উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম দিকে বিন্যস্ত মোট দশটি দিক থাকলে বাস্তুশাস্ত্রে আটটি দিকের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ৷ এই আটটি দিক হল-পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, অগ্নি, নৈঋত ও বায়ু৷ এর মধ্যে প্রথম চারটিকে বলা হয় প্রধান ‘দিক’৷ শেষ চারটিকে বলা হয় সহায়ক ‘কোন’ চলিত কথায় আমরা এগুলিকে মুখ্যত আটটি দিক বলতে পারি৷ বাস্তুমতে নবম দিক হল আকাশ ও দশম দিক হল পাতাল। ইমারত গঠনের সময় এই বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরি। আগেকার দিনে সূর্যের ছায়া দেখে দিকের হিসেব করা হত। এখন ম্যাগনেটিক কম্পাসের মতো উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে নিখুঁত ভাবে দিক নির্ণয় করা হয়। সাধারণ ভাবে চারটি প্রধান দিক নিয়ে হিসেব হলেও বাস্তুমতে মোট দশটি দিক রয়েছে। তবে কম্পাসে আটটি দিকের হদিশ পাওয়া যায়। কম্পাস মোট ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘুরতে পারে। প্রতিটি দিকের জন্য ৪৫ ডিগ্রি করে নির্দিষ্ট রয়েছে। প্রতিটি দিকের জন্য ডিগ্রির স্তর পরীক্ষা করে নেওয়া প্রয়োজনীয়। ভারতীয় শাস্ত্র অনুসারে এই আটটি দিকের প্রতিটির এক-একজন অধিদেবতা বা দিকপাল রয়েছেন৷ এখানে ‘দেবতা’ বলতে ‘শক্তি’ বোঝানো হচ্ছে৷ বাস্ত্তশাস্ত্র অনুসারে এই চারটি দিক ও চারটি কোণ থেকে অনবরত বিভিন্ন প্রকার শক্তি বিচ্ছুরিত হয়ে পৃথিবীর উপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে৷ তাই মানুষের সর্বসিদ্ধি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রকৃতির এই সকল শক্তির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে জীবন ধারণের বিভিন্ন রকম আদব-কায়দা, রীতি-নীতি ও বিধি-নিষেধের কথাই বাস্তুশাস্ত্রে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে৷
উত্তর – বাস্তুমতে উত্তর দিক অত্যন্ত শুভ হিসেবে বিবেচিত। এই দিকের অধিপতি হলেন হিন্দু মতে ধন-সম্পত্তির দেবতা কুবের। সেই কারণে উত্তর দিককে অর্থ ও পেশাগত উন্নতির দিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বুধ হল উত্তর দিকের গ্রহ। বাস্তুপুরুষের বুক ও পেট উত্তর দিকে থাকে। তাই ঘরের উত্তর দিক সব সময় খোলামেলা, আলোকজ্জ্বল ও সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা জরুরি। আধুনিক বাস্তুবিশেষজ্ঞদের মতে উত্তর মেরুর কারণে উত্তর দিক থেকে প্রচুর পরিমাণে ভালো শক্তি নির্গত হয়। এই শক্তি বাড়ির সকল সদস্যের জন্যই প্রয়োজনীয়। তাই উত্তর মেরুর পজিটিভ শক্তি বাড়ির মধ্যে যাতে ভালোভাবে প্রবেশ করতে পারে, সে জন্য উত্তর দিক খোলামেলা রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন বাস্তু বিশেষজ্ঞরা। বাড়ির এই দিকে কখনই শৌচালয় বানাবেন না। এই দিকে সিন্দুক বা টাকা রাখার জায়গা রাখতে পারেন।
