব রূপভেদ মা কালীর! পর্ব – ১

তন্ত্র পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপভেদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তোড়লতন্ত্র অনুসারে, কালী আট প্রকার। যথা: দক্ষিণকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী। মহাকাল সংহিতার অনুস্মৃতিপ্রকরণে নয় প্রকার কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা: দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, গুহ্যকালী, কামকলাকালী, ধণকালিকা, সিদ্ধিকালী, সিদ্ধিকালী, চণ্ডিকালিকা।

অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থদ্বয়ে কালীর ১৩টি রূপের উল্লেখ আছে। যথা: সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নিরুদ্রকালী, মহাকালী, মহাভৈরবঘোর ও চণ্ডকালী। জয়দ্রথ যামল গ্রন্থে কালীর যে রূপগুলির নাম পাওয়া যায়, সেগুলি হল: ডম্বরকালী, রক্ষাকালী, ইন্দীবরকালিকা, ধনদকালিকা, রমণীকালিকা, ঈশানকালিকা, জীবকালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী ও সপ্তার্নকালী।

মুণ্ডকোপনিষদে মহাকালী স্বয়ং কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সধূম্রবর্ণা, বিশ্বরুচি, স্ফুলিঙ্গিনী, চঞ্চলজিহ্বা ইত্যাদি নামে ভূষিত হন। মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে পূজার নাম জৈষ্ঠ্যে ‘ফলহারিণী’ কালী পূজা।

অষ্টধা কালী

দক্ষিণাকালী

দক্ষিণাকালীর কালীর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ মূর্তি। ইনি প্রচলিত ভাষায় শ্যামাকালী নামে আখ্যাতা। দক্ষিণাকালী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তার বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুগলে বর ও অভয় মুদ্রা। তার গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। তার গলায় মুণ্ডমালার হার; কর্ণে দুই ভয়ানক শবরূপী কর্ণাবতংস; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। তার দন্ত ভয়ানক; তার স্তনযুগল উন্নত; তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দণ্ডায়মান। তার দক্ষিণপদ শিবের বক্ষে স্থাপিত। তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী।

তাত্ত্বিকের তার নামের যে ব্যাখ্যা দেন তা নিম্নরূপ: দক্ষিণদিকের অধিপতি যম যে কালীর ভয়ে পলায়ন করেন, তার নাম দক্ষিণাকালী। তার পূজা করলে ত্রিবর্ণা তো বটেই সর্বোপরি সর্বশ্রেষ্ঠ ফলও দক্ষিণাস্বরূপ পাওয়া যায়। বাংলা তথা হিন্দু বাঙালির গৃহে এই পূজার প্রচলনে নবদ্বীপের তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ দক্ষিণাকালীর শান্তি রূপকল্পনা করেন। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি নবদ্বীপে নিজের হাতে কালী প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে পূজা করেন, যা আগমেশ্বরী মাতা নামে খ্যাত।

সিদ্ধকালী মা

সিদ্ধকালী কালীর একটি অখ্যাত রূপ। গৃহস্থের বাড়িতে সিদ্ধকালীর পূজা হয় না; তিনি মূলত সিদ্ধ সাধকদের ধ্যান আরাধ্যা। কালীতন্ত্র-এ তাকে দ্বিভূজা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। অন্যত্র তিনি ব্রহ্মরূপা ভুবনেশ্বরী। তার মূর্তিটি নিম্নরূপ: দক্ষিণহস্তে ধৃত খড়্গের আঘাতে চন্দ্রমণ্ডল থেকে নিঃসৃত অমৃত রসে প্লাবিত হয়ে বামহস্তে ধৃত একটি কপালপাত্রে সেই অমৃত ধারণ করে পরমানন্দে পানরতা। তিনি সালংকারা। তার বামপদ শিবের বুকে ও বামপদ শিবের উরুদ্বয়ের মধ্যস্থলে সংস্থাপিত।

গুহ্যকালী

গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ গৃহস্থের নিকট অপ্রকাশ্য। তিনি সাধকদের আরাধ্য। তার রূপকল্প ভয়ংকর: গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা; নারদাদিঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন; তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। গুহ্যকালী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা। মুর্শিদাবাদ-বীরভূম সীমান্তবর্তী আকালীপুর গ্রামে মহারাজা নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত গুহ্যকালীর মন্দিরের কথা জানা যায়। মহাকাল সংহিতা মতে, নববিধা কালীর মধ্যে গুহ্যকালীই সর্বপ্রধানা। তার মন্ত্র বহু – প্রায় আঠারো প্রকারের।

সোর্সঃ সংগৃহিত

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.