দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের রহস্য ও ইতিহাস। চলুন জেনে নেই! পর্বঃ ১

 

“মা কালী” বা কালিকা হলেন একজন হিন্দুদের এক বিশেষ দেবী। তিনি দেবী দুর্গা বা পার্বতীর আরেকটি অভিন্ন রূপ। তাকে মৃত্যু, সময় ও পরিবর্তনের কর্ত্রী বলে মনে করা হয়। তন্ত্র অনুসারে কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। কেরালা ব্যতীত সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে কালীকে ভগবান শিবের স্ত্রী পার্বতীর এক বিশেষ রূপ হিসাবে বিশ্বাস করা হয়। কেরালায় লোকমত অনুসারে অনুসারে ভগবান শিবের তৃতীয় নেত্র থেকে রাক্ষসদের ধ্বংস করার জন্য তিনি আবির্ভূতা হন এভাবেই মর্তে তাহার আগমন হয়, তাই কেরালায় তাঁকে ভৈরবোপপত্নী মহাকালী বলা হয়।
পুরাণ অনুসারে, তাঁর প্রথম আবির্ভাব হয় ভগবান শিব হতে। তিনি শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ এবং সমস্ত জীবের জগত মাতা। নিরপরাধীদের রক্ষা করার জন্য তিনি দুষ্টের দমন করেন। সময়ের সাথে সাথে, কালীকে ভক্তিমূলক আন্দোলন ও তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের দ্বারা বিভিন্নভাবে দেবী মা, মহাবিশ্বের মা, আদ্যশক্তি মহামায়া বা পার্বতী হিসাবে পূজা করা হয়। শাক্ত ও তান্ত্রিক সম্প্রদায়রাও তাঁকে চূড়ান্ত বাস্তবতা বা ব্রহ্ম হিসেবে পূজা করে।তাঁকে ঐশ্বরিক রক্ষিতা হিসেবেও দেখা হয় এবং যিনি মোক্ষলাভ বা মুক্তি প্রদান করেন।

 

মা কালীর প্রণাম মন্ত্রঃ
“জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বহা স্বধা নমস্তুতে”।।

 

দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের সূচনাঃ
সৃষ্টির আদি থেকে ধারক ও বাহক মা কালী। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সতীর দেহের একান্নটি অংশ পতিত হওয়ার কারণে গড়ে উঠেছে সতীপীঠ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণেশ্বরে জগদম্বার মন্দিরটি কোন সতীপীঠ নয় বরং কাল্পনিক মন্দির।
মা ভবতারিণীর অনেক জানা অজানা ইতিহাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দক্ষিণেশ্বরের যেখানে সেখানে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আধ্যাত্মবাদের প্রকাশে স্বয়ং মা ভবতারিণী। ধর্মপ্রাণ ও নিষ্ঠাবান মানুষের এই প্রিয় তীর্থক্ষেত্রের কিছু না জানা কথা আজকে আপনাদের কাছে ইতিহাসের রূপে জানানোর চেষ্টা করব।

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের রহস্য ও ইতিহাসঃ
দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির কলকাতার কাছাকাছি হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত। এটি উত্তর ২৪ পরগণা জেলার দক্ষিণেশ্বরে অবস্থিত। ১৮৫৫ সালে বিখ্যাত দয়াময়ী জমিদারনী রানি রাসমণি এই মন্দিরটি গঠন করেন। এই মন্দিরে দেবী কালীকে “ভবতারিণী” নামে পূজা করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট যোগী বাবা “রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব” এই মন্দিরে কালী মায়ের সাধনা করতেন।

লোকমত অনুসারে, ১৮৪৭ সালে ধনী বিধবা জমিদারনী রানি রাসমণি দেবী কাশীতে তীর্থযাত্রার আয়োজন করেন। ২৪টি নৌকায় আত্মীয়স্বজন, দাসদাসী ও রসদ নিয়ে তিনি রওয়ানা হোন। জনশ্রুতি অনুসারে যাত্রার পূর্বরাত্রে রানি মা কালীর দেবীর স্বপ্নে দেখা পান। রানি রাসমণি মা কালীর দেবীর স্বপ্নে আদেশ পেয়ে এই মন্দিরটি গড়ে তুলেন। মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রাসমণি দেবীকে সীমানাহীন সাহায্য করেছিলেন। রামকুমারই ছিলেন মন্দিরের প্রথম প্রধান পুরোহিত। ১৮৫৭-৫৮ সালে কিশোর রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরের পূজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই মন্দিরকেই তার সাধন-ভজন ক্ষেত্ররূপে গ্রহণ করে নেন।

