জেনে নিন বৃহস্পতিবার মা লক্ষ্মীর পূজার পদ্ধতি, মন্ত্র ও নিয়ম কানুন সমূহ!

 

প্রতি বৃহস্পতিবার প্রত্যেক ঘরে মা লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। মা লক্ষ্মী শুধুমাত্র ধন-সম্পদের দেবী নন। তিনি অপার সৌন্দর্যের এক প্রতীক। গৃহ সব সময় সুন্দরভাবে সুসজ্জিত করতে গেলে লক্ষীদেবীর পূজা করা আবশ্যক। সাধারণত মেয়েরা সংসারের মঙ্গল কামানোর জন্য প্রতি বৃহস্পতিবার এই ব্রত করে থাকেন। বর্তমানে এই সমাজে অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সমাজের এই গভীর অন্ধকারের মধ্যেও আশার আলো জাগাতে আমরা ভগবানের আরাধনা ও পূজা-পার্বণ করে থাকি। এতো অন্যায় অত্যাচারের মধ্যেও কিছু সৎ মানুষ এখনো মাথা উঁচু করে বেঁচে আছেন। যাঁদের মধ্যে সদাচার, ভজন, কীর্তন, দেব-দ্বিজের সেবা, ভক্তি-শ্রদ্ধা এখনও দেখা যায়। এখনও অনেক মানুষ ধর্মকর্মে সংযুক্ত ও লিপ্ত থাকতে চায়। কিন্তু মাঝে মাঝে পথভ্রষ্ট হোন।

প্রতিনিয়ত সংসারের নানান সমস্যায় জর্জরিত মানুষ আজ সমাধানের পথ খুঁজছে। “মা লক্ষ্মী” দেবী সেই পথের দিশা দেখাতে পারেন। মা লক্ষ্মীকে দেখা যায় কর্দম থেকে উত্থিত পদ্মের ওপরে বসে আছেন। যা আধ্যাত্মিক পবিত্রতা ও পরাশক্তির প্রতীক। মা লক্ষ্মীর হাতের প্রহরণ শুভশক্তির প্রতীক, অশুভ শক্তির বিনাশ করার জন্য। একাগ্রচিত্তে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করলে মহাশক্তি স্বরূপিনী সকলের সব রকম কল্যাণ ও মঙ্গল করে থাকেন।

মা লক্ষ্মীর পূজাপাঠে ধন, মান, যশের সাথে সাথে শারীরিক সুস্থতাও আসে।বৃহস্পতি হল লক্ষ্মীর প্রতীক। বৃহস্পতি শুভ গ্রহ। তাই বৃহস্পতিবার মা লক্ষ্মীর উপাসনা বা প্রার্থনা করলে সকল দুঃখ-দুর্দশা দূর হয়। অর্থনৈতিক সমস্যারও সমাধান হয়। যদি কোনও বৃহস্পতিবার পূর্ণিমা হয়, তবে সেই দিন কোনও গৃহিণী উপবাসে থেকে “মা লক্ষ্মীর” পূজা করলে ধন-সম্পদে ঘর পরিপূর্ণ হয় এবং সকল সমস্যার সমাধান হয়।

শরৎকালে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন মা জাগ্রত থাকেন। সে দিন মায়ের পূজা, স্তব ও দ্বাদশ নাম পাঠ করলে মায়ের আশীর্বাদ লাভ করা যায়। মা লক্ষ্মীর শ্রী যন্ত্রম পুজো করলেও সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি লাভ করা যায়। যদি কেউ শ্রী যন্ত্রম পূজা করতে চান, তবে কোনও জ্ঞানী ব্রাহ্মণকে এনে যথাসাধ্য উপাচারে শ্রী যন্ত্রমের প্রাণ সঞ্চার বা প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতে হবে। এই মা লক্ষ্মীর যন্ত্রম নিত্য দর্শন করলেও লক্ষ্মী প্রাপ্তি হয়।

বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপূজার উপকরণ সমূহঃ
যেগুলি লাগে সেগুলি হল—সিঁদুর, ঘট ১টি, ধান সামান্য, মাটি সামান্য, আমপল্লব ১টি, ফুল ১টি, দুর্বা সামান্য, তুলসীপাতা ২টি, ফুল, কাঁঠালি কলা বা হরীতকী ১টি, চন্দন, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, সামান্য আতপচাল ও জল। কোনো নৈবেদ্য জোগাড় করতে না পারলে, পূজার শেষে সেই নৈবেদ্যটির কথা মা লক্ষ্মীর কাছে হাতজোড় করে মনে মনে বলে ক্ষমা চেয়ে নিলেই হবে। লক্ষ্মীপূজা বৃহস্পতিবার মাত্রেই করা যায়।