দক্ষিণ – দক্ষিণ দিক সবসময়ই বাস্তুমতে খারাপ দিক হিসেবে চিহ্নিত। তবে তা সবসময় সত্যি নয়। বলা যেতে পারে উত্তর দিকের সব ভালো শক্তির ব্যাঙ্ক হল দক্ষিণ দিক। দক্ষিণ দিক খুব একটা খোলামেলা না হওয়াই ভালো। বাস্তুমতে এই দিকের অধিপতি হলেন হিন্দু দেবতা যম। তাই ঘরের দক্ষিণ দিক বেশি খোলামেলা হলে বাড়ির সদস্যদের বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ এমনকি মৃত্যুভয় লেগে থাকবে। দক্ষিণ দিক খোলামেলা বাড়ির সদস্যরা মামলা-মোকদ্দমাতেও জড়িয়ে পড়তে পারেন। দক্ষিণ দিকে বন্ধ দেওয়াল থাকলে অর্থ ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাবে। এই দিকের প্রতিনিধি গ্রহ হল মঙ্গল। বাড়ির এই দিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাখবেন না। বিশেষ করে খাবার টেবিল বা রান্নাঘর এই দিকে কখনই করবেন না।
পূর্ব – অত্যন্ত শক্তিশালী দিক। এই গ্রহের অধিপতি হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। ইন্দ্র বৃষ্টি, প্রতিপত্তি, উত্সব ও শক্তির দেবতা। পাশাপাশি পূর্ব দিকে প্রতিনিধি গ্রহ হল সূর্য, যা নিজেই শক্তির বিশাল উত্স। সূর্যের প্রভাবে জীবনে উন্নতি হয়। তাই পূর্ব দিককে আমরা উন্নতির দিক হিসেবে চিহ্নিত করি। বাড়ির পূর্ব দিকও খোলামেলা, আলোকজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি। এই দিকে দরজা, জানালার পরিবর্তে শুধুই বন্ধ দেওয়াল থাকলে জীবনে উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হবে। বাড়ির পূর্ব দিকে বাথরুম থাকা বাস্তুমতে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত। মনে রাখবেন, পূর্ব দিকে বাধা মানে আপনার জীবনেও বাধা। পড়ার ঘর, পুজোর ঘর, কাজের ঘর এগুলি এই দিকে মুখ করে করা যেতে পারে। এমনকি বাড়ির আলমারী বা সিন্দুকও এই দিকে মুখ করে খোলা বাস্তুমতে ভালো। বাড়িতে এইদিকে খোলা জায়গা থাকা বেশ ভালো।
পশ্চিম – এই দিক জীবনে প্রতিষ্ঠা ও সমৃদ্ধির দিক। এই দিকের অধিপতি হলেন বৃষ্টি, খ্যাতি ও ভাগ্যের দেবতা বিষ্ণু। এই দিকের প্রতিনিধি গ্রহ হল শনি। বাড়ির পশ্চিম দিক খুব একটা খোলামেলা রাখা বাঞ্ছনীয় নয়। পূর্ব দিকের শক্তি অর্থাত্ সূর্য থেকে নির্গত শক্তি পশ্চিম দিকে সঞ্চিত হয়। সূর্য বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঢলে পড়ে সেভাবেই শক্তির উত্স্যও পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে সরে যায়। পশ্চিম দিকে বাড়ির মূল দরজা না হওয়াই ভালো। এতে অর্থলাভের সম্ভাবনা নষ্ট হয়। বাড়ির এই দিকে স্টোর রুম, সিঁড়ি বা জলের ট্যাংক করতে পারেন।
উত্তর পূর্ব (ঈশান) – বাস্তুমতে খুবই ভালো দিক। এই দিকের অধিপতি হলেন হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ দেবতা শিব। এর প্রতিনিধি গ্রহ হল বৃহস্পতি। ধনসম্পত্তি, প্রতিপত্তি ও সুস্বাস্থ্য দান করে। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উত্তরপূর্ব অত্যন্ত শুভ দিক। এই দিক থেকে শক্তিশালী চৌম্বকীয় শক্তি নির্গত হয়। বাড়ির উত্তরপূর্ব দিকে শৌচাগার নির্মাণ গোটা পরিবারকে শেষ করে দিতে পারে। এই দিকে দাহ্য পদার্থ রাখা উচিত নয়। বড় নির্মাণও না করাই ভালো।
দক্ষিণ পূর্ব (আগ্নেয়) – আপনার যদি কোনও বদরাগী, সংবদেনশীল সুভাকাঙ্খী থাকেন, তাঁর মতোই অনেকটা হল এই দক্ষিণপূর্ব দিক। দক্ষিণপূর্ব দিকের অধিপতি হল অগ্নিদেব। এর প্রতিনিধি গ্রহ শুক্র। সূর্য যখন দক্ষিণপূর্ব দিকে আসে, তখন এর মেজাজ অত্যন্ত উগ্র থাকে। সবথেকে উগ্র অবস্থায় এই সময়ই থাকে সূর্য। এই উগ্র রূপকে আগুনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। আগুন সংক্রান্ত কাজকর্ম এই দিকে করলে ভালো হয়। এই দিকে জিনিসপত্র রাখা ও নির্মাণ করার সময় সতর্ক থাকা জরুরি। বাড়ির এই দিকে স্নানাগার, শৌচালয়ের মতো কিছু রাখবেন না।
দক্ষিণ পশ্চিম (নৈঋত) – এই দিকের অধিপতি হল নিরিতি নামের এক রাক্ষস। এর প্রতিনিধি গ্রহ রাহু। উত্তরপূর্ব দিক থেকে নির্গত চৌম্বকীয় শক্তি এই দিকে সঞ্চিত হওয়ায় এটাই বাড়ির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। এই দিকের সঠিক ব্যবহার খুবই শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যকর জীবন দিতে পারে। এই দিক সম্পদ, স্বাস্থ্য ও আত্মবিশ্বাসের দিক হিসেবে চিহ্নিত। বাস্তু মেনে ব্যবহৃত হলে দক্ষিণ পশ্চিম দিক খ্যাতি এনে দেবে। কিন্তু ভুল ব্যবহার নানা সমস্যা ডেকে আনবে। অর্থ বেরিয়ে যাবে। হতাশা, উদ্বেগ এমনকি আত্মহত্যাপ্রবণতাও দেখা দিতে পারে। কর্মক্ষেত্রে দক্ষিণ পশ্চিম দিকের ভুল ব্যবহার কর্মীদের কাজে অমনোযোগের কারণ। বাড়ির এই দিকে জলের ট্যাংক কখনই করবেন না।
উত্তর পশ্চিম (বায়ু) – এই দিকের অধিপতি হল বায়ু। এর প্রতিনিধি গ্রহ হল চন্দ্র। বাতাস এর মূল উপাদান হওয়ায় এই দিকটি খুবই অস্থির দিক। এই দিকের সঠিক ব্যবহারে জীবনে নানা সুযোগ আসে। পেশাগত জীবনে উন্নতি হতে পারে। তবে বাস্তুমতে এর ভুল ব্যবহার বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।এর ফলে অসুখবিসুখও হতে পারে। এই দিক ব্যবহার করুন বৈঠকখানা হিসেবে। যেখান ঘরের সকল সদস্য একসঙ্গে বসতে পারবে। তবে এইদিকে খাবার ঘর করা যাবে না বা শোওযার ঘর হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে না।
১) উত্তর দিকে কিছুটা খালি জায়গা ছাড়তে পারলে মাতুল বংশের মঙ্গল হয়।
২) বাস্তুশাস্ত্র মতে, দক্ষিণ দিক হল ধন-সম্পত্তি, সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য ও শান্তির দিক।
৩) বাস্তু মতে, পূর্ব দিক বংশের কল্যাণের দিক বলে বিবেচিত হয়। তাই বাস্তুশাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী, গৃহ নির্মাণের সময় পূর্ব দিকের কিছু জায়গা খোলা ছাড়তে পারলে গৃহস্বামীর আয়ু বৃদ্ধি হয়।
৪) শাস্ত্র মতে, পশ্চিম দিক হল সাফল্য, যশ, ঐশ্বর্য ও খ্যাতির দিক।
৫) ঈশান কোণ বংশ বৃদ্ধিতে স্থায়িত্ব প্রদান করে। এই কোনে কোনও রকমের ত্রুটি বংশ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
৬) নৈঋত কোণ সুবিচারের জন্ম দেয়। এ ছাড়াও, নৈঋত কোণ সুসম্পর্ক গঠনে সহায়ক।
৭) অগ্নি কোণ স্বাস্থ্যোন্নতিতে বিশেষ ভাবে সহায়ক। এই কোণ ত্রুটিপূর্ণ হলে সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হয়।
৮) বায়ু কোণ শত্রু বা মিত্র সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে। বায়ু কোণ ত্রুটিপূর্ণ হলে শত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।