এই স্বপ্নের পরপর রানি অতিসত্বর গঙ্গাতীরে জমি কিনেন এবং মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৮৪৭ সালে এই বিশাল মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয়; শেষ হয় ১৮৫৫ সালে। মন্দিরের কুড়ি একরের জায়গাটি জন হেস্টিং নামে এক ইংরেজের কাছ থেকে ক্রয় করা হয়। লোকমতে জায়গাটির নাম ছিল সাহেবান বাগিচা। এর একটি অংশ ছিল মুসলমানদের কবরস্থান। তাই তন্ত্রমতে স্থানটি শক্তি আরাধনার বা উপাসনার জন্য উপযুক্ত বলে মনে করা হয়। আটবছরে নয় লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা খরচে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮৫৫ সালের ৩১ মে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রার দিন মহাসমারোহে মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রামকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রধান পুরোহিত পদে যোগদান করেন, তার ছোটোভাই গদাধর বা গদাই (পরবর্তীতে রামকৃষ্ণ পরমহংস) তার সহযোগী ও তারও পরে রামকৃষ্ণ প্রধান পূজারি পদে নিযুক্ত হোন। তার সহধর্মিনী সারদা দেবী মন্দির চত্বরের বাইরে নহবতখানায় অবস্থান করতেন। এই নহবতখানা এখন সারদা দেবীর মন্দির। ওই সময় থেকে ১৮৮৬ পর্যন্ত প্রায় তিরিশ বছর শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে বসবাস করতেন।

মন্দিরটি বঙ্গীয় স্থাপত্যশৈলীর নবরত্ন স্থাপত্যধারায় নির্মিত। এটি টালিগঞ্জের রামনাথ মণ্ডল নির্মিত নবরত্ন মন্দিরের আদলে নির্মিত। মূল মন্দিরটি তিন তলা। উপরের দুটি তলে এর নয়টি চূড়া রয়েছে। মন্দির দক্ষিণমুখী। একটি উদ্ধৃত দালানের উপর গর্ভগৃহটি স্থাপিত। এই দালানটি ৪৬ বর্গফুট প্রসারিত ও ১০০ ফুট উঁচু।
গর্ভগৃহে শিবের বক্ষোপরে ‘মা ভবতারিণী’ নামে পরিচিত “মা কালীর” বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠিত। এক খণ্ড পাথর কুঁদে তৈরি হয়েছে এই দেবী বিগ্রহ। এই বিগ্রহদ্বয় একটি রুপোর সহস্রদল পদ্মের উপর স্থাপিত।

 

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি চত্বরে কালীমন্দির ছাড়াও একাধিক দেবদেবীর মন্দির ও অন্যান্য উপাসনা স্থান অবস্থিত। মূল মন্দিরের কাছে যে ১২ টি একই প্রকার দেখতে পূর্বমুখী শিবমন্দির রয়েছে সেগুলি আটচালা স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। গঙ্গার একটি ঘাটে দুই ধারে এই মন্দিরগুলি দণ্ডায়মান। মন্দির চত্বরের উত্তর-পূর্বে রয়েছে রাধাকান্ত মন্দির। এই মন্দিরে একটি রুপোর সিংহাসনে সাড়ে একুশ ইঞ্চির কৃষ্ণ ও ষোলো ইঞ্চির রাধামূর্তি প্রতিষ্ঠিত। এবং রানী রাসমণির গৃহদেবতাও দক্ষিণেশ্বরে অবস্থান করছেন। মন্দির চত্বরের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাসগৃহ। কাছেই পঞ্চবটি (অশ্বথ, বট, বিল্ব, অশোক ও আমলকী)। এখানে নিয়মিত সাধনায় বসতেন শ্রীরামকৃষ্ণ। মূল মন্দির চত্বরের বাইরে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তার পরিবারবর্গের স্মৃতিবিজড়িত আরও কয়েকটি স্থান আছে, যা আজ পুণ্যার্থীদের আকর্ষণ করে। মন্দির চত্বরে প্রবেশের আগে রয়েছে রানি রাসমণির মন্দির।

 

আরো আপডেট পেতে

Bangla Panjika 2023 Paji 1430 Download করুন

For Bangla Calendar, Bangla Panjika, Bengali Calendar, Horoscope download Bangla Panjika 2023 Paji 1430

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.