সে জন্য কোন তিথি নক্ষত্রের প্রয়োজন হয় না। তাই যাঁরা প্রবাসী তাদের ভারতীয় বা বাংলাদেশী সময় মিলিয়ে পূজা না করলেও চলবে, যেদেশে যেমন বৃহস্পতিবার আছে, সেই দেশে তেমনই করবে। তাছাড়া শাস্ত্রে আছে, প্রবাসে নিয়মং নাস্তি। তাই প্রবাসী হলে রবিবার বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও লক্ষ্মীপূজা করা যায়। সেক্ষেত্রে পূজার আগে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলে নেবেন, মা বৃহস্পতিবার পূজা করতে পারলাম না, আজ পূজা গ্রহণ করো। ভারত বা বাংলাদেশের নাগরিক হলে বৃহস্পতিবারের পূজা বৃহস্পতিবারেই করা প্রয়োজন।

লক্ষ্মীপূজায় ঘণ্টা বাজাবেন না। লক্ষ্মীকে তুলসীপাতা দিবেন না। কিন্তু লক্ষ্মীপূজার পর একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা দিয়ে নারায়ণকে পূজা করতে পারবেন। লক্ষ্মীপূজা সাধারণত সন্ধ্যাবেলা করে, তবে অনেকে সকালেও করে ফেলেন। সকালে করলে সকাল ৯ টার মধ্যে করা উত্তম। পূজার পর মা লক্ষ্মীর ব্রতকথা পাঠ করতে হয়। লক্ষ্মীপূজায় লোহা বা স্টিলের বাসনপত্র ব্যবহার করা উচিত নয়। লোহা দিয়ে অলক্ষ্মীকে পূজা করা হয়। তাই লোহা থাকলে লক্ষ্মী গৃহত্যাগ করে চলে যান।

পূজাপ্রণালীঃ
প্রথমে মাথায় একটু গঙ্গাজল দিয়ে নারায়ণকে স্মরণ করুন। পূজার আগে মাথায় জল দিয়ে দেহ ও নারায়ণকে স্মরণ করে মন শুদ্ধ করে নেবেন। তারপর সূর্যের উদ্দেশ্যে একটু জল নিন। যে কোনো পূজার আগে আমাদের প্রাণশক্তির উত্‍স সূর্যকে জল প্রদান করার নিয়ম, তাই জল দেওয়ার জন্য ঠাকুরের সিংহাসনে একটি ছোটো তামার পাত্র সবসময় রাখবেন। সূর্যের নাম করে সেই কুশীতে জল নিয়ে সেই তামার পাত্রে রাখবেন। তারপর সংসারের সকলের মঙ্গলকামনা করবেন। এরপর একটু গঙ্গাজল আপনার পূজার আসন, পূজার ফুল-নৈবেদ্য ইত্যাদি উপকরণের উপর ছিটিয়ে দেবেন। এইভাবে পূজার নৈবেদ্য গুলিকে শুদ্ধ করে নিতে হয়।

এরপর মা লক্ষ্মীর সামনে সামান্য ধান ও এক চিমটি মাটি ছড়িয়ে দিয়ে তার উপর জলভরা ঘট প্রতিষ্ঠা করবেন। ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে মঙ্গলচিহ্ন এঁকে নিবেন। ঘটে একটি পঞ্চ পাতার আমেরপল্লব ও তার উপর একটি কলা বা হরীতকী দিয়ে উপরে একটি ফুল দেবেন। ইচ্ছা করলে ঘটে ও “মা লক্ষ্মীকে” একটি করে মাল্য ও পড়াতে পারেন। এবার মা লক্ষ্মীকে ধ্যান করুন।

লক্ষ্মীর ধ্যানমন্ত্র হলঃ
ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।
গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বলঙ্কার-ভূষিতাম্।
রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।

মন্ত্রটি পাঠ করতে পারলে উত্তম। নয়তো “মা লক্ষ্মীর” রূপটি চোখ বুজে মনে মনে কিছুক্ষণ চিন্তা করবেন। এরপর মা লক্ষ্মীকে আপনার ঘরে আহবান করবেন।

আহবান মন্ত্রটি হলঃ
ওঁ লক্ষ্মীদেবী ইহাগচ্ছ ইহাগচ্ছ ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ ইহ সন্নিধেহি ইহ সন্নিরুদ্ধস্য অত্রাধিষ্ঠান কুরু মম পূজান গৃহাণ।

সংস্কৃতে মন্ত্র পড়তে অসমর্থ্য হলে বাংলায় বলবেন, এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী, যতক্ষণ তোমার পূজা করি, ততক্ষণ তুমি আমার ঘরে স্থির হয়ে থাকো মা।
তারপর ভাববেন, মা লক্ষ্মী আপনার হৃদয়ে এসে বসে আপনার দেওয়া ফুল-নৈবেদ্য গ্রহণ করছেন। একে বলে মানসপূজা।
এরপর আপনার পূজা নৈবেদ্যগুলি একে একে লক্ষ্মীকে দেবেন। লক্ষ্মী আপনার ঘরে পূজা নিতে এলেন, তাই প্রথমেই একটুখানি পানি ঘটের পাশে লক্ষ্মীপদচিহ্নে দেবেন। এটি মা লক্ষ্মীর পা ধোয়ার জল। এরপর দুর্বা ও একটু আতপ চাল ঘটে দেবেন। এটি হল অর্ঘ্য। এর সাথে একটি ফুলও দিতে পারেন। এরপর লক্ষ্মীকে একটি চন্দনের ফোঁটা দেবেন। লক্ষ্মীর প্রতিমা না থাকলে ফুলে চন্দন মাখিয়ে ঘটে দেবেন। এরপর লক্ষ্মীকে ফুল দেবেন। তারপর প্রথমে ধূপ ও তারপর প্রদীপ দেখাবেন। শেষে নৈবেদ্যগুলি উৎস্বর্গ করে দেবেন। তারপর ফুল দিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন।

মন্ত্রঃ
এষ সচন্দনপুষ্পাঞ্জলি ওঁ শ্রীঁ লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ। (শ্রীঁ উচ্চারণ হবে শ্রীং, নমঃ উচ্চারণ হবে নমহ।) পুষ্পাঞ্জলি এক, তিন বা পাঁচ বার দিতে পারেন। পুষ্পাঞ্জলির পর নারায়ণের উদ্দেশ্যে একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা ঘটে নিবেদন করবেন। তারপর ইন্দ্র ও কুবেরের নামে দুটি ফুলও ঘটে নিবেদন করবেন। মা লক্ষ্মীর পেঁচা কেও একটি ফুল দেবেন। আপনি যদি দীক্ষিত হন, তবে এরপর আপনার গুরুমন্ত্র যথাশক্তি জপ করে মা লক্ষ্মীর বাঁ হাতের উদ্দেশ্যে জপসমর্পণ করবেন। শেষে নিম্নোক্ত মন্ত্রে প্রণাম করবেনঃ
ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে ।
সর্বতঃ পাহি মাং দেবি মহালক্ষ্মী নমঽস্তু তে ।।

মন্ত্র পড়তে অসমর্থ্য হলে বিনা মন্ত্রেই ভক্তিভরে মা-কে প্রণাম করবেন। এরপর মা লক্ষ্মীর ব্রতকথা পাঠ করবেন।
বিঃ দ্রঃ কেউ কেউ লক্ষ্মীকে পান-সুপারিও দেন। আপনাদের বাড়িতে তেমন প্রথা থাকলে দেবেন।বাড়িতে যে লক্ষ্মীর পাঁচালি আছে সেটিই পড়বেন। লক্ষ্মীর ব্রতকথা বা পাঁচালি বাজারে সহজলভ্য। বাড়িতে পাঁচালি না থাকলে, যেকোনো একটি কিনে নিয়ে পাঠ করলেই হবে।পদ্মাসন স্থিতে দেবী পরমব্রহ্মস্বরূপিণী , সর্বদুঃখ হরে মহালক্ষ্মী নমোস্তুতে।

ধ্যানঃ
ত্রিভুবনের মাতা তুমি , তুমি যে শ্রীস্বরুপা । বামে তব পদ্ম , অঙ্কুশ দক্ষিনে পাশ , অক্ষমালা।।
রত্নালঙ্কারে ভূষিতা তুমি গৌরবর্না সুরুপা ; স্বর্ণপদ্মহস্তে লয়ে পদ্মাসনে আসীনা ।।
দক্ষিন হস্তে বরমুদ্রা দিতেছে অভয় । ধ্যান করি তোমায় মাগো , রহ সর্বময়।

প্রনামঃ
বিশ্বরুপের ভার্যা তুমি , তুমি পদ্মধারিণী
মঙ্গলপ্রান তুমি মাগো , তুমি পদ্মবাসিনী ।।
সর্বদুঃখ হতে রক্ষা কর এই মোর প্রার্থনা ।
প্রনাম করি তোমায় আর নেই কোন কামনা ।।

পুস্পাঞ্জলিঃ
ওঁ নমস্তে সর্বাদেবানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে।
যা গতিস্ত্বাত্‍ প্রপন্নানাং সা মে ভুয়াত্ত্বদ অর্চনাত্‍ ।।

 

আরো আপডেট পেতে

Bangla Panjika 2023 Paji 1430 Download করুন

For Bangla Calendar, Bangla Panjika, Bengali Calendar, Horoscope download Bangla Panjika 2023 Paji 1430

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.