ভারতীয় আধ্যাত্মজগতে অন্যতম রহস্যময় ব্যক্তিত্ব লোকনাথ ব্রহ্মচারী। ‘রহস্যময়’ একারণেই যে, তাঁর সম্পর্কে তেমন বিশদ তথ্য পাওয়া যায় না। অসংখ্য অলৌকিক কাহিনি তাঁর জীবনকে ঘিরে আবর্তিত হয়। তাঁর উপদেশাবলিও খুবই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু বাঙালির কাছে তাঁর ভাবমূর্তি নিয়ত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাঁকে দৈব অবস্থানে বসাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি বাঙালি।
ঢাকার বারোদি গ্রামের শ্রীলোকনাথের একটি প্রতিকৃতিকে ঘিরে এমন এক রহস্যের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যা সত্যিই রোমাঞ্চকর। বাবা লোকনাথের যে ছবিটি আমদের চোখের সামনে বিরাজ করে, তার উৎস একটি ফোটোগ্রাফ। সেই ছবিটি তুলেছিলেন দেশীয় রাজ্য ভাওয়ালের তৎকালীন রাজা। আজ থেকে ১৩০ বছর আগে সেই ফোটো থেকে একটি পেন্টিং তৈরির কথা ভাবেন রেণুকা নাগ।
রেণুকাদেবী ঢাকার বিখ্যাত নাগ পরিবারের প্রেমরঞ্জন নাগের স্ত্রী। রেণুকাদেবী লোকনাথ বাবার সেই ছবিটি দেখেন, যেটি ভাওয়ালের রাজা তুলেছিলেন। সেই ছবিটি ছিল নেহাতই ছোট— মাত্র ৩ ইঞ্চি x ৫ ইঞ্চি। রেণুকাদেবী বাবার একটি বড় প্রতিকৃতি তৈরি করাতে মনস্থ করেন।
রেণুকাদেবী এর পরে ঢাকার এক প্রতিভাবান অথচ দরিদ্র শিল্পী দুর্গেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে শ্রীলোকনাথের একটি পেন্টিং আঁকার বরাত দেন। এবারেই শুরু হয় অতিলৌকিক কিছু ব্যাপার। দুর্গেশবাবু প্রথমে এ ফোর সাইজের একটি কাগজে প্রতিকৃতিটি আঁকতে শুরু করেন। সাদা কাগজে চাইনিজ ইঙ্কেই তিনি প্রাথমিক স্কেচটি করতে থাকেন।
আসল প্রতিকৃতিটি তাঁর সামনে দেওয়ালে টাঙানো ছিল। স্কেচ কিছুদূর এগোনোর পরে এমন কিছু অনুভূতি দুর্গেশবাবুর হতে থাকে, যা ব্যাখ্যাতীত। তিনি জানান, আঁকতে আঁকতে তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়ছেন। এবং তার পরে কী ঘটছে, তিনি জানেন না।
প্রকৃতপক্ষে দুর্গেশবাবুর একটা ট্রান্সের মধ্য চলে যাচ্ছিলেন, জানালেন রেণুকাদেবীর দৌহিত্র অভিজিৎ রুদ্র। অভিজিৎবাবু বর্তমানে কলকাতার সল্টলেকের বাসিন্দা। তাঁর বক্তব্য অনুয়ায়ী, আবিষ্ট অবস্থায় দুর্গেশবাবুর হাত অবিশ্বাস্য গতিতে চলতে শুরু করে।
একটি এ ফোর কাগজে বাবার মুখাবয়বটি আঁকা হয়। তাঁর শরীরের বাকি অংশ অন্য কয়েকটি এ ফোর-এ এঁকে একত্র করে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করা হবে ঠিক হয়। সব শেষে দুর্গেশবাবু প্রতিকৃতির চোখ আঁকবেন বলে স্থির করেছিলেন। কিন্তু চোখ আঁকতে গিয়ে বার বার বিপত্তি দেখা দেয়।
চোখ আঁকতে গিয়ে তিনি অনুভব করেন, যে আবেশে তিনি পুরো ছবিটি এঁকেছেন, তা লুপ্ত হয়েছে। কিছুতেই তিনি প্রতিকৃতিতে প্রকৃত চক্ষুদান করে উঠতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের মতো করে প্রতিকৃতির চোখ আঁকেন।
নাগ পরিবারের এক প্রবীণ সদস্যকে নিয়ে এসে সেই প্রতিকৃতি দেখানো হয়। তিনি জানান, বাল্যকালে তিনি বাবা লোকনাথকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি দুর্গেশবাবুর আঁকা প্রতিকৃতির চোখের সঙ্গে বাবা লোকনাথের চোখের কোনও মিল নেই বলেন।
বার বার দুর্গেশবাবু চোখ আঁকেন, বার বার সেই প্রবীণ ভদ্রলোকও হচ্ছে না বলে জানান দিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত অবস্থায় সেই ছবি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পড়ে থাকে।
প্রায় দেড় বছর পরে এক শীতের রাতে দুর্গেশবাবু ঢাকায় বুড়িগঙ্গার ধারে একটি পার্কে বেড়াচ্ছিলেন। পার্কের দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে তিনি টের পান সেটি বন্ধ এবং সামনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছেন বলে মনে হয় তাঁর। মুখ তুলে তিনি দেখতে পান, এক দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
একটি আচ্ছাদনে তাঁর মুখটি ঢাকা। ফ্রেমে সেই পুরুষ তাঁর মুখাবরণটি সরান। দুর্গেশবাবু দেখতে পান, অতি তীব্র আলোকজ্যোতিসম্পন্ন চক্ষুদ্বয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং শ্রীলোকনাথ। দুর্গেশবাবু জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরতে তিনি কারোকে আর দেখতে পাননি।
এবারে তিনি একদৌড়ে রেণুকাদেবীর বাড়ি আসেন এবং দ্রুত হাতে প্রতিকৃতিতে চক্ষুদান করেন। পরের দিন সেই প্রবীণ ভদ্রেলোককে নিয়ে আসা হয়, তিনি প্রথম দর্শনেই চমকিত হন। ‘বাবা’ বলে উচ্চৈস্বরে ডেকে তিনি জ্ঞান হারান।
অভিজিৎবাবুর সল্টলেকের বাড়িতেই আজ সেই প্রতিকৃতির অধিষ্ঠান। প্রকৃতপক্ষে এটিই শ্রীলোকনাথের প্রথম পেন্টিং। তার চাইতেও বড় কথা, সত্যিই কী রয়েছে এই চোখের পিছনে? একটি মণি উর্ধ্বে আর একটি নিম্নে কেন?
প্রশ্নের উত্তরে অভিজিৎবাবু জানালেন, উর্ধ্বগামী চোখটি মহাবিশ্ব এবং নিম্নমুখী চোখটি অন্তঃস্থ জগতের প্রতীক। যা সমগ্র অধ্যাত্মবাদের মূলকথা। কেউ বলেন ভাণ্ড-ব্রহ্মাণ্ড, কেউ বলেন— অ্যাজ অ্যাবভ সো বিলো। যোগদর্শন এই ম্যাক্রো-র সঙ্গে মাইক্রোকেই যুক্ত করার কথা বলে।
মহাযোগী লোকনাথ কি তাঁর অতিলৌকিক দর্শন দ্বারা শিল্পী দুর্গেশবাবুকে সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন সেই দিন? কে সমাধান করবে এই রহস্যের? – এবেলা, ইন্টারনেট