বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বণ, হিন্দু ধর্মের একটি অন্যতম উৎসব রথযাত্রা। রথযাত্রা এক বিশেষ পূণ্য তিথি, এই তিথির মাধ্যমে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা নগর ভ্রমণ প্রচলিত আছে। রথ হল জয়ের প্রতীক। রথ দেখলে আধ্যাত্মিক জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, চিত্তশুদ্ধি ঘটে এমনকি রথ টানার সময় একজন যদি তা দাঁড়িয়ে দেখেন তাতে তাঁর অন্তরে থাকা সমস্ত পাপের মোচন ঘটে।
ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ অনুযায়ী, রথযাত্রা সত্যযুগ থেকে চালু হয়েছে। কথিত রয়েছে, সেই সময় সেখানের রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ম স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিষ্ণু মন্দির তৈরি করার, মন্দির স্থাপন করে জগন্নাথ , বলরাম, সুভদ্রার মূর্তি তৈরি করার। সেজন্য দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা মূর্তি তৈরী করার জন্য মন্দিরে প্রবেশ করলেন। বিশ্বকর্মার শর্তছিল মন্দির ভিতর থেকে বন্ধ থাকবে এবং তিনিই মন্দির খুলবেন।
অনেক দিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ায় রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ম মূর্তি তৈরীর বর্তমান অবস্থা জানার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেন। সেলক্ষ্যে তিনি দেবশিল্পীর নিষেধাজ্ঞা অমান্যকরে মন্দিরে প্রবেশ করেন ফলে শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় বিশ্বকর্মা অসন্তুষ্ট হয়ে যান। সে কারণে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার সম্পূর্ণ মূর্তি নির্মাণ না করেই চলে যেতে হয় বিশ্বকর্মাকে।
এদিকে, কথিত রয়েছে, যে শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে রথে চড়ে দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে সাথে নিয়ে মাসি রানী গুন্ডিচার মন্দিরে বেড়াতে যান জগন্নাথদেব। সেই উপলক্ষ্যে ওই তিথি মেনেই মন্দিরে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার আয়োজন হয়। এই যাত্রাকেই রথ যাত্রা বলা হয়। এরপর সাত দিন পর মাসি গুন্ডিচার মন্দির থেকে জগন্নাথদেবের ফেরার যাত্রাকে উল্টোরথ যাত্রা বলা হয়।
রথযাত্রা অত্যন্ত একটা পবিত্র দিন বলেই শাস্ত্রে উল্লিখিত রয়েছে। রথ মানেই সকাল সকাল বাজারে গিয়ে ছোটো-বড়-মাঝারি রথ কিনে নিয়ে আসা ৷ ফুল, মালা, বাহারি গাছ দিয়ে রথকে সাজানো ৷ রথের ভিতর জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি ৷ প্রসাদের থালায় মিষ্টি৷ আর বিকেল হতেই রশি ধরে মারও টান ! রথ চলেছে পথ ছেড়ে দাও বলে চিৎকার ৷ সঙ্গে পাপড় ভাজা মাস্ট ৷ রথের দিনে আট থেকে আশি মজে ওঠেন এই উৎসবেই ৷
শাস্ত্র অনুযায়ী, সংসারে সমৃদ্ধি, শ্রীবৃদ্ধির জন্য রথ উৎসব কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৷ তাই এ দিন যা করতে পারেন –
(১) মনস্কামনা পূরণের জন্য ১১ রকমের ফল, ১১ রকমের মিষ্টি এবং ১১টি এক টাকার কয়েন একটি হলুদ কাপড়ে করে জগন্নাথদেবের আসনে রেখে দিন। বাড়িতে নারায়ণ থাকলে তাঁর সামনেও এই ব্রত পালন করতে পারেন।
(২) একটি পিতলের বাটিতে একটু আতপ চাল, দুটো কাঁচা হলুদ এবং ১ টাকার একটি কয়েন দিন। তুলসি জগন্নাথদেবের সবচেয়ে প্রিয় তাই ১০৮টি তুলসী পাতা দিয়ে মালা তৈরি করুন, ১০৮টি পাতা না থাকলে ৫৪টি পাতা দিয়ে মালা তৈরি করতে পারেন। তবে তুলসি পাতা ফুটো করা যাবে না। তুলসি পাতার ডগাগুলিকে বেঁধে বেঁধে এই মালা তৈরি করতে হবে।
(৩) যেকোনও পূণ্য তিথিতেই গঙ্গাস্নান করে থাকেন অনেকে। রথযাত্রার পূণ্য তিথিতে গঙ্গাস্নান করাকে শুভ বলে মনে করা হয়।
(৪) বাড়ির জগন্নাথদেবের মূর্তিকে সাদা চন্দন, সাদা, হলুদ ফুলে সাজিয়ে তুলুন ৷ সঙ্গে সাজিয়ে তুলুন বলরাম ও সুভদ্রাকেও ৷
(৫) এদিন জগন্নাথ দেবের সামনে জ্বালিয়ে দিন ঘিয়ের প্রদীপ ৷ লক্ষ্য রাখুন প্রদীপটি যেন জ্বলতে থাকে ৷ সেই প্রদীপ থেকে জ্বালিয়ে নিন রথে রাখা প্রদীপটি ৷
(৬) ঠাকুর ঘর ছাড়া, ঘরের অন্য কোথাও জগন্নাথ দেবের মূর্তি থাকলে, সব মূর্তিতেই মালা, ফুল দিন ৷
(৭) জগন্নাথ ক্ষীর খেতে ভালোবাসেন ৷ ক্ষীর যেন থাকে জগন্নাথের প্রসাদে ৷
(৮) রথ টানার আগে অবশ্যই শঙ্খ ধ্বনি ও কাঁসর-ঘণ্টা বাজান ৷
(৯) রথের দিনে গাছ পোঁতা খুবই শুভ তাই এইদিন অবশ্যই গাছ লাগান যা পরিবেশের জন্য যেমন প্রয়োজনীয়।
(১০) যদিও দান করার জন্য কোনও নির্দিষ্ট দিন হয় না। রথের দিন কিছু দান করলে তা অবশ্যই শুভ বলে মনে করা হয়।
(১১) রথযাত্রা উৎসবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেউ অংশ নিলে পূণ্যার্জন হয়,সারাজীবন জগন্নাথের আশীর্বাদ মেলে।
(১২) রথযাত্রার পূণ্য লগ্নে অনেকেই গৃহ প্রবেশের অনুষ্ঠান করে।
(১৩) রথযাত্রার দিনে অনেকেই দুর্গাপুজোর খুঁটিপুজোর অনুষ্ঠান করে থাকেন।