আজ থেকে অম্বুবাচী উৎসব, চলুন জেনে নেই এর মাহাত্ম্য কী?

আজ থেকে অম্বুবাচী উৎসব, চলুন জেনে নেই এর মাহাত্ম্য কী?

omubachi

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পবিত্র ভূমির বিভিন্ন স্থানে ৫১ টি শক্তিপীঠ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, যাদের পূজা ও দর্শন করলে সকলের সমস্ত মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়। এমনই একটি শক্তিপীঠ গুয়াহাটির কামাখ্যা মন্দির। অম্বুবাচীর সময় কেন বন্ধ থাকে এই মন্দির, চলুন জেনে নেই এখান থেকে।

 

অনেক যুগ আগে পুরাণ মতে লোককথা অনুসারে, মা “পার্বতীর” বাপের বাড়িতে মাতা পার্বতীর স্বামী “শিবশম্ভ” কে যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। প্রভু শিবের বেশভূষা ছিল সাদামাটা। তিনি পশুর বাকল বা চামড়া পরিধান করতেন। পার্বতীর পিতা প্রভু শিব কে পছন্দ করতেন না। প্রভু শিব নিমন্ত্রণ পাওয়াতে সেই যজ্ঞ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। পার্বতীর পিতা প্রভু শিব কে সেই যজ্ঞ অনুষ্ঠানে ভরা সভায় পাগল এবং চাল চুলোহীন ফকির বলে অপমানিত করেছিলেন। মা পার্বতী তার স্বামীকে অপমান করা হয়েছে জানতে পারার পর সহ্য করতে না পেরে দুঃখে-কষ্টে নিজেকে অগ্নিতে আহুতি দেয়। এরপর পার্বতীর মৃত্যু হয়। শিব পার্বতীর শবদেহ কোলে তুলে নিয়ে ভয়ানক তাণ্ডব শুরু করেন। শিবের তাণ্ডবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যখন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল তখন ব্রহ্মাণ্ডকে বাঁচাতে বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা পার্বতীর শবদেহ ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করেন। সেই দেহের ৫১ টি খন্ড পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পড়ে। সুগঠিত হয় অতি পবিত্র ৫১ শক্তিপিঠ। তারই মধ্যে একটি খন্ড পড়েছিল ভারতের গুয়াহাটিতে যা এখন কামাখ্যা মন্দির নামে পরিচিত। এটি এমনই একটি শক্তিপীঠ যাকে বলা হয় মহা শক্তিপীঠ। এই মন্দিরটি আসাম রাজ্যের গুয়াহাটির একটি পাহাড়ে নির্মিত। এই মন্দিরটি অন্যান্য শক্তিপীঠ থেকে কিছুটা আলাদা কারণ এই স্থানটি তন্ত্র সাধনার জন্যও খুব বিখ্যাত।

 

এই মন্দিরে দেবীর কোনও মূর্তি নেই, এখানে মা সতীর যোনির অংশ পতিত হয়েছিল, তাই এখানে দেবীর যোনি অংশটিই পূজো করা হয়, যা পাথরের আকারে অধিষ্ঠিত। যারা এই শিলাকে পুজো করেন, দেখেন এবং স্পর্শ করেন, তারা দেবীর কৃপা ও মোক্ষলাভ এবং মা ভগবতীর সঙ্গ লাভ করেন। এই শক্তিপীঠে, মাতৃদেবী ৬৪ টি যোগিনী এবং দশটি মহাবিদ্যার সাথে বিরাজমান। ভুবনেশ্বরী, বগলা, ছিন্নমস্তা, কালী, তারা, মাতঙ্গী, কমলা, সরস্বতী, ধূমাবতী এবং ভৈরবী একই স্থানে অধিষ্ঠিত। যদিও সব শক্তিপীঠের নিজস্ব গুরুত্ব রয়েছে, কিন্তু কামাখ্যা শক্তিপীঠকে অন্য সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বা উত্তম বলে মনে করা হয়। কালিকা পুরাণ অনুসারে, এই স্থানে কামদেব শিবের ত্রিনেত্র বা তৃতীয় চক্ষু দ্বারা ভস্মীভূত বা ভস্ম হয়েছিলেন এবং তাঁর পূর্বের রূপ লাভের বর পেয়েছিলেন। এখানে আসলে আশানুরুপ ফল লাভ হয়।

 

অম্বুবাচী উৎসব কী: অম্বুবাচী শব্দটি অম্বু এবং বাচী এই দুটি শব্দের মিশ্রণে গঠিত যার অম্বু অর্থ জল এবং বাচী অর্থ বসন্ত। এই শব্দটি নারীর শক্তি এবং তাদের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাকে প্রস্ফুটিত করে। প্রতি বছর জুন মাসে মা কামাখ্যার মন্দিরে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। অম্বুবাচী উৎসবের সময় মা ভগবতীর গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ থাকে এবং এই সময় দর্শনও নিষিদ্ধ করা হয়। তিন দিন পর মা ভগবতীর রজস্বলা শেষে তার বিশেষ পূজা ও ধ্যান করা হয়। চতুর্থ দিনে ব্রহ্ম মুহূর্তে দেবীকে স্নান করানোর পর পরই মন্দির খুলে দেওয়া হয় ভক্তদের কৃপা লাভের দর্শনের জন্য।

 

যাত্রীরা প্রথম দিনে কামেশ্বরী দেবী এবং কামেশ্বর শিবের দর্শন করেন এবং তারপরে মহামুদ্রায় গমন করেন। দেবীর যোনিমুদ্রাপীঠ দশ ধাপ নিচে একটি গুহায় অবস্থিত যেখানে নিরবচ্ছিন্ন প্রদীপ সর্বদা জ্বলে। এখানে আসা-যাওয়ার জন্য আলাদা পথ রয়েছে, এখানে প্রসাদ আকারে ভক্তদের একটি ভেজা কাপড় দেওয়া হয়, যাকে বলা হয় অম্বুবাচী বস্ত্র। কথিত আছে, দেবীর ঋতুস্রাব হওয়ার আগে গর্ভগৃহে স্থাপিত মহামুদ্রার চারপাশে সাদা কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হয়, তিন দিন পর মন্দিরের দরজা খুললে এই কাপড়গুলো মায়ের রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। পরে এই কাপড় প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। লোককথা আছে, এই কাপড় পরিধান করে পূজা করলে ভক্তদের সকল মনের ইচ্ছা পূরণ হয়।

 

এ সময় ব্রহ্মপুত্র নদের জল তিন দিন লাল রঙের আঁকার ধারণ করে । অম্বুবাচী উৎসব ছাড়াও কামাখ্যায় আরও দুটি উৎসব পালিত হয়, যার মধ্যে একটি হল দেবধ্বনি, যাকে দেউধাবি বলা হয়, যেখানে যন্ত্রের সাহায্যে নৃত্য পরিবেশন বা উপস্থাপন হয়। পৌষ মাসের কৃষ্ণপক্ষে পুষ্য নক্ষত্রে পুষ্যভিষেক উৎসব পালিত হয়, যেখানে কামেশ্বর মন্দিরে কামেশ্বরের চলন্ত বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়। দ্বিতীয় দিন ভগবতীর পঞ্চরত্ন মন্দিরে উভয় প্রতিমার হর-গৌরী বিবাহ অনুষ্ঠান পালিত হয়। মহা কুম্ভ নামে এই মেলার সময় তান্ত্রিক শক্তিকে অতীব গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে শতাধিক তান্ত্রিক তাদের তন্ত্র-মন্ত্র সাধনা করে এবং সকলের সামনে তাদের শক্তি প্রদর্শন করে।